বিশ্বায়নে বাঙালির নববর্ষ

প্রতিবছর ডিসেম্বর মাসের শেষের দিনটি শেষ হতেই শুরু হয় ইংরেজি নতুন বছরকে বরণ করার প্রস্তুতি পর্ব। সুইডেনে নববর্ষ উদ্‌যাপন বা ‘ny rsfirande’ দিনটিকে বিদায় দিয়ে নতুন বছরের নতুন দিনটিকে বরণ করার জন্য কত কিছুই না ঘটে। দিনের শেষে বরফের দেশে ঘরে–বাইরে সবখানেই প্রতীক্ষা, অপেক্ষা, চাওয়া–পাওয়া, দেওয়া–নেওয়ার পালা। কখন ঘড়ির কাঁটায় রাত ১২টা বাজবে, কখন ঘণ্টা বাজবে আর কখন শ্যাম্পেনের (champagne) বোতল খুলে নববর্ষ দিবসে চিয়ার্স (skål för nyårsdag) বলতে হবে, সেই প্রতীক্ষায় আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা। হঠাৎ যখন সেই সময়টি এসে হাজির হলো, ঠিক তখনই ঘরে–বাইরে, ডিস্কটেকে বিখ্যাত আব্বার (ABBA) গান বেজে উঠতেই বন্ধু তার বান্ধবী, প্রিয় তার প্রিয়ার, স্বামী তার স্ত্রীর গা জড়িয়ে ধরে গাইতে শুরু করে ‘No more champagne, Here we are, me and you, Feeling lost and feeling blue, It's the end of the party, And the morning seems so grey, So unlike yesterday, Now's the time for us to say, Happy New Year’ পরে রাত কখন শেষ হয়ে সকাল হয়, সে খেয়াল আর থাকে না। কখন কে কোথায় এবং কীভাবে ঘুমিয়ে আছে, তা কি জানার দরকার আছে? এই হচ্ছে এখানকার নববর্ষ উদ্‌যাপন, কিন্তু এর বাইরেও যে জগৎ আছে, তা এদের অনেকে জানলেও আমার মতো উপলব্ধি করার সৌভাগ্য হবে বা হয়েছে বলে মনে হয় না।

ইংরেজি বছরের মতো নতুন করে পয়লা বৈশাখ প্রতিবছরই আসে। বহু দিন, বহু মাস, বহু বছর যে দিনটি আগে এসেছে, তা আবার ঘুরেফিরে হাজির হয়েছে কিছুটা পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে এবং ফিরে এসেছে কোটি কোটি বাঙালির হৃদয়ে নতুন করে সেই দিনপঞ্জিকাটিতে। পয়লা বৈশাখের প্রভাতে উদীয়মান সূর্যকে স্বাগত জানানোর মধ্য দিয়ে শুরু হয় নববর্ষের উৎসব। এ সময় নতুন সূর্যকে প্রত্যক্ষ করতে উদ্যানের কোনো বৃহৎ বৃক্ষমূলে বা লেকের ধারে অতি প্রত্যুষে নগরবাসী সমবেত হয়।
এসো হে বৈশাখ এসো এসো। পুরাতনের বিদায়, নতুনের আগমনে আশা ভরসা ভালোবাসার স্বপ্ন ঘুরঘুর করছে চারপাশে। মনে হচ্ছে পরিবর্তন হবে, কিন্তু কিসের? ভাগ্যের! খুশিতে চোখে জল আসছে। ভাবি, এ কিসের জল? নতুন কিছু পাওয়ার? নাকি হারানোর!

নতুন বছর মানেই সবার কাছে নতুন দিনের প্রেরণা, নতুনভাবে জেগে ওঠার কল্পনা। অচেনা–অজানার বিরুদ্ধে নতুন করে লড়াই করার স্বপ্ন দেখা। তাই পুরোনো দিনের গ্লানি ভুলে নতুনভাবে সামনে এগিয়ে যাওয়ার তাগিদেই এ দিনটিকে আপন করে নিতে এত আয়োজন।

বাংলা নববর্ষ বা পয়লা বৈশাখ উদ্‌যাপন বাঙালির প্রাচীনতম ঐতিহ্য। জাতি-ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে বাংলাদেশে এ নববর্ষ উদ্‌যাপন পরিণত হয়েছে সর্বজনীন উৎসবে। আবহমানকাল ধরে বাংলার ঘরে ঘরে উদ্‌যাপিত হচ্ছে বর্ষবরণের উৎসব।

হিন্দু-মুসলিম, বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান তথা বাঙালি জাতির একান্ত এ উৎসবে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করে আসছে সবাই। বাংলার কৃষিভিত্তিক গ্রামীণ সমাজে নতুন ফসলকে কেন্দ্র করে যে উৎসবের সূচনা, কালক্রমে সেটাই পরিণত হয়েছে নববর্ষ বরণ উৎসবে। শতাব্দীর পর শতাব্দী পার হয়েছে, বহুবার বদল হয়েছে শাসকের, কিন্তু বৈশাখ চিরন্তন উৎসবের রূপে জড়িয়ে রেখেছে বাংলার জনপদকে।

শহরে বৈশাখ যে ব্যাপক উৎসবের উপলক্ষ নিয়ে আসে, গ্রামীণ জীবনে তার আমেজ ভিন্ন। নগরজীবনে এদিন যেমন পান্তা-ইলিশ খাওয়ার ধুম পড়ে যায়, তেমনি যুক্ত হয় নতুন কাপড় পরার আয়োজনও। গ্রামবাংলায় সকালবেলা দই-চিড়া দিয়ে অতিথি আপ্যায়ন করার রেওয়াজ ছিল।

ব্যবসায়ীরা দোকানে দোকানে হালখাতার আনুষ্ঠানিকতায় মিষ্টি দিয়ে তাঁদের ক্রেতাদের স্বাগত জানাতেন। কালের বিবর্তনে নববর্ষের সঙ্গে সম্পর্কিত অনেক পুরোনো উৎসবের বিলুপ্তি ঘটেছে, আবার সংযোগ ঘটেছে অনেক নতুন উৎসবের। আমার ছোটবেলার দিনগুলোতে ঘোড়দৌড়ের প্রতিযোগিতা ছিল এক অত্যন্ত জাঁকজমকপূর্ণ বিনোদন।

পয়লা বৈশাখের প্রভাতে উদীয়মান সূর্যকে স্বাগত জানানোর মধ্য দিয়ে শুরু হতো নববর্ষের উৎসব। নববর্ষকে স্বাগত জানিয়ে শিল্পীরা সংগীত পরিবেশন করতেন। এদিন সাধারণত সব শ্রেণির এবং সব বয়সের মানুষ ঐতিহ্যবাহী বাঙালি পোশাক পরিধান করে।

নববর্ষকে স্বাগত জানাতে তরুণীরা লালপেড়ে সাদা শাড়ি, হাতে চুড়ি, খোঁপায় ফুল, গলায় ফুলের মালা এবং কপালে টিপ পরে, আর ছেলেরা পরে পায়জামা ও পাঞ্জাবি। কেউ কেউ ধুতি-পাঞ্জাবিও পরে।

বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যবসায়ীরা দিনটি নতুনভাবে ব্যবসা শুরু করার উপলক্ষ হিসেবে বরণ করে নেন। এ উৎসব শোভাযাত্রা, মেলা, হালখাতা খোলা ইত্যাদি বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে উদ্‌যাপিত হয়। এখনকার দিনে সকালবেলা পান্তা ভাত খাওয়া একটি ফ্যাশনে পরিণত হয়েছে, সঙ্গে থাকে ইলিশ মাছ ভাজা। এবার রোজার কারণে সকালে হয়তো সেটা খাওয়া হবে না, তবে ভোররাতে পান্তা ইলিশ খেয়ে রোজা এবং নববর্ষ উৎসব একসঙ্গে উদ্‌যাপন করা যেতেই পারে। নববর্ষ উদ্‌যাপান বাঙালির একটি সর্বজনীন লোক–উৎসব। এদিন আনন্দঘন পরিবেশে বরণ করে নেওয়া হয় নতুন বছরকে। কল্যাণ ও নতুন জীবনের প্রতীক হলো নববর্ষ। অতীতের ভুলত্রুটি ও ব্যর্থতার গ্লানি ভুলে নতুন করে সুখ-শান্তি ও সমৃদ্ধি কামনায় উদ্‌যাপিত হয় নববর্ষ।

এভাবে লোকজ বর্ষবরণ প্রথাগুলোর কোনো কোনোটির অনুসরণের মাধ্যমে হয়তোবা গ্রামীণ ঐতিহ্য অনেকটা সংরক্ষিত হচ্ছে। ভাবনাতে ঢুকেছে সেই ফেলে আসা ছোটবেলার দিনগুলোর কথা, সেই হালখাতার কথা। একই সঙ্গে বড় ইচ্ছা করছে ভাবতে বাংলাদেশকে যদি স্পেন বা সুইডেনের মতো করে গড়তে পারতাম।

যেখানে রয়েছে গণতন্ত্রের পরিকাঠামো মজবুত, যা সহজে নড়চড় হয় না। যেখানে রয়েছে মানুষের প্রতি মানুষের বিশ্বাস, যা সহজে ভঙ্গ হয় না। যেখানে রয়েছে সাগরের ঢেউ, যা এদের মনকে উদার করেছে। যেখানে রয়েছে সুশিক্ষা, সুস্বাস্থ্য, অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থানের নিরাপত্তা।

এখানে প্রতিবছরের মতো নতুন বছর আসে এবং তা মধুময় স্মৃতি হয়ে ইতিহাসের পাতায় সাক্ষী হয়ে থাকে। আজ আমি তেমন একটি দেশে বসে কবিগুরুর কথায় ভাবছি ‘মানবের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই।’ আমার ভাবনায় ঠিক এমন একটি পয়লা বৈশাখ দেখার ইচ্ছা জেগেছে।

বাংলাদেশে কবে আসবে এমন একটি পয়লা বৈশাখ? কবে সম্ভব হবে তা বাস্তবে রূপ দেওয়ার? কবে গাইবে গান সেই রমনা পার্কের বটতলায় সবাই মিলে, যেখানে থাকবে না দিনের আলোয় এক অন্ধকার ভরা পয়লা বৈশাখ।

এবারের পয়লা বৈশাখ হতে পারে কি ভবিষ্যৎ নির্মাণের চাবিকাঠি, যা সবার জন্য বয়ে আনবে ভালোবাসা। বাংলা নববর্ষের ঐতিহ্যবাহী শুভেচ্ছা বাক্য হলো ‘শুভ নববর্ষ’। সবাইকে নববর্ষের প্রাণঢালা শুভেচ্ছা ও ভালোবাসা।