বাঙালের নায়ক দর্শন

শাহরুখ খান। সংগৃহীত
শাহরুখ খান। সংগৃহীত

২০১৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে কানাডার ভ্যাঙ্কুভার গিয়েছিলাম একটা বিশেষ কারণে। বন্ধুবান্ধবদের কাছে জানতে পারলাম মহানায়ক শাহরুখ খান আর তার দলবল সেখানে একটি অনুষ্ঠান করবেন। আমি যে সব বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে গত সাত বছর ধরে ওঠাবসা করি আল্লাহ এদের অসীম শক্তি দিয়ে পাঠিয়েছেন। যে কোনো কাজে মহাআনন্দে হালুম ডাক দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়া ও লাফালাফি দাপাদাপির যে কোনো কাজে এদের জুড়ি মেলা ভার। যখনই শুনলাম মহানায়ক আসছেন মাত্র ছয় ঘণ্টা দূরের শহরে, সবাই এক সঙ্গে লাফ দিয়ে উঠল। একজন যাওয়ার ব্যাপারে দোনামনা করছিল। কিন্তু বাকিরা বলল, মহানায়কের বয়স ৪৯, আর কত দিন বাঁচেন ঠিক নাই, শেষ দেখাটা দেখার সুযোগ হারানো ঠিক হবে না। এমন যুক্তির পর আর কি বসে থাকা যায়! দেখা গেল সূর্যের চেয়ে বালি গরম। আমাদের চেয়েও আমাদের দুই-চার-পাঁচ বছরের বাচ্চারা লুঙ্গি ড্যান্স নায়ক-নায়িকাকে নিয়ে বেশি আনন্দিত। কারণ হিন্দি নাচগানে তারা পিএইচডি করে ফেলেছে প্রায়। দেখা গেল আমাদের কিছু পরিচিত মানুষ জেনে ফেলেছেন যে, এরা যাচ্ছে হিন্দি নায়ক-নায়িকা দেখতে। দেখা হলেই তাদের বিভিন্ন প্রশ্ন—কি ভাই, মেয়েরা না হয় যাচ্ছে মহানায়ককে দেখতে, আপনারা (ছেলেরা) যাচ্ছেন কেন?
ভাই, আমি আসলে দীপিকাকে (নায়িকা) দেখতে যাচ্ছি।
আরেকজন দুষ্টুমি করে বললেন, কি মিয়া, ফেসবুকে দেশ জাতি নিয়ে লেখ আর এখন যাচ্ছ হিন্দি নাচগান দেখতে। (ইংলিশ-আফ্রিকান-রাশিয়ান নাচ-গান দেখলে যেন সমস্যা নেই। আমাদের সংস্কৃতির বারোটা বাজে শুধু হিন্দি নাচ-গানে)। আমি বললাম, কি করব ভাই, ভালো লাগে তাই যাচ্ছি।

এক দেশের সংস্কৃতি অন্য দেশের সংস্কৃতিকে গ্রাস করতে পারে কি না এ নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক করা যায়। তবে আমি মনে করি জোর করে কিছু হবে না। যার যা ভালো লাগে সেটা সে করবে। আর যদি বিদেশি সংস্কৃতি আমাদের সত্যি গ্রাস করে নিত, তাহলে প্রবাসে এত বাংলা অনুষ্ঠান হওয়ার কথা না।
যা হোক, এক শ ডলার দিয়ে একেকটা টিকিট কেটে (+ থাকা খাওয়ার খরচ) রওনা দিলাম কানাডার দিকে। যে মোটেলে আমরা উঠলাম সেটার মালিক-কর্মচারী সবাই ভারতীয়। দেখলাম এই অনুষ্ঠান নিয়ে তাদের তেমন আগ্রহ নেই। মনে মনে বললাম, আরে বাপ তোদের নায়ককে দেখতে আমরা সেই পোর্টল্যান্ড থেকে ছুটে এলাম আর তোরা আছিস কেমন নির্লিপ্ত হয়ে। অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার কথা সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার সময়। সবাই মিলে তাড়াহুড়া করে সাড়ে ছটায় পৌঁছে গেলাম ভ্যাঙ্কুভার কলেসিয়াম সেন্টারে। আমার দুই বছর বয়সী ছেলেটা এর মাঝে গেল ঘুমিয়ে। তখনো গেট খোলেনি। বলছে সাতটার দিকে খুলবে।
যেহেতু stroller নিয়ে ওখানে ঢুকতে দেবে না তাই দারুণ এই কাজের জিনিসটা তখন সঙ্গে নেই। অগত্যা কি করা, ছেলে আমার কাঁধে মাথা রেখে ঘুমাচ্ছে আর আমি অপেক্ষা করছি কখন দরজা খুলবে। এক ঘণ্টা চলে গেল, হাজার হাজার মানুষ দাঁড়িয়ে বসে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। খবর এল নায়কের দলের এক অংশ আটকে পড়েছে শিকাগো এয়ারপোর্টে। তাই আসতে দেরি হচ্ছে, কখন শুরু হবে ঠিক নাই। বিপদ একা আসে না। অনেক কষ্টে ছোটটাকে মাত্র মায়ের কোলে দিয়ে একটু আরাম করে দাঁড়িয়েছিলাম, এর মধ্যে আমার বড় ছেলে (পাঁচ বছর বয়স) এবার আবদার ধরেছে কোলে উঠবে। তখন মনে মনে বললাম, এই নায়কগুলোকে একবার যদি সামনে পেতাম, তবে...।
শাহরুখ তুমি একটু তাড়াতাড়ি আস বাপ।
রাত নয়টার দিকে একটা লিমোজিনে চড়ে নায়কের দলবল এসে পৌঁছার পর, কলেসিয়াম সেন্টারের গেট খুলল। সবাই বেশ ক্লান্ত কিন্তু মহানায়ককে দেখার উত্তেজনায় তখন বেশ চনমনে। অনেক হেঁটে আমরা শেষ পর্যন্ত নিজেদের আসনে বসার পরে দেখি সবেমাত্র মঞ্চসজ্জা শুরু হয়েছে। এটা দেখে আমি মনে মনে ভাবছি এই শেষ আর ভারতীয় তারকা দেখতে আসব না। বাচ্চাকাচ্চা ভীষণ ক্ষুধার্ত, খাবার দোকানে লাইন দেখে ভয় পেয়ে গেলাম। প্রায় বিশ মিনিট লাইনে দাঁড়ানোর পরে, যখন খাবার কিনতে যাব, কাউন্টারের মেয়েটা বলল Cash only। পকেট থেকে আমেরিকার ডলার দিতে গেলাম, বলল কানাডিয়ান ডলার ওনলি। আমার পকেটে একটা কানাডিয়ান ডলার নেই, পাশেই ATM মেশিন আছে কিন্তু একবার এই লাইন থেকে বের হয়ে গেলে আবার বিশ মিনিটের জন্য লাইন ধরতে হবে। অগত্যা ইমোশনাল ডায়ালগ দিয়ে কাত করার চেষ্টা করলাম। দেখ আমার শিশুগুলো না খেয়ে আছে, তুমি যদি একটু সাহায্য কর তাহলে আমার আবার এই লাইনের পেছনে যেতে হয় না। মেয়েটা বলল ঠিক আছে তুমি ATM থেকে কানাডিয়ান ডলার নিয়ে আস, তোমাকে লাইন ধরতে হবে না। মোটামুটি বিশ্ব বিজয় করে নিজের আসনে ফিরলাম পাক্কা আধা ঘণ্টা পরে। তারপরেও অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার কোনো নাম নেই। মনে মনে ভাবছি, আদৌ অনুষ্ঠান হবে তো, যদি শুরুও হয়, নায়ক-নায়িকার শক্তি থাকবে তো। ব্যক্তিগত ভাবে আমি নায়কের শক্তি থাকা নিয়ে আমি খুব একটা চিন্তিত নই। নায়িকার শক্তি থাকলেই হলো। বলা তো যায় না, হঠাৎ করে এসে বলল, নায়িকার ঘুম পেয়েছে তাই এখন অংশগ্রহণ করতে পারছে না, আপাতত এক্সট্রা দিয়ে অনুষ্ঠান হবে। নায়িকার ঘুম ভাঙলে তার দেখা পাবেন, না হলে ইউটিউবে দেখে নেবেন।
ভ্যাঙ্কুভার হচ্ছে বল্লে বল্লেদের (পাঞ্জাবি) শহর। আমাদের মতো কিছু ছাড়া, পুরো হল ভর্তি ‘বল্লে বল্লে’ এবং একেবারে মঞ্চের সামনে যারা বসেছেন তারা দুই হাজার পাঁচ শ কানাডিয়ান ডলার দিয়ে টিকিট কেটেছেন। শুনলাম এরা নাকি এর বিনিময়ে নায়ক নায়িকার দলের সঙ্গে ডিনার করার সুযোগ পেয়েছেন। পাঞ্জাবি সর্দারদের বোকামি নিয়ে অনেক চুটকি শুনেছি। যেমন একজন সর্দারজীকে ব্যস্ত রাখার সহজ উপায় নাকি একটা খালি পৃষ্ঠার দুই দিকে please turn over লিখে বসিয়ে রাখা। সে ঘণ্টার পর ঘণ্টা পৃষ্ঠা উল্টিয়েই যাবে। কিন্তু এখানে ওদের অর্থ প্রাচুর্য দেখে টাসকি খেয়ে গেলাম।
অবশেষে রাত সাড়ে দশটার দিকে অনুষ্ঠান শুরু হলো। মূলত এখানে শাহরুখ খানের দলের আসার উদ্দেশ্য হচ্ছে তাদের Happy New Year ছবিটি প্রোমট করা। যাদের যাদের আসার কথা সবাই এসেছেন, শুধু ইয়ো ইয়ো হানি সিং ছাড়া। তিনি নাকি হোটেলে (খুব সম্ভবত বাথরুমে) আছাড় খেয়ে ব্যথা পেয়েছেন। যত গান দেখেছি এই লোকের, কোথাও তাকে সোজা হয়ে একদণ্ড দাঁড়িয়ে থাকতে দেখিনি, তাই বলে বাথরুমে গিয়েও লাফালাফি করার দরকার ছিল কি? সে না আসায় ভ্যাঙ্কুভারের পাঞ্জাবি দর্শকেরা বেশ হতাশ হয়েছেন। অনুষ্ঠান শুরু হলো ভাংতি নায়ক দিয়ে। ভিভান শাহ নামের কিশোর চেহারার এক নতুন অভিনেতা প্রথমে এসে কিছুক্ষণ নর্তনকুর্দন করল। আমরা যেখানে বসেছিলাম সেখান থেকে শুধু নায়কের পাশের চেহারা দেখা যায় আর আসনটাও মঞ্চ থেকে অনেক দূরে। আমাদের অ্যাকটিভ এক বন্ধু ফোকফাকড় দিয়ে খোঁজ নিয়ে এসে জানাল, মঞ্চ থেকে মোটামুটি কাছে কিছু আসন খালি আছে। সেখানে কেউ বসেনি এবং বসবে বলেও মনে হচ্ছে না। আমরা সঙ্গে সঙ্গে গিয়ে সেখানে বসলাম। পরে দেখি সামনের দিকেও কিছু আসন ফাঁকা, বেশি দামের জন্য মানুষ কেনেনি। আমাদের মতো অনেকে এসে এই সব সিটে এসে বসছে।

শাহরুখ খান ও দীপিকা পাদোকোন। সংগৃহীত
শাহরুখ খান ও দীপিকা পাদোকোন। সংগৃহীত


কিছুক্ষণ পরে অমিতাভের ছেলে নায়ক অভিষেক বচ্চন মঞ্চে এসে প্রথমে বললেন, আমার নাচন কুদনের সময় বসে থাকতে পারবেন না, সবাইকে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। মনে মনে বললাম, ব্যাটা মগের মুল্লুক পাইছস, তিন ঘণ্টা তোদের জন্য দাঁড়িয়ে মাত্র আরাম করে বসেছি আর বলে কি না এখন বসা যাবে না। পাক্কা দশ মিনিট সবাইকে দাঁড়িয়ে রেখে চমৎকার গান নাচ আর কথোপকথন করে তিনি বিদায় নেওয়ার আগে বলে গেলেন, এইবার আসবেন কিং খান। এটা সবাই নড়েচড়ে বসেছে। হঠাৎ মাটি ফুঁড়ে মহানায়ক একটা লোহার বারের ওপর চড়ে একেবারে দর্শকদের মাঝখান থেকে বের হয়ে আসলেন এবং জনপ্রিয়তা কি জিনিস প্রথম সচক্ষে দেখতে পেলাম। মানুষের চিৎকার আর উল্লাসের শব্দে আমার কানে তালা লাগার জোগাড়। আমি তাড়াতাড়ি আমার ছোট ছেলের কান চেপে ধরলাম যাতে কানের কোনো ক্ষতি না হয়। আমাদের এক বন্ধুপত্নী শাহরুখের অন্ধভক্ত, দেখি সে এক হাতে নিজের মুখ চেপে ধরে অঝোর ধারায় কাঁদছে (আমরা একটু আমাদের বন্ধুকে নিয়ে টেনশনে ছিলাম, শেষে না বেচারার বউ ছাড়া পোর্টল্যান্ডে ফিরতে হয়)। সামনে পিছে আরও কিছু তরুণীকে দেখলাম চোখের পানি নাকের পানি এক করে ফেলছে। ধন্য তুমি মহানায়ক।
মহানায়ক খুব বিনয়ের সঙ্গে অনুষ্ঠান শুরু হতে দেরি হওয়ার কারণে ক্ষমা চাইলেন এবং যথারীতি দুর্দান্ত পারফরমেন্স করলেন। একে একে নায়িকা দীপিকা পাদোকোন (নামটা যেন কেমন), আরেক বডিবিল্ডার নায়ক সোনু সুধ (নামটা ওই দিনই প্রথম জেনেছি), ছাইয়া ছাইয়া মালাইকা অরোরা, পরিচালক ফারাহ খান আর অভিনেতা বোমান ইরানি এরা সবাই নাচগান হাসি ঠাট্টা করে আমাদের প্রায় রাত একটা পর্যন্ত জাগিয়ে রাখল। অনুষ্ঠানের মধ্যে মঞ্চে শাহরুখ, অভিষেক বা দীপিকা ঘুরেফিরে অনেকবার এলেন এবং প্রচণ্ড পরিশ্রমসাধ্য অনেক পারফরমেন্স করলেন, তাও দেখি এরা ক্লান্ত হয় না-এরা খায় কি? আমাদের বাচ্চাগুলো শেষের দিকে আর টিকে থাকতে পারল না, এত ধুমধাড়াক্কা মাঝেও ঘুমিয়ে গেল। দেরিতে শুরু হলেও অনুষ্ঠানটা ছিল ভীষণ উপভোগ্য। হিন্দি না বুঝলেও উপভোগ করতে সমস্যা হওয়ার কথা না।
আমি সাবটাইটেল ছাড়া অনেক হিন্দি বাত নাহি বুঝতা। তবু থোরা থোরা বুঝথা হ্যায়। আসা করি আমার হিন্দির দৌড় আপলোগ সামঝা। সবশেষে যখন মোটেলে ফিরলাম তখন প্রায় রাত ২টা। ফেরার পথে কিছু কিছু বিষয় চিন্তা করছিলাম। তা পাঠকের সঙ্গে শেয়ার করলাম।
অনুষ্ঠান শেষে আমার কিছু উপলব্ধি: ক) আগের যুগে শুধু নায়িকারা অল্পস্বল্প কাপড় পরত, এই যুগে তাদের পাশাপাশি নায়কেরা খুব একটা কাপড় রাখতে চায় না। সোনু সুধ নামের এই নায়কটি পাক্কা পাঁচ মিনিট তার সিক্স প্যাক দেখিয়েছেন। আর মেয়েদের রি-অ্যাকশনের কথা নাই বা বললাম। খ) নায়ক-নায়িকাদের সঙ্গে অন্য যারা নাচ গান করেন, তারা বেশ সুদর্শন-সুদর্শনা। কিন্তু সিনেমাতে ক্যামেরা এদের দিকে খুব একটা তাক করা থাকে না, তাই এরা শুধু শোভাবর্ধনের কাজ করেন। গ) নায়ক-নায়িকারা প্রত্যেকেই খুব মেধাবী ও সপ্রতিভ, শুধু সৌন্দর্যে চিড়া ভেজে না। তবে একটা ব্যাপারে খুব মিল। সবাই দেদার মিথ্যা কথা বলেন। মাত্র সেদিনই বা কয়েক ঘণ্টা আগে তারা ভ্যাঙ্কুভারে এসেছে। কিন্তু ভ্যাঙ্কুভার শহরের এমন প্রশংসা করল যে মনে হয়েছে সব বানানো কথা। একজন তো বলে বসল, ভারতের বাইরে কোথাও যদি সে স্থায়ী হয় তবে সেটা হবে ভ্যাঙ্কুভার!
মহানায়ক কেমন জনপ্রিয়: বাংলাদেশের অনেকে জাতীয় সংসদের বর্তমান স্পিকারের নাম বলতে পারবেন না। কিন্তু শাহরুখের বাবার নাম, বাড়ির নাম কিংবা কুকরের নাম অবলীলায় বলতে পারবেন।
মহানায়কের সঙ্গে আমার তুলনা: ক) তার সম্পদের পরিমাণ ৬০০ মিলিয়ন ডলার, আমার...? খ) তাকে দেখে ১০ লাখ মেয়ে সব কিছু ছেড়ে ছুড়ে তার দিকে দৌড় দেবে। আর আমাকে দেখে আমার বউ উল্টো দিকে হাঁটা দেয়। গ) মহানায়কের পেট বর্তমানে এইট প্যাক, আমার এই মুহূর্তে এক প্যাক। ঠিক করেছি তার বয়সে পৌঁছার আগে কম করে হলেও টু প্যাক বানাব।