
উত্তর আমেরিকায় যখন প্রথম পা রাখি, আমার বাচ্চারা তখন অনেকটাই ছোট। বিদেশ বিভূঁইয়ে এক হাতে সব কাজ করার অভ্যেস তখনও রপ্ত হয়নি। মন খারাপের পারদ তখন উঁচুতেই থাকত সারাক্ষণ! ‘কী’, ‘কেন’ ‘কীভাবে’র অনিশ্চয়তায় নতুনকে চেনার কৌতূহল চাপা পড়ে যাচ্ছিল। বরং ছেড়ে আসা সবকিছুর আদল খুঁজতাম অচেনার ভিড়ে। ছবির মতো গোছানো রোড আইল্যান্ডের কিংস্টন শহরে আমাদের অ্যাপার্টমেন্টের উল্টোদিকে ‘টনিস পিযারিয়া’র রান্নাঘরের পেছনটা কোনো কারণ ছাড়াই চাটগাঁয় আমাদের পাড়ার ‘বার্মা রাজু হোটেল’-এর কথা মনে করিয়ে দিত। তারপর একসময় অন্য সবার মতো অচেনা গাছের পাতার ফাঁকের অচেনা রোদ্দুর আমারও নিত্যদিনের অভ্যেস হয়ে গেল। শহরটা যখন আমার কাছে সবে মোড়ক খুলতে শুরু করেছে, তখন জীবনের প্রয়োজনে পাততাড়ি গোটাতে হলো। চলে এলাম নিউইয়র্কে!
ব্যস্ত শহর। রাস্তাজুড়ে ব্যস্ত পা, ‘দাঁড়াবার সময় তো নাই’। এবার আর মিল খোঁজা নয় বরং মিলগুলো থমকে দিত আমায়। ফ্লাশিংয়ে মেইন স্ট্রিটের ‘কুইন্স লাইব্রেরি’র সিঁড়িতে বাংলা হরফে ‘পশ্চিমের যাত্রী’ লেখাটায় আঙুল বুলিয়েছি কতবার, কোনো কারণ ছাড়াই! ‘কিসসেনা বুলেভার্ড’ এ কোনো এক অলস দুপুরে ফুটপাথ ধরে হাঁটার সময় হাওয়ার বেগে প্রায় গা ঘেঁষে চলে যাওয়া সাইকেল-আরোহী, অজানা আশঙ্কায় মন ভার করে দিয়েছিল আমার, বাড়িতে অসাবধানী ছোট ভাইটা হেলমেট পরে তো!
ছেলেবেলায় বাবার সঙ্গে মাঝে মাঝে চাটগাঁয়ের অমর বই ঘরে যেতাম। সরু সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠলেই পুরোনো বই, ধুলো, খসখসে সিমেন্টের মেঝে—সব মিলিয়ে অদ্ভুত একটা পরিবেশ! মনে আছে সেই বইয়ের গাদা থেকে লিউ ওয়ালেসের বেন হার বইটা জেদ ধরে কিনেছিলাম আমি। ওই বই পড়ার মতো আঁতেল হইনি তখনো। মলাটের ছবিটা টেনেছিল আমাকে। অনেক বছর পরে শারলটটাউনে দ্য বুক এম্পোরিয়ামে ঢুকে বুকের ভেতর হু হু করে উঠেছিল। সব পুরোনো বইয়ের দোকানের কি একই গন্ধ?
আমেরিকান ঔপন্যাসিক নাথানিয়েল হাউথর্নের কথায়, ‘শেকড় উপড়ানো গাছ শক্ত করে আঁকড়ে ধরে অচেনা ভূমি এবং বেঁচে থাকার অদম্য সংগ্রাম পল্লবিত করে তাকে আগের চেয়েও বেশি।’ আমার শেকড় এখনও মাটির নাগাল পায়নি হয়তো, তাই এখনো ‘কোথায় যাচ্ছ গ্রীষ্মে?’ এমন প্রশ্নের উত্তরে নিজের অজান্তেই, ‘বাড়ি যাচ্ছি’ বলে ভাবতে বসি ‘আসলে বাড়ি কোথায় আমার?’ যে বাড়িতে জন্ম, বেড়ে ওঠা, সেটার ইট-কাঠ আছে, কিন্তু ভোল পাল্টে গেছে আমূল। আমার চেনা প্রায় কিছুই আর নেই। ছাদের কোনায় যে নারকেলগাছটা পাতার ফাঁকে আলোর কোলাজ তৈরি করত, ওটা নেই। আকাশটা ছেঁটে ফেলেছে চারপাশের উঁচু বাড়িগুলো। আমার মায়ের পুরোনো দেরাজের গায়ে ছেলেবেলায় লেখা আমার নামের আদ্যক্ষরটা হারিয়ে গেছে নতুনের জেল্লায়। মা চলে গেছেন আকাশের ঠিকানায়। পাঁচতলার ছাদে বাবার লাগানো টবের গাছগুলো আছে, বাবা নেই। পুরনো প্রতিবেশীরা নেই। রাস্তাটা আছে, পাড়াটা নেই। আমি নিজেও আর আগের ‘আমি’ নেই কারও কাছে। আমি এখন অতিথি। কে কী মনে করল, করবের জটিলতায় সহজতাও উধাও!
আমার জন্মভূমি এখন কৌটোবন্দী মাটি। আর বাড়ি? নিউরনে স্মৃতির কৌটায়। আহা! পল্লবিত হওয়া আর হলো না আমার!
রঞ্জনা ব্যানার্জী
শারলটটাউন পিইআই, কানাডা