
১৯৭০ সাল। আব্বার চাকরির সুবাদে আমরা তখন থাকি কুমিল্লায়। আমাদের বাসাটা কুমিল্লা শহরের গা ঘেঁষে বয়ে চলা প্রমত্তা গোমতী নদীকে বশে আনতে যে বাঁধ দেওয়া হয়েছে, তার একেবারে কিনারে। আর জজকোর্ট ছিল আমাদের পাড়াতেই। কোর্টে সারা দিন হরেক রকম মানুষের আনাগোনা। বিকেল চারটার পর কোর্ট বন্ধ হলে এই এলাকায় নেমে আসে এক নীরবতা। কোর্ট ভবনের পেছন দিকে যেখানে জজ সাহেবদের খাসকামরা, তার ঠিক উল্টো দিকে খুব যত্ন করে বাগান করা। বাগানের মাঝখান দিয়ে জজ সাহেবদের খাসকামরায় আসার সরু পিচ ঢালা রাস্তা। কোর্টের সময় শেষ হলে দারোয়ানরা কোর্ট চত্বরের চারদিকে সব গেটে তালা দিয়ে দেয়।
আমরা বেশ কিছু সিক্স আর সেভেনে পড়া বালক বিকেলে খেলার পর অথবা স্কুলের ছুটিতে কোর্টের গেট টপকিয়ে জজ সাহেবদের খাসকামরার সিঁড়িতে বসে আড্ডা দিই। জায়গাটি আমাদের আড্ডার জন্য আদর্শ। বাইরে থেকে কেউ আমাদের আঁচ করতে পারত না। কোর্টের দারোয়ানেরা স্থানীয়, অনেকেই আমাদের চিনত, তাই কিছু বলত না। আমাদের গোপন আড্ডায় কোনো রাজনীতি থাকত না, তবে সদ্য গোঁফ গজানো বালকদের আড্ডায় বিরাট অংশ দখল করে নিত সেক্সবিষয়ক আলাপচারিতা। আমাদের মাঝে এই আলোচনার পথিকৃৎ ছিল আমাদের চেয়ে বয়সে বড় কয়েক দফা একই ক্লাসে ফেল করা আকরাম। ও কেমন করে যেন একটা চটি বই জোগাড় করে নিয়ে এল। বইটির নাম ছিল গরম বালিশ। জীবনে প্রথমবার রতিক্রিয়ারত নরনারীর সাদা–কালো ছবি দেখে আমরা ভীষণভাবে পুলকিত। আমাদের প্রতিদিনের আড্ডা যখন জমজমাট তখন এক দিন সেখানে এসে হাজির নোমান ভাই। ঘোষণা দিলেন, এখানে আড্ডা দেওয়া চলবে না। আমরা একটা ক্লাব করব। সবাইকে সেটার মেম্বার হয়ে কাজ করতে হবে।
নোমান ভাই ছিলেন আমাদের পাড়ার বড় ভাই আর লিডার, আর আমরা তাঁর চেলা। বাবার একমাত্র সন্তান। তিনি ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করে সদ্য ঢাকা ভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছেন। নোমান ভাই ঢাকা থেকে এলে আমরা সারা দিন তাঁর সঙ্গে আঠার মতো লেগে থাকতাম। তিনি আমাদের ঢাকার নাজ সিনেমা হলে দেখা বিভিন্ন ইংরেজি ছবির গল্প শোনাতেন। তাঁর উদ্যোগে আমাদের পাড়ায় প্রথম ক্লাব প্রতিষ্ঠা হলো। ক্লাবের নাম রাখা হলো ‘বৈকালী’।
আমাদের পাড়ার অন্যতম সমাজসেবী ছিলেন কফিলউদ্দিন সাহেব। পেশায় উকিল। তাঁর বাসার পাশেই ছিল বেশ বড় সাইজের এক টুকরো খোলা মাঠ, যার মালিকও ছিলেন তিনি। মাঠের চারপাশে লাইন করে লাগানো ছিল সুপারিগাছ। আমরা সেই মাঠে কখনো ফুটবল খেলতাম, কখনো এক কোনায় বসে আড্ডা দিতাম। তিনি কফিল সাহেবকে গিয়ে ধরলেন তাঁর মাঠটিতে আমাদের ক্লাবঘরের জন্য জায়গা দিতে। কফিল সাহেব শুধু জায়গা দিলেন না, আমাদের ক্লাবের ফান্ডে কিছু টাকাও দিলেন। বিনিময়ে আমরা তাঁকে ক্লাবের উপদেষ্টা করলাম।
নোমান ভাই পাড়ার আরও কয়েকজনকে ধরে একটা টিনের ঘর তৈরির পয়সা সংগ্রহ করে ফেলেন। আমার আব্বা বইপাগল মানুষ। ক্লাবে বেশ কিছু নিজের বই দান করে আমাদের একটা লাইব্রেরি করে দিলেন। ওই লাইব্রেরিতে তিনি যাযাবরের দৃষ্টিপাত বইটির একাধিক কপি দিয়েছিলেন। এটি ছিল তাঁর একটি প্রিয় বই। আমি বইটি একাধিকবার পড়েছি। পাড়ার আরও কয়েকজনের কাছ থেকে আমরা আরও কিছু বই সংগ্রহ করেছিলাম। একটি রেজিস্টারে সই করে আমরা বই নিতাম। অল্প দিনেই আমাদের ক্লাবের খুব জমজমাট হয়ে উঠল। ফুটবল ছাড়াও আমরা শীতের সময় ক্রিকেট খেলতাম। ক্লাবে ক্যারম বোর্ড কেনা হয়েছিল। আমাদের ক্লাব সারাক্ষণ খুব জমজমাট থাকত। ডিসেম্বর মাসে স্কুলের বার্ষিক পরীক্ষার পর ঠিক হলো, পাড়ায় নাটক হবে। যুবকেরা নাটকে চান্স পেল, আমরা বালকেরা বাদ। তবু নিয়ম করে ক্লাবঘরে নাটকের রিহার্সাল দেখতে হাজির হই। নাটকে মেয়ে চরিত্রে অভিনয়ের জন্য একজন প্রফেশনাল মেয়ে আর্টিস্টকে ভাড়া করা হয়। একটি দৃশ্য ছিল যেখানে ভাই মারা যাচ্ছে, বোন দৌড়ে এসে ভাইয়ের বুকের ওপর ‘ভাইয়া, এ হতে পারে না’ বলে ভাইকে জড়িয়ে ধরবে। যথারীতি বোন ডায়ালগ বলে ভাইকে জড়িয়ে ধরলও। পরমুহূর্তেই ডায়ালগ বন্ধ করে বোন দাঁড়িয়ে পড়ল, কান্না কান্না কণ্ঠে বলতে লাগল, ‘সব অসভ্য, আমি আর এই নাটকে অভিনয় করব না বলেই তার ভ্যানিটি ব্যাগটা নিয়ে ঘর থেকে ছুটে বেরিয়ে গেল। সেদিন বুঝতে পারিনি কী হয়েছিল, আজ সেই দৃশ্যটি মনে করে মনে মনে হাসি।’
১৯৭১ সালের মার্চ মাস থেকে আমাদের ক্লাবটি ভিন্ন রূপ নিল। দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি বদলে দিল আমাদের ক্লাবের কার্যক্রম। প্রতিদিন খেলার সঙ্গে চলতে থাকল রাজনৈতিক আলোচনা। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণে ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ার কথা উদ্বুদ্ধ হয়ে আমাদের ক্লাবের উদ্যোগে গঠিত হলো স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী। আমরা কাঠ দিয়ে নকল রাইফেল বানিয়ে বিকেলে প্যারেড করতাম। ভার্সিটি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় নোমান ভাই ঢাকা থেকে চলে এলেন। সঙ্গে আনলেন বাংলাদেশের নতুন পতাকা, গাঢ় সবুজের মাঝে লাল রঙের সূর্য, সূর্যের মাঝখানে বাংলাদেশের ম্যাপ। পতাকাটা আমাকে খুব আকৃষ্ট করেছিল। আমার উত্তেজনা দেখে কে? আমি নোমান ভাইয়ের কাছ থেকে পতাকাটি নিয়ে চলে গেলাম আমাদের পাড়ার মোড়ে ‘ভাই ভাই’ টেইলারিংয়ে। টেইলারিংয়ের দোকানে কাপড়ও বিক্রি করত। পতাকাটি বানাতে ঠিক কত টাকা খরচ হয়েছিল আমার মনে নেই, তবে মায়ের কাছ থেকে টাকা নিয়ে সন্ধ্যার মধ্যে পতাকাটি নিয়ে বাসায় চলে এলাম। আমাদের বাসার সামনে রাতেই উড়িয়ে দিলাম স্বাধীন বাংলার পতাকা।
২৫ মার্চের রাতে ঢাকার সঙ্গে একযোগে হানাদার বাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়ল কুমিল্লা শহরে। আক্রান্ত হলো পুলিশ লাইনস। সারা রাত চলল ব্যাপক গোলাগুলি। সবার মতো আমরাও বুঝতে পারছি না কী হতে যাচ্ছে। সকাল হতে না–হতেই আমাদের পাশের বাড়ির ডাক্তার সাহেব আব্বাকে এসে বললেন, এক্ষুনি পতাকাটা নামান। তিনি রাগ হয়ে বললেন, ‘এই পতাকার জন্যই আমাদের মরতে হবে।’ আব্বা বাইরে গিয়ে পতাকাটা নামিয়ে নিয়ে এলেন। আমি খুব কষ্ট পেলাম। চোখ বেয়ে পানি পড়তে লাগল। পতাকাটি আব্বা আমাকেই দিলেন। আমি সেটাকে আমার বইয়ের র্যাকের এক পাশে ভাঁজ করে রাখলাম।
কিছুদিনের মধ্যেই পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে লাগল। আমরা স্কুল যাওয়া প্রায় বন্ধই করে দিলাম। প্রায় সারা দিন বাসাতেই থাকতাম। কানের সঙ্গে লাগিয়ে রেডিওতে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র শুনতাম। পাকিস্তানি বাহিনী হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজনকে নির্বিচারে হত্যা করতে লাগল। কুমিল্লা শহরে অনেক হিন্দুকে ধরে নিয়ে গেল। কোনো কোনো হিন্দুকে বাসার সামনে লাইন করে দাঁড় করিয়ে ব্রাশফায়ার করে মারা হলো। গোমতী পার হয়ে বিবির বাজার বর্ডার হয়ে সহজেই ভারতে যাওয়া যায়। হিন্দুরা দলে দলে আমাদের বাসার সামনে দিয়ে ভারতে যেতে লাগল। কুমিল্লা শহরে মাঝে মাঝেই মর্টার শেলিং হতো। এপ্রিল মাসের মধ্যেই মুক্তিবাহিনী শহরের দু–একটা অপারেশন চালাল। আমাদের ক্লাবঘরটার পাশেই ছিল পাকিস্তানের সাবেক মন্ত্রী নীল মিয়ার বাড়ি। মুক্তিযোদ্ধারা ওর বাড়িতে গ্রেনেড ছুড়ে মারল। ওই রাতে আমাদের পাড়া ঘেরাও করল পাকিস্তানি সেনারা। সঙ্গে ছিল রাজাকারের দল। নোমান ভাইকে উঠিয়ে নিয়ে গেল তারা। নোমান ভাইয়ের খোঁজে তাঁর বাবা–মা পাগলের মতো আর্মি ক্যাম্পে গিয়ে কান্নাকাটি করতে লাগলেন। কিন্তু নোমান ভাইয়ের কোনো হদিস পাওয়া গেল না। খালাম্মা শান্তি কমিটির লোকদের কাছে কত কান্নাকাটি করেছেন। কোনো লাভ হয়নি। কুমিল্লা শহর থেকে আগরতলা খুব কাছে। নোমান ভাই বারবার আগরতলায় গিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে চেয়েছিলেন। নোমান ভাই বাবার একমাত্র সন্তান ছিলেন, তাই খালাম্মা তাঁকে বাসায় আটকিয়ে রেখেছিলেন। যুদ্ধে যেতে দেননি। আমরা শুনেছিলাম, নোমান ভাই নাকি গোপনে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন।
এদিকে রাজাকার বাহিনী পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে অত্যাচার করা শুরু করল। বাড়ি বাড়ি তল্লাশি চালাতে শুরু করল এরা। বাসার সবাই ভয় পেয়ে গেল। আব্বা বললেন, ‘যেকোনো সময়ে আমাদের বাসা তল্লাশি হতে পারে, তুই পতাকাটা পুড়িয়ে ফেল, না হলে কোথাও ফেলে আয়।’ পতাকাটা ফেলে দিতে হবে বা পুড়িয়ে ফেলতে হবে, এটা আমি ভাবতেও পারছিলাম না। আমি প্রচণ্ড কান্নাকাটি শুরু করলাম। আম্মা আমার অবস্থা দেখে বললেন, ‘এক কাজ কর, পতাকাটা একটা বয়ামে ভরে রাতে মাটির নিচে পুঁতে রাখ।’ আম্মার কথা আমার খুব পছন্দ হলো। আমরা রাতের অন্ধকারে বাসার পেছনে কাঁঠালগাছের নিচে পতাকাটা মাটিতে পুঁতে রাখলাম। যেখানটায় পুঁতলাম সেখানে চিহ্ন হিসেবে একটা গোলাপের ডাল লাগিয়ে দিলাম। নিয়ম করে পানি দিতাম। অল্পদিনেই গোলাপের ডালটিতে পাতাও গজাল। সব দুঃসময়ই একসময় শেষ হয়। ডিসেম্বর মাস থেকেই কুমিল্লা শহরের দৃশ্য পাল্টে যেতে লাগল। আর্মিদের রাস্তায় তেমন একটা দেখা যেত না। রাজাকাররাও কিছু কিছু করে গা ঢাকা দিতে লাগল।
৭ ডিসেম্বর রাতে আমাদের বাসার পাশে গোমতীর বাঁধের ওপার থেকে মুক্তিবাহিনী আর ভারতীয় বাহিনী যৌথভাবে পাকিস্তানি সেনাদের ওপর প্রচণ্ড আক্রমণ চালাল। গোলাগুলি চলল সারা রাত। মর্টার আর কামানের গোলার শোঁ শোঁ শব্দে আমাদের বাসার ওপর দিয়ে যেতে লাগল। আমরা ফ্লোরে শুয়ে বিনিদ্র রজনী কাটালাম। সারা রাতে কী হয়েছে বুঝতে আমাদের কিছুটা সময় লাগল। সকালে খবর পেলাম, কুমিল্লা শহর মুক্ত হয়েছে, পাকিস্তানি সেনারা শহর ছেড়ে পালিয়ে ক্যান্টনমেন্টে আশ্রয় নিয়েছে আর মুক্তিযোদ্ধারা কুমিল্লা শহরের দখল নিয়েছে। ৮ ডিসেম্বর সকালে কুমিল্লা হানাদারমুক্ত হলো। সকাল হওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই দেখলাম, দলে দলে লোকজন রাস্তায় আনন্দ করছে। আমাদের পাড়ার মুক্তিযোদ্ধা শাহজাহান ভাইকে দেখলাম, বীরের মতো দাঁড়িয়ে স্টেনগান দিয়ে আকাশের দিকে ব্রাশফায়ার করছে। সব বন্ধু একত্র হয়ে গেলাম কুমিল্লা এয়ারপোর্টের কাছে। সেখানে পাকিস্তানি সেনারা প্রতিরোধ গড়ার চেষ্টা করছিল। সামনাসামনি যুদ্ধে অনেক পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়েছে। গিয়ে দেখলাম অনেক পাকিস্তানি সেনার মৃতদেহ পড়ে আছে।
বাসায় ফিরে পতাকাটা মাটির নিচ থেকে বের করলাম। ঠিক করলাম পতাকাটাকে আমাদের ক্লাবে ওড়াব।
বিকেলের মধ্যেই সবাই ক্লাবে একত্র হলাম। আমরা পতাকাটা ওড়াব। কিন্তু আমাদের সবার প্রচণ্ড মন খারাপ। আমরা কেউ আগের মতো আনন্দ–উচ্ছল হতে পারছিলাম না। কারণ, যুদ্ধের মাঝামাঝি সময়ে নোমান ভাইকে রাজাকার, আলবদর বাহিনী বাসা থেকে উঠিয়ে নিয়ে গেছে। অনেক চেষ্টা করেও তাঁর আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। আমরা ভারাক্রান্ত হৃদয়ে ক্লাবের সামনে পতাকাটা আকাশে উড়িয়ে দিলাম। সবাই মিলে একসঙ্গে গাইলাম, ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি...।’ সবারই নোমান ভাইয়ের কথা মনে হতে লাগল। আমাদের আনন্দ আর দুঃখ একাকার হয়ে গেল। সবাই কাঁদতে লাগলাম।
ই-মেইল: [email protected]