বাবার কেনা পাঞ্জাবি ও দেশ-বিদেশের ঈদ

ঠিক ১০ বছর আগে ২০০৯ সালে শেষবারের মতো পবিত্র ঈদ উদ্যাপন করি বাংলাদেশে। আজও স্মৃতিগুলো তরতাজা। মনে পড়ে ঈদগাহ থেকে ঈদুল ফিতরের নামাজ আদায় করে বাড়ি ফিরে বাবার পা ধরে সালাম করি। তারপর বাবার সঙ্গে কোলাকুলি করতে গিয়ে চোখ পড়ে বাবার মুখের দিকে। তাঁর মনটা যে ভালো নেই, তা আমার বুঝতে অসুবিধা হয়নি মোটেও। মায়ের পা ছুঁয়ে সালাম করে বাবার মন খারাপের কারণ জানতে চাইলাম। মা জানালেন, বাবা আমার ছোট ভাই অমির জন্য খুব শখ করে একটা পাঞ্জাবি কিনেছেন। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, অমি সে পাঞ্জাবি পরবে না। হালকা গোলাপি রঙের এই পাঞ্জাবি নাকি তার পছন্দ হয়নি।
যা হোক, মাকে বললাম, পাঞ্জাবিটা আমাকে একটু দেখাও না। মা পাঞ্জাবিটা আনলেন। আমি বললাম, বাহ্, সুন্দর তো। তারপর মাকে জানালাম, আমি পাঞ্জাবিটা পরে বাবাকে চমকে দেব। কথামতো আমি বাবার কেনা পাঞ্জাবি পরে বাবার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম।
এখানে উল্লেখ করা দরকার, আমার ছোট ভাই অমি কিন্তু স্বাস্থ্যের দিক দিয়ে আমার থেকে আলহামদুলিল্লাহ দুই গুণের কাছাকাছি। বাবা প্রথমে তাঁর কেনা পাঞ্জাবি আমার পরনে দেখে একটু অবাক হয়ে গেলেন। কারণ, পাঞ্জাবির যা সাইজ, তাতে তা আমার পরনে হওয়ার কথা নয়। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, পাঞ্জাবিটা আমার গায়ে একটু বড় হলেও আমাকে নাকি খুব মানিয়েছিল। বাবা তো খুশিতে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। ওই সময় তাঁর চোখ পানিতে ছলছল করছিল। কারণ, তিনি কষ্ট করে ঈদের বাজারে অনেক দোকান ঘুরে পাঞ্জাবিটা কিনেছিলেন।
সেই সময় আমি প্রথম আলো পত্রিকার সিলেট বিভাগীয় ফটোসাংবাদিক ছিলাম। তাই পেশাগত কারণে সারা দিন বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ওই পাঞ্জাবি পরে অংশগ্রহণ করি। সহকর্মী সাংবাদিকেরা থেকে শুরু করে আত্মীয়স্বজন প্রায় সবাই আব্বার কেনা পাঞ্জাবিটার খুব প্রশংসা করেন।

এটাই ছিল আব্বার সঙ্গে তথা বাংলাদেশে আমার শেষ ঈদ। তার কিছুদিন পর আমি প্রবাস জীবনকে আপন করে পুরোদস্তুর প্রবাসী হয়ে যাই। এরপর এক এক বছর আসতে থাকে, আর পরিবার–পরিজন ছাড়া দুটি করে ঈদ চলে যেতে থাকে। হাজার হাজার মাইল দূরে আপনজন ছাড়া একা একা ঈদ উদ্যাপন করা যে কতটা কষ্টকর, তা ওই পরিস্থিতি যাঁরা পার করেছেন, তাঁরা ছাড়া আর কেউ বুঝবেন না। বিশেষ করে প্রবাসীদের ঈদ একেবারে নিরামিষ অবস্থায় কাটে। সেটা ঈদের জামাত পর্যন্ত। অনেকের আবার কপালে ঈদের জামাতটাও জোটে না। আমি নিশ্চিত বেশির ভাগ প্রবাসীই বাংলাদেশের ঈদকে মিস করেন। কেনই–বা করবেন না, ঈদের সকালে নতুন কাপড় পরে জায়নামাজ হাতে নিয়ে দল বেঁধে ঈদগাহে যাওয়া। নামাজ শেষে সবার সঙ্গে কোলাকুলি করা। তারপর বাড়ি ফিরে বাবা-মাকে পায়ে ধরে সালাম করা। আর মায়ের হাতের মজাদার পায়েস তো আছেই। সব ভাইবোন মিলে একসঙ্গে খাওয়ার মজাই আলাদা। আহ্, এই আনন্দ কোথায় পাওয়া যাবে?
যা হোক, সৃষ্টিকর্তা দীর্ঘদিন আমার থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখলেও এবার মনে হয় আমার দিকে সুনজরে তাকিয়েছেন। শেষ দুই বছরের মধ্যে তিনবার দেশে গেলেও ঈদ করা হয়ে ওঠেনি। তবে আজ আমি যখন এই লেখা লিখছি, তখন বাংলাদেশে ঈদ উদ্যাপনের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করেছি। দ্রুতগতির ট্রেনে চড়ে ঘণ্টাখানেকের মধ্যে আমি যেখানে বাস করি, ফ্রান্সের লরিয়েন্ট শহর থেকে প্যারিসে এসে পৌঁছাব। তার কিছুক্ষণ পর বিমানে চড়ে ছুটব আমার প্রিয় মাতৃভূমির পানে, আমার স্বপ্নের পানে। যেখানে আমার অপেক্ষায় আছেন আমার মা, ভাই-বোন, ভাগনে-ভাগনি, বন্ধুবান্ধবসহ আমার আত্মীয়স্বজন। আর অবশ্যই আমার প্রিয়তমা জীবনসঙ্গিনী। যার অপেক্ষার পালা শেষ হচ্ছে না আমার দেশে আসার খবর শোনার পর থেকেই। আমাদের দুটি মন এক হওয়ার পর এটাই আমাদের প্রথম ঈদ।

ঈদ মানেই আনন্দ। আর আমার এবারের ঈদ আমার জন্য বোনাস হয়ে এসেছে। ভাবতেই অসম্ভব ভালো লাগছে, কয়েক ঘণ্টার মধ্যে আমি দেশের মাটি স্পর্শ করব। দীর্ঘ দশ বছর পর দেশে ঈদ করব। এত আনন্দের মাঝেও বুকের বাঁ পাশে চিনচিন করে ব্যথা অনুভব করছি। আর তা অনুভব করছি আমার প্রাণপ্রিয় বাবার কারণে। বাবা যে আমাকে ছেড়ে সেই ২০১৩ সালে পরপারে পাড়ি জমিয়েছেন। খুব মিস করব বাবাকে। খুব খুব খুব। ঈদগাহ থেকে বাড়ি ফিরে যখন দেখব বাবা নেই, তখন কেমন লাগবে আমার। বাংলাদেশে বাবাহীন প্রথম ঈদ কীভাবে কাটাব আমি। গত দশ বছরে ঈদ উপলক্ষে কখনোই কিছু কেনা হয়নি। কিন্তু এবার পরিকল্পনা করে রেখেছি দেশে এসে সুন্দর দেখে একটা পাঞ্জাবি কিনব। আর তা ঠিকই পরব। কিন্তু আমি কি সেই আনন্দটা পাব, যা বাবার কেনা পাঞ্জাবি পরে পেয়েছিলাম?
চোখ পানিতে ভিজে গেছে। ট্রেনের জানালা দিয়ে সূর্যের আলো এসে পড়ছে মোবাইলের স্ক্রিনে। এরই মাঝে ঘোষণা এল দ্রুতগতির ট্রেনটি প্যারিসের কাছাকাছি চলে এসেছে। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যে নামতে হবে। তারপর ছুটতে হবে প্যারিসের শার্ল দো গোল বিমানবন্দরের উদ্দেশে। এদিকে মনের অজান্তে কানে বারবার আওয়াজ আসছে, ‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এল খুশীর ঈদ’।