বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক খুন এবং শ্রেণিবৈষম্য
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আবাসন প্রকল্পের ভেতরে খুন হওয়া সাবেক অধ্যাপক সাইদা গাফফারের (৭১) লাশ উদ্ধার নিয়ে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রতিবেদন এসেছে। পুলিশ জেনেছে, মাত্র ১০ হাজার টাকার জন্য তাঁকে খুন করেন তাঁরই বাসা তৈরির কাজের মিস্ত্রি মো. আনারুল ইসলাম (২৫)।
এ ঘটনা একটা সাধারণ খুনের ঘটনা হিসেবে দেখার কোনো সুযোগ নেই। খুবই দুঃখের বিষয় হচ্ছে, এ খুনের পেছনে ব্যক্তিগত কোনো বিরোধ নেই এবং টাকার অঙ্কটাও তেমন আহামরি কিছু নয়। আমার মনে হয়, সরকার, প্রশাসন ও বুদ্ধিজীবীদের এ ঘটনা খুবই গুরুত্বসহকারে দেখা উচিত। এর পেছনের কারণ হচ্ছে শ্রমজীবী একজন মানুষ যখন কিছু টাকার জন্য তাঁর মনিবকে খুন করে ফেলেন ব্যক্তিগত কোনো বিরোধ ছাড়াই, তখন বুঝতে হবে, সেই সমাজে শ্রেণিবৈষম্য চরম আকার ধারণ করেছে।
আমরা যদি বিগত বছরগুলোর পত্রিকাগুলো ঘেঁটে দেখি, তাহলে দেখা যাবে, এ রকম ঘটনা বেশ কয়েকবার ঘটেছে। নিজের কাছের কাজের মানুষগুলোই এ রকম কাজগুলো করছেন শুধু কিছু অর্থের জন্য। একটা সমাজে শ্রমজীবী মানুষ যখন এ ধরনের কাজ করেন, তখন সেটা অবশ্যই সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে গবেষণার দাবি রাখে। আর এ রকম অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনা আমাদের পরিবারের যে কারও সঙ্গে হতে পারে; বিশেষ করে আমরা যাঁরা সমাজে আর্থিক দিক থেকে ভালো অবস্থানে আছি। আমাদের নিজেদের সুরক্ষার জন্যই সমাজের এই শ্রেণিবৈষম্য কমাতে হবে, আর তা না হলে আমরা এ রকম কল্পনার বাইরে কোনোরকম শত্রুতা ছাড়াই জীবন হারাব অথবা আমাদের কাছের কাউকে কিছু অর্থের জন্য হত্যা করা হবে।
একটা শহরে যেখানে আমি–আপনি ৫০ হাজার টাকা রোজগার করে জীবন চালাতে হিমশিম খাই, সেখানে কীভাবে আশা করি, একজন শ্রমিক ৭ থেকে ১০ হাজার টাকা রোজগার করে সেই শহরেই সংসার চালাতে পারবে? শুধু এ কাজের লোকের হাতে মৃত্যুর ঘটনা নয়, আমরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যকেও অর্থের অভাবে আত্মহত্যা করতে দেখেছি। দেশের জিডিপি বেড়েছে—কোনো সন্দেহ নেই, কিন্তু জিডিপির বণ্টন কি সঠিক উপায়ে হচ্ছে? মানুষ কি তাঁর প্রাপ্য মজুরি পাচ্ছেন? যদি সেটা দেওয়া না যায়, তাহলে প্রতিদিনের জীবন ধারণের জন্য যে ব্যয়, সেটা আয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্য করতে হবে এবং সেটা করা সম্ভব। প্রতিটি পণ্য ব্যবসায়ের পেছনে রয়েছে বিশাল সিন্ডিকেট, যাদের একমাত্র কাজই অধিক মূল্যে পণ্য বিক্রি করে মুনাফা অর্জন। এই সিন্ডিকেট ভেঙে নতুনদের হাতে ব্যবসা সহজ করে দেওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।
দুই দিক থেকে যদি সাধারণ মানুষকে চাপে রাখা হয়, তাহলে আমরা ধনী শ্রেণিরাই শেষমেশ বিপদে পড়ব। কারণ, তাঁরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। আমার মনে হয়, সমাজে আমাদের মতো মানুষদের ওপর শ্রেণিবৈষম্যের কারণে দিনকে দিন বিদ্বেষ বাড়ছে। এখন আর দেখা হচ্ছে না—কে ভালো আর কে মন্দ। এরই প্রমাণ বিগত বছরগুলোতে কাজের লোকের হাতে অল্প কিছু অর্থের জন্য শিক্ষকদের খুন হওয়া।
দয়া করে চোখ খোলার চেষ্টা করুন। জীবন না বাঁচলে অর্থ দিয়ে কী করবেন? অতিসত্বর নতুনদের ব্যবসায় স্বাগত জানানো উচিত এবং তার সঙ্গে ন্যূনতম বেতন কাঠামো ঠিক করে দেওয়াও উচিত। গাড়ির প্রতি কিলোমিটার সচিবেরা মিটিং করে ভাড়া ঠিক করে দিতে পারেন, কিন্তু রিকশাচালকদের ভাড়া কেন ঠিক করে দেওয়া হয় না? তাঁরা কীভাবে জীবন ধারণ করবেন? দিনমজুর কীভাবে জীবন ধারণ করবেন? এই খরুচে শহরে তাঁদের দিকে চোখ বন্ধ করে থাকলে কি সমস্যা সমাধান হয়ে যাবে? তাঁরা কিন্তু ঠিকই সমাজের জন্য ‘টাইম বোমা’ হয়ে টিকটিক করে বিস্ফোরণ হওয়ার জন্য সময় গুনছে।
জিডিপিকে মাথায় রেখে অবশ্যই সুন্দর বেতন কাঠামো দেশজুড়ে ঠিক করা সম্ভব। ছাত্রছাত্রীরা ব্যবসায় প্রশাসন থেকে পাস করলে সনদ দেওয়ার আগে দেওয়া উচিত ট্রেড লাইসেন্স এবং তাঁদের ব্যবসায়ের জন্য সুদমুক্ত ঋণ সঙ্গে কম করে হলেও পাঁচ বছরের ট্যাক্স মওকুফ করা উচিত।
ব্যবসায় সহজ ব্যবস্থা এবং নতুনদের ব্যবসায় অনুপ্রেরণা না দিলে শুধু বিসিএস দিয়ে দেশের অভুক্ত পেটে আহার দেওয়া সম্ভব নয়। কাজেই, অনুরোধ থাকবে এ ঘটনাটাসহ আগের যতগুলো অর্থের অভাবে হত্যা ও আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে, সেগুলো যেন কোনোভাবেই বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে না দেখা হয়। বরং অভাব কীভাবে এসব ঘটনার সঙ্গে যোগসূত্র স্থাপন করেছে, তার বিশ্লেষণ করে দেখাই হবে বুদ্ধিমানের কাজ।
*লেখক: নুরজ্জামান খান, পিএইচডি গবেষক এবং শিক্ষক, হাঙ্গেরিয়ান ইউনিভার্সিটি অব ফাইন আর্টস