বিষণ্নতা এবং অদ্ভুত মুগ্ধতা

প্রবাসের দিনগুলো এমনিতেই গুমোট। মন খারাপের সন্ধ্যাগুলো ঝুপ করে নেমে আসে। মেইন স্ট্রিটের সিগন্যালে, স্টার বাক্সের কফিতে, পার্কিং লটের ক্রিকেটে বিষাদের গল্পগুলো ঘুরে বেড়ায়। এখন আবার এর মধ্যে করোনার ফ্যাসাদ। ঘর থেকে বের হওয়া যাবে না, বাসা থেকেই কাজ করতে হবে, স্ক্রিনের দিকে হাঁ করে আট ঘণ্টা তাকিয়ে থাকতে হবে, জুম মিটিংয়ে ভালো ব্যাকগ্রাউন্ড ঠিক করতে হবে।
মার্চের মাঝামাঝি থেকে নিউইয়র্ক স্টেটে জরুরি অবস্থা জারি হয়। অফিস থেকে তল্পিতল্পা গুটিয়ে বাসায়। সেই যে ঢুকলাম, আর বের হতে পারছি না। এখনো মনে আছে এপ্রিলের সেই দিনগুলোর কথা, যখন প্রতিদিন ১০ হাজারের বেশি কোভিড রোগী শনাক্ত হতো। একঘেয়েমি কাটাতে গাড়ি নিয়ে এক দিন বের হতেই দেখি পুরো এলাকা সুনসান, যেন এক ভুতুড়ে শহর।
দিনগুলো এখন অন্য রকম। সকালের ঘড়ি ধরে আর তাড়াহুড়ো নেই, লাল সিগন্যালে বিরক্ত হয়ে বসে থাকা কিংবা পাশের লেনের ভক্সওয়াগনকে ওভারটেক করে বিজয়ের হাসি নেই, এক ভবন থেকে অন্য ভবনে মিটিংয়ে ছোটাছুটি নেই, রুম নম্বর ৩০৪–কে ভুল করে ২০৪–এ ঢুকে পড়া নেই। অস্থির সময়কে আরও অসহ্য করে তুলছে অ্যাম্বুলেন্সের সাইরেন।
এভাবেই চলছে করোনাকাল। খুব বেশি করে মনে পড়ছে সেই দিনগুলো। সেই হাসিমুখ, বিশ্ববিদ্যালয়ের বারান্দার আড্ডা, শহীদ মিনারে শেষ আইসক্রিমটা, লোকাল বাসের সেই গালমন্দের দুপুর। বিকেলের সব আলো কমে গেলে পার্কের শেষ মানুষটাও যখন বাড়ি ফিরে যায়, সেই আলোতে নিজেকে বড় বেমানান মনে হয়।
তবুও আশা ধরে রাখতে চাই। তিন মাসের অচলাবস্থার পর সীমিত আকারে খুলে গেছে নিউইয়র্ক শহর। আপ স্টেট নিউইয়র্ক প্রায় পুরোনো রূপে ফিরে গেছে ইতিমধ্যে। বহুল আলোচিত কোভিড কার্ভ ফ্ল্যাট করে দেখিয়েছে দুই কোটি মানুষের নিউইয়র্ক স্টেট। অচলাবস্থা শুরুর চার মাস পর ১৩ জুলাই প্রথম মৃত্যুহীন দিন পার করেছে নিউইয়র্ক শহর। প্রাণ ফিরে আসতে শুরু করেছে শহরে, নিউ নরমালে মানিয়ে নিচ্ছে সবাই, বিষণ্নতা ভুলে সবাই ছুটে চলছে অদ্ভুত মুগ্ধতার পানে। দুঃস্বপ্নের রাত পেরিয়ে অবশ্যই আবার শুরু হবে সেই অসমাপ্ত চলাচল।
*লেখক: সহকারী অধ্যাপক, স্টেট ইউনিভার্সিটি অব নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র