বাতাসে নষ্ট গন্ধ

১.

সেই টক টক ঘামের গন্ধ! অরণি বারান্দায় আয়েশ করে খবরের কাগজ পড়তে বসেছিল; দ্বিতীয় পাতায় চোখ রাখতেই সেই নষ্ট গন্ধটা সবকিছু ছাপিয়ে তাকে আচ্ছন্ন করে ফেলল। সকালের ঠান্ডা বাতাসের তাজা গন্ধ; আনকোরা খবরের কাগজের নিউজপ্রিন্টের গন্ধ; সব ছাপিয়ে সেই টক টক ঘামের গন্ধ।

অরণির বমি বমি লাগছে। মা বারান্দায় এসে দেখলেন ও কাগজ হাতে মূর্তির মতো বসে আছে।

 ‘অরণি...কাগজটা দে তো...তোর বাবা উঠেছে...’

মনে হচ্ছে না অরণি শুনেছে; কোনো নড়াচড়া নেই। ‘অরণি...’ কাঁধে হাত রাখতেই অরণি এমন চমকে উঠল যে রাহেলা চমকে গেলেন। মেয়েটার ইদানীং যে কী হয়েছে! খবরের কাগজ নিয়ে ঘরে বিছানায় আধশোয়া নাসের সাহেবকে দিলেন।

—অরুর কী হয়েছে বুঝছি না! সারাক্ষণ গুম হয়ে থাকে।

—এখনকার মেয়েদের বোঝা ভার। কিছুদিন নিজের মতো থাকতে দাও। ঠিক হয়ে যাবে।

নাসের সাহেব কথা সংক্ষেপ করে খবরের শিরোনামে মন দিলেন। দ্বিতীয় পাতায় আসতেই বিড়বিড় করে বললেন, ‘সারা দিন বাসায় বসে থাকলে গুম তো হবেই। এত্তো ভালো চাকরিটা ছেড়ে দিল। এই যে আজ ওর বসকে নিয়ে কাগজে লিখেছে; এমন লোকের সঙ্গে কাজ করার সুযোগ কয়জনের হয়!’

২.

বারবার ফোন আসছে আর অরণি কেটে দিচ্ছে। একটু পরে মেসেজ, ‘প্লিজ ফোনটা ধরো...প্লিজ প্লিজ!’ ইচ্ছা না থাকলেও সে রাহাতের পরের কলটা ধরল; এই ছেলে সহজে হাল ছাড়বে না; ফোন করতেই থাকবে।

—অরু, কেমন আছ?

—ভালো। তুমি?

—আমি আর ভালো কই! তোমাকে সেই কবে থেকে দেখি না।

—খুব বেশি দিন তো না। আর আমাকে দেখার সঙ্গে ভালো থাকার কী সম্পর্ক?

—কী যে বলো না! সাতাশ দিন হয়ে গেল দেখা হচ্ছে না। আজ বিকেলে কী করছ? চলো কোথাও খেতে যাই।

—আজ থাক, শরীরটা ভালো লাগছে না।

—তোমার ইদানীং প্রায়ই শরীর ভালো থাকে না, ডাক্তার দেখিয়েছ? আমি বরং তাহলে বিকেলে বাসায় আসি। তোমাকে দেখে যাই।

—না, না। বাসায় আসতে হবে না। বলো কোথায় দেখা করবে।

রাহাতের সঙ্গে বিকেলটা খারাপ কাটছে না। যদিও অরণির একদমই আসতে ইচ্ছা করছিল না, কিন্তু অনেক দিন পর বাসা থেকে বেরিয়ে ভালো লাগছে। ধানমন্ডি ২৭ নম্বরে রেস্টুরেন্টে খেতে খেতে গল্প করার সময় ওর মনে হচ্ছিল যে সব আগের মতোই আছে, কিচ্ছু বদলায়নি। সন্ধ্যা নামি নামি করছে; মরা বিকেলের বাদামি কমলা-আলোয় অন্য অনেক দিনের মতোই ওরা দুজনে রিকশায় মানিক মিয়া অ্যাভিনিউতে ঘুরতে বেরোল।

রিকশায় এলোমেলো কথা বলতে বলতে রাহাত অরণির পিঠের পেছনে হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরল। অরণি অস্ফুট চিৎকার করে উঠল; রাহাত কিছু বুঝে ওঠার আগেই ধাক্কা দিয়ে হাত সরিয়ে রিকশা থামাতে বলল। অরণি নেমে হনহন করে ফুটপাতে হাঁটছে। বিস্ময়ে রাহাত রিকশা ছেড়ে ওকে ধরার জন্য পিছু ছুটল।

 —অরু, কী হয়েছে? একটু থামো না...বুঝতে পারছি না কী হলো।

রাহাত ওর হাত ধরে থামাতেই ‘তোমরা সব পুরুষেরা একই রকম। গায়ে হাত দেওয়ার সুযোগ খোঁজো...হাত ছাড়ো...খবরদার গায়ে হাত দেবে না!’ অরণি এত্তো চিৎকার করছে যে পরোপকারী পথচারীরা জড়ো হয়ে গেল।

‘আফা, এই লোক কি আপনারে বিরক্ত করতেছে?’ কিছু লোকের চোখেমুখে রসালো গল্পের আশায় আনন্দিত আভা। ‘গায়ে হাত দিছে নাকি? কী করছে ডিটেইলস বলেন...।’ লোকজনের চেঁচামেচিতে অরণির সম্বিৎ ফিরল, ‘ও আমার বয়ফ্রেন্ড...সব ঠিক আছে...আপনারা যান!’ লোকজন পরোপকার করতে না পেরে যারপরনাই বিরক্ত। একজন বলে ওঠে, ‘রাস্তায় এই সব লদকালদকি ক্যান? হোটেল ভাড়া নিয়া মিটমাট কইরা লন...যত্তো সব টাইম নষ্ট!’

—অরু, তোমার কী হয়েছে বল তো?

—কিছু হয়নি...শরীর ভালো লাগছে না। একটা সিএনজি ঠিক করে দাও না প্লিজ! বাসায় যাব।

অরণির ক্লান্ত মুখের দিকে তাকিয়ে রাহাত আর কথা বাড়ায় না। সেই ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময় থেকে ওদের সম্পর্ক; চার বছর হয়ে গেল। রাহাত দুই বছরের সিনিয়র; অরণি মাত্র মাস ছয়েক হলো পাস করেছে। এই পুরো সময়ে রাহাত ওকে কখনো এমন এলোমেলো দেখেনি; মেয়েটা কেমন যেন ভেঙেচুরে গেছে। চাকরিটাও ছেড়ে দিল মাসখানেক হলো। কী হয়েছে অরণির?

৩.

‘স্যার, আসব?’ দরজায় নক করতেই উনি হাসিমুখে তাকালেন। ভারী চশমার পেছনে হাসি হাসি চোখ; অরণির কাছে তো মনে হয় স্বপ্নিল চোখ। ওনার মতো মানুষেরা স্বপ্ন দেখতে পারেন বলেই আজ পৃথিবীটা এমন সুন্দর। ও ভাবেইনি যে প্রথম চাকরি এই মানুষটার সঙ্গে হবে; সেই ছাত্রীজীবন থেকে উনি অরণির রোল মডেল। ইউনিভার্সিটির একই ডিপার্টমেন্টের অ্যালামনাই; কর্মক্ষেত্রে প্রযুক্তি আর বিজ্ঞানের সঙ্গে মানুষকে জুড়ে নিয়েছেন। দেশের সাধারণ মানুষের জন্য সহজলভ্য কম দামি প্রযুক্তি নিয়ে ওনার কোম্পানির কাজ ইতিমধ্যে রাজনৈতিক আর সামাজিক অঙ্গনে তাঁকে আলোচিত আর বিখ্যাত করে তুলেছে।

—স্যার, বলেছিলেন আজ অফিসের পরে নতুন একটা প্রজেক্ট নিয়ে কথা বলবেন। ফ্রি না হলে পরে আসি?

—আরে না...এখন ফ্রি। ছয়টা বেজে গেছে। আজ আর অন্য কাজ না...তোমার সাথে এখন কাজ। চেয়ারে না...আসো সোফায় বসি। সারা দিন চেয়ারে বসে পিঠ ব্যথা হয়ে গেছে।

ওরা সোফায় পাশাপাশি বসতেই সামনের টেবিলে উনি মোটা মোটা কয়েকটা রিপোর্ট এনে রাখলেন।

—তোমাকে ভাবছি আরেকটু বেশি দায়িত্ব দেব। তুমি ভালো কাজ করছ। তোমার পিপল ইন্টারঅ্যাকশন দারুণ!

—থ্যাঙ্ক ইউ স্যার, আই উইল ট্রাই মাই বেস্ট।

—এই প্রজেক্টটার জন্য, উইন নিড সামওন ভেরি লাইকাবল অ্যান্ড অ্যাপ্রোচেবল লাইক ইউ। উই নিড টু আর্ন দ্য ট্রাস্ট অব লোকাল পিপল টু ইমপ্লিমেন্ট ইট।

বলতে বলতে উনি অরণির ঊরুতে হাতের থাবা রাখলেন। ‘নট টু মেনশন অ্যান অ্যাট্রাক্টিভ গার্ল লাইক ইউ ক্যান মেক অ্যানি ম্যান ডু এনিথিং।’

অরণির সামনে এক ক্ষুধার্ত নেকড়ের চোখ; ও কিছু বলার আগেই সেই টক টক ঘামের গন্ধভরা লোকটার পুরু কালো ঠোঁট ওর মুখে সিগারেটের গন্ধ মেখে দিল।

ছাড়ানোর চেষ্টা করতেই লোকটা ওকে ধাক্কা দিয়ে সোফায় শুইয়ে দিল; এক হাতে ওর মুখ চেপে ধরে প্যান্টের জিপার খুলল। অরণি জানে না কতক্ষণ পার হয়েছে; শুধু জানে ওর সারা শরীরে নেকড়ের কামড়; সিগারেটের গন্ধ, লালা আর সেই গন্ধটা। শিকার শেষে সোফায় নির্জীব পড়ে থাকা অরণির কানের কাছে ফিস ফিস করে সে বলেছিল, ‘আমি জানি তুমি চেয়েছিলে!’ 

ঠিক যেমনটা বিয়েবাড়িতে ভরপেট খাওয়ার পরে তৃপ্তির ঢেকুর তোলে মানুষ, সেইভাবে লোকটা বলল, ‘নিচে গাড়ি আছে...ঠিক হয়ে নাও...তোমাকে বাসায় পৌঁছে দেবে। শরীর খারাপ লাগলে কাল এসো না... নো প্রবলেম।’

অরণি টলতে টলতে বেরিয়ে এসেছিল। আর কখনোই অফিসে যায়নি; ই-মেইলে রেজিগনেশন পাঠিয়ে দিয়েছিল। এক মাসের ওপরে হয়ে গেল; অরণির সঙ্গে সব সময় ওই টক টক গন্ধটা থাকে; কোনো কোনো দিন ও কয়েকবার গোসল করে; কিন্তু গন্ধটা একটু সময়ের জন্য চলে গেলেও আবার ফিরে আসে।

প্রতিদিন প্রতি রাতে ওই লোকটা ওর ওপরে ওঠে; অরণি ঘুমের মধ্যে গোঙাতে থাকে। মাঝে মাঝে মা এসে দরজায় ধাক্কা দেয়, ‘কী হলো অরু? ওঠ মা...বোবায় ধরেছে নাকি?’

অরণি জেগে ওঠে; বালিশের নিচে রাখা পকেটছুরি আঁকড়ে ধরে; এই ছুরিটা স্বপ্নে ওর হাতে থাকে না কেন কে জানে!

‘মা ঠিক আছি...উঠে গেছি।’ ঘামে ভিজে চুপচুপে; সারা গায়ে সেই গন্ধ। অরণি উঠে বাথরুমে যায়; চোখেমুখে পানি দেয়। যেদিন গন্ধটা খুব তীব্র হয়, ও আবারও মাঝরাতে গোসল করে। লোকটা আসবে ভেবে ইদানীং ওর ঘুমাতে ভয় হয়; ও ছুরিটা শক্ত করে ধরে সারা রাত বিছানায় বসে থাকে।

৪.

অরণির শরীরটা দিনে দিনে বড্ড খারাপ হয়ে যাচ্ছে; ঠিকমতো ঘুমায় না, খায় না। একটু ঘুমালেই কানের কাছে সে বলে, ‘আমি জানি তুমি চেয়েছিলে’। অনেক ওজন কমে গেছে; চোখের নিচে গর্তে গাঢ় কালি। বাসা থেকে বেরোতে চায় না; মেজাজটাও খুব খিটখিটে হয়ে গেছে। ইদানীং সেই গন্ধটা ও আর সহ্য করতে পারে না; মাঝে মাঝে গন্ধে বমি করে দেয়।

বুঝতে পারছে যে ও ধীরে ধীরে পাগল হয়ে যাচ্ছে; ওই লোকটা ওর জীবনটা পুরো নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নিয়েছে। অরণি এখন জানে, এভাবে এড়িয়ে ও বাঁচতে পারবে না; আদালতে লোকটার চোখে চোখ রাখা খুব দরকার। অরণির বলা দরকার, অমানুষটাকে ‘আমি চাইনি! আমি কক্ষনো চাইনি!’ বড্ড বোকামি হয়েছে; ওর উচিত ছিল সঙ্গে সঙ্গে আইনের আশ্রয় নেওয়া। প্রমাণ কোথায় এখন?

আজ ডাক্তারের অ্যাপয়েন্টমেন্ট; বাসার লোকেরা ওর স্বাস্থ্য নিয়ে খুবই চিন্তিত। মা ওকে একা ছাড়তে চাইছিলেন না; একা যেতে না দিলে অরণি যাবে না বলাতে বাবা-মা আর মানা করলেন না। অটোরিকশায় কিছু দূর যাওয়ার পর ও মন পাল্টাল। ডাক্তারের কাছে গিয়ে কী হবে? ওর কী হয়েছে ও জানে।

অটোরিকশা ছুটছে থানার দিকে। অরণি অনেক

দিন পরে আবারও বাতাসে ডিজেলের গন্ধ পাচ্ছে। থানার পরে ও যাবে পত্রিকা অফিসে। অরণির কাছে এখন প্রমাণ আছে। প্রমাণটা ওর চামড়ার নিচে রক্তে মিশে আছে; ধীরে ধীরে ওর মধ্যে রক্ত-মাংসে বড়

হচ্ছে প্রমাণটা।