বিশ্ব টেনিসের জগতে লাল সবুজের হাতছানি

লেখকের মেয়ে জেসিকা
লেখকের মেয়ে জেসিকা

সবাই তারকা হতে চায়। কিন্তু কেউ হয়, কেউ হয় না। উৎসর্জন, প্রেরণা, নৈবেদ্য ও সহনের সমন্বয়ে সৃষ্টি হয় বিশ্ব তারকা। শিল্পী, অভিনেতা-অভিনেত্রী, স্প্রিন্টার, টেনিস বা ফুটবল খেলোয়াড়—সবার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য এক ও অভিন্ন। ব্যক্তি হিসেবে তারা তাদের ব্যক্তিত্বে স্বতন্ত্র। তারা সাধারণদের মধ্যে অসাধারণ ও তাদের সংখ্যা কম। বিজয়ী হিসেবে তারা সব ক্রেডিট একাই নিয়ে থাকেন।

আমরা সবাই ফিনিস প্রোডাক্ট দেখতে চাই। কিন্তু কেউ কী কখনো ভেবেছেন, এই পণ্য তৈরির পেছনে কী পরিমাণ অর্থ ও একটি বিশাল সংগঠন জড়িত? আকাশের লাখ লাখ তারার মাঝে চাঁদ কিন্তু আমরা একটিই দেখতে পাই। তেমনই কোটি কোটি মানুষের ভিড়ে খুবই সামান্য তারকার জন্ম হয় বা প্রতিভার বিকাশ ঘটে। যা আমরা দেখতে পাই খেলার মাঠ, টেনিস কোর্ট, সিনেমার পর্দা বা স্টকহোমের সিটি হলে (যাঁরা নোবেল বিজয়ী)।

বিশ্বের মানব জাতির মাঝে যারা খেলাধুলার জন্য ত্যাগ স্বীকার করা থেকে শুরু করে তাদের জীবন উৎসর্গ ও বিসর্জন দিয়েছেন, সংখ্যায় তাঁরা কিন্তু খুবই কম। তবে ভোগকারীদের সংখ্যা যেমন বেশি তেমন দর্শকের সংখ্যাও বেশি। তাইতো দেখা যায় খোলা মাঠ, টেনিস কোর্ট বা সিনেমা হলে কিছু সীমিত লোকের ক্রিয়াকলাপ বা বিনোদন দেখার জন্য জমা হয় হাজারো লোক। খেলাধুলার জগতে একটি জিনিসের প্রচুর মিল রয়েছে তা হলো কঠিন পরিশ্রম ও ত্যাগ স্বীকার করা। সে যে খেলাই হোক না কেন।

আমি লিখব বা বর্ণনা করব আমার ছেলে ও মেয়ের টেনিস খেলার ওপর। তাদের প্রস্তুতি শুরু থেকে আজ অবধি একজন ক্রম পরিণত তারকা হিসেবে তাদের বর্তমান প্রগতিশীলতার ওপর। ফার্মাসিউটিক্যালস ইন্ডাস্ট্রির উৎপাদন বিভাগের পরিচালক হিসেবে আমার কর্মস্থল স্ট্রেংনেছে। এর অবস্থান সুইডেনের রাজধানী স্টকহোম থেকে ৮০ কিলোমিটার দুরে। মারিয়া আমার স্ত্রী। সেও চাকরি করে ফার্মাসিউটিক্যালসে একজন অ্যানালিটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে। কোম্পানি তাঁকেও পোস্টিং দিয়েছে একই শহরে।

আমাদের সন্তান জনাথানের বয়স তখন পাঁচ বছর। সে কিন্ডারগার্টেনে যায়। সেখানে লেখাপড়ার সঙ্গে ফুটবল ও হকি নিয়েই সে ব্যস্ত। চলছে তার দিনকাল ভালোই। ছোট্ট শহরে এসেই মারিয়া বায়না ধরল, সে আরেকটি বাচ্চা নিতে চায়। আমি আমার কাজের কারণে তখন দেশের বাইরে থাকি বেশির ভাগ সময়। তাঁর এই বায়নার কারণ হয়তো তার কিছুটা একাকিত্ব ও জনাথনের জন্য ভালো হবে বাড়িতে আরেকটি বাচ্চা থাকলে!

এরপর আমার মেয়ে জেসিকার জন্ম হলো। মারিয়া প্যারেন্টাল লিভে বাচ্চাদের নিয়ে বাসাতে আর আমি আমার কাজে। চলছে আমাদের জীবন ভালোই। মারিয়া জেসিকাকে স্ট্রলে করে সঙ্গে নিয়ে জনাথানকে স্কুল থেকে আনা নেওয়া করে। একদিন পথে আসতে ঘটল এক অলৌকিক ঘটনা। হঠাৎ করে একটি কাগজ উড়তে উড়তে এসে পড়ল জেসিকার স্ট্রলারের ওপরে। মারিয়া কাগজটি পড়ে দেখে, লেখা রয়েছে বিনা মূল্যে তিন দিন টেনিস প্রশিক্ষণের সুযোগ। বয়স ৫-৭ বছর হতে হবে। সামনেই ভিসহোলমেন লেকের ধারে টেনিসের ক্লাব।

মারিয়া জনাথানকে জিজ্ঞাসা করল, বাবা তুমি কি চেষ্টা করতে চাও?
জনাথান একবাক্যে উত্তর দিল, হ্যাঁ মা, আমি চেষ্টা করতে চাই।
তারপর তারা সঙ্গে সঙ্গে চলে গেল। ট্রেনারের সঙ্গে দেখা মিলতেই খেলার সুযোগ মিলে গেল।
সেদিন ছিল মঙ্গলবার, ৫ জুন ২০০১ সাল। সেই চেষ্টা থেকে জনাথান মৃধা আজ একজন উঠতি তারকা। জনাথান নিজেকে প্রস্তুত করছে সেই ফিনিশ প্রোডাক্ট হওয়ার জন্য। জনাথান তার শুরুর প্রথম তিন দিন টেনিস খেলার সুযোগ তৈরি করেছিল ভালো লাগা ধেকে। আর সেই থেকে মেধা ও বয়সভিত্তিক সুইডেনের সেরা টেনিস খেলোয়াড় হিসেবে প্রথম স্থানটি সে তার দখলে রেখে নতুন চ্যালেঞ্জের পথে বিশ্বের সেরা ১০০ জনের মধ্যে আসার লক্ষ্যে চালিয়ে যাচ্ছে তার কঠিন প্রশিক্ষণ। ‘প্র্যাকটিস মেকস এ ম্যান পারফেক্ট’, টেনিসের জগতেও এটা খুবই সত্যি। জনাথান বর্তমান বিশ্বের ৫০০ জনের মধ্যে রয়েছে এবং সে তার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে কাজ করে চলছে।
জেসিকাও ঠিক তার ছয় বছর বয়সে হঠাৎ তার মাকে বলেছিল, মা আমিও টেনিস খেলতে চাই।

হয়তো বা ভাইয়ের প্রতিভা ও অনুপ্রেরণা তাকেও টেনিসের জগতে আনতে সাহায্য করেছিল সেদিন। জেসিকাও ঠিক ভালো লাগা আর ভালো লাগা থেকে ভালোবাসা এই কনসেপ্টের মধ্য দিয়েই শুরু করেছিল তার টেনিস প্রশিক্ষণ। সেও তার বয়সভিত্তিক ও মেধা অনুযায়ী সুইডেনের দ্বিতীয় স্থানটি দখলে রেখেছে। জেসিকা টেনিসের সঙ্গে তার লেখাপড়াও শেষ করতে চায়। তাই পেশাদারির পথটা এখনো ঠিক করেনি। তবে সে নিয়মিত লেখাপড়ার সঙ্গে প্রশিক্ষণ চালিয়ে যাচ্ছে।
মনে হচ্ছে এ এক শেষ না হওয়া প্রক্রিয়া বা নেভার এন্ডিং প্রসেস। শেষ সেদিন হবে যেদিন তারা টেনিসের জগৎ থেকে অবসর নেবে। তার আগ পর্যন্ত এটা একটি অন গোয়িং ডেভেলপমেন্ট প্রসেস। শুরু থেকে শেষ এবং কী হবে না হবে তা জানি না। তবে চলতে থাকবে এ যাত্রা। বাঙালির রক্ত বইছে তাদের শরীরে। তাই আমার আনন্দ, বুকভরা ভালোবাসা আর প্রাণভরা আশা, একদিন হয়তো বিশ্ব টেনিসের জগতে উড়বে লাল সবুজের পতাকা।
...

রহমান মৃধা: সুইডেন।
ইমেইল: <[email protected]>