বাঙালি সংস্কৃতি যেখানে শ্রেষ্ঠ

রৌদ্রোজ্জ্বল ঝলমলে দিন মানেই নিউইয়র্কবাসীর জন্য বর্ণিল আনন্দের দিন। সমুদ্র সৈকতে, উদ্যানে বা রাস্তায় নামে নানা বয়সী নারী-পুরুষের স্রোত। বাংলাদেশি সংস্কৃতি-মনা কেউ রাস্তায় বেরোলে কারও কারও মনে হতে পারে চারপাশে উলঙ্গ উৎসব চলছে। এই নিউইয়র্কে সূর্যের উত্তাপ যত বাড়ে-রৌদ্রস্নাত নগরী যেন তত উলঙ্গ হয়ে ওঠে! পাতাল ট্রেনের কামরায় দাঁড়িয়ে চলে প্রেমিক জুটির রোমান্স। এমন দৃশ্য ট্রেনের কামরায় দেখে যাত্রীরা বিরক্ত ও বিব্রত হন। কোলাহলপূর্ণ কনিআইল্যান্ড বিচে তরুণ-তরুণীর নগ্নতার উত্তাল ঢেউয়ের ধাক্কায় দোল খায় নিউইয়র্কের অলিগলি। দুরন্ত সাহসে, অর্ধনগ্ন পোশাকে উলঙ্গ তরুণ-তরুণী যৌন ঔদ্ধত্যের উত্তাপ ছড়াতে সংকোচবোধ করে না। উলঙ্গ ফ্যাশনের সূর্যস্নানে কারও মনে আনন্দ হাসির সীমা থাকে না। অথচ মানবিকতার ঔদার্য গরিমায় ওখানে কেউ পাশবিক দৃষ্টির হয়ে ওঠে না।
হেলেদুলে চলা অনিন্দ্যসুন্দরী তরুণীরা জীবনানন্দ দাশের বনলতা সেন হতে পারে কিনা জানি না। বাংলার টগবগে দীপ্ত যুবকেরা আটলান্টিক পারের বিদেশিনীকে স্বপ্নের রানি মনে করে হাত ধরতে যায় না। উপন্যাস বা গল্পের কাল্পনিক চরিত্রের সুন্দরী নায়িকাকে নিয়ে অনেকে কল্পনার রাজ্যে ছবি আঁকলেও, নূপুর পরা অর্ধনগ্ন বিদেশিনী বালিকাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখেন না। বাংলার গ্রাম বা শহরের এমন অনিন্দ্যসুন্দরী বালিকার বাড়ি হলে, প্রেমের জন্য সুদর্শন তরুণদের লাইন পড়ে যেতো নাকি ইভটিজিংয়ের শিকার হতেন? সমুদ্র সৈকত থেকে নগরের প্রকৃতির উদ্যানে ‘শুকনো পাতার নূপুর পায়ে নাচিছে ঘুর্ণী বায়। জল তরঙ্গে ঝিলমিল ঢেউ তুলে সে যায়।’ কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবিতার ভাষায় বলতে হয় ‘নাচে নাচে ইরানি মেয়ে, নাচে ইরানি মেয়ে/ মরু বালুকা হরষে আকুল/ নাচে নাচে ইরানি মেয়ে, নাচে ইরানি মেয়ে।’ সেই ইরানি বালিকার মতো আটলান্টিকের পারে লাখ লাখ বালিকারা নেচে নেচে হাঁটেন। কিন্তু সেই ইরানের বালিকারা এখন আর নাচে না।
রৌদ্রোজ্জ্বল ছল ছল করা নগরীতে প্রভুভক্ত কুকুরও বেহায়া হয় না। মানবতার বিরুদ্ধে ঔদ্ধত্য দেখিয়ে মানবরূপী হায়েনা দানবের দল যখন স্কুলের শিশুদের ওপর হিংস্র জানোয়ার হয়ে বর্বর হামলা চালায় তখন তাদের হাত কাঁপে না। নগরের দিন বা রাতের নির্জনে যৌন আবেদনময়ী পোশাক পরা তরুণীরা একা একা নিরাপদে নির্বিঘ্নে গন্তব্যে পৌঁছাতে পারেন। ধর্ষণের আঁচড়ে কোনো নারী-তরুণী বা শিশুর শরীর ক্ষতবিক্ষত হয় না। কিন্তু নিরাপত্তা বেষ্টনীর ভেতরে থাকা স্কুল ক্যাম্পাসের শিশুদের আনন্দ হাসি ভরা প্রাণের ভরসা নেই। নিরাপত্তার মধ্যেও নিরাপত্তাহীনতার আশঙ্কার উদ্বেগ তাড়া করে স্বজনদের। উলঙ্গ দেহের নিরাপত্তা থাকলেও নিরাপত্তা বেষ্টিত ক্যাম্পাসে শিশুরা মরে বন্দুকের গুলিতে। কী বিচিত্র সংস্কৃতি!
বহুজাতিক ভাষা সংস্কৃতির ও নানান রঙের এই দেশের রাস্তাঘাটে বিনোদনের শেষ নেই। এই সংস্কৃতি আমাদের আকৃষ্ট করতে পারে না। উলঙ্গ পোশাক সংস্কৃতি বাঙালি সমাজের মানুষকে যতটা না বিমোহিত করে, তার চেয়ে বেশি লজ্জিত করে। বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ গণতান্ত্রিক দেশ আমেরিকায় অসভ্য সংস্কৃতির বিনোদনকে বাঙালিরা ভালোবেসে এখনো আপন করে নিতে পারেনি। একসময় প্রাচীন বাংলার ঘরের চার দেয়ালের ভেতর বন্দী আদিম সংস্কৃতিকে অনেকে বাঁকা চোখে দেখে নীরবে নিন্দা জানাতেন। বাংলার রাজদরবারের হেরেমখানার বাইজিদের নাচ আর নূপুরের ঝংকার, সুর আর শরাবের নহরে ভেসে গেলেও সাধারণ বাঙালি সব সময়ই নওয়াব বা বাদশার হেরেমের এই সংস্কৃতিকে বাঁকা চোখে দেখে ধিক্কার জানাতে ভুল করেনি। বাংলার ঘরের চার দেয়ালের ভেতর বন্দী আদিম সংস্কৃতি নিউইয়র্কের খোলা আকাশের নিচে নৃত্য করে।
বিচিত্র বহুজাতিক ভাষা-সংস্কৃতির দেশ আমেরিকার নিউইয়র্কের রাস্তায় যখন হাঁটাচলা করি, ট্রেন বা গাড়িতে করে কোথাও যাই, তখন অনেক কিছুই মেলাতে চাই, কিন্তু মেলে না। মেলাতে চাই আমাদের পরিবার সমাজ ও সংস্কৃতির সঙ্গে। কিন্তু এই সংস্কৃতি মেলে না।
ললিতকলার সঙ্গে আমরা যতটা না পরিচিত তার চেয়ে বেশি পরিচিত সংস্কৃতি ও কালচার শব্দ দুটির সঙ্গে। বর্তমান সময়ে প্রবাসে বাঙালিরা কালচারাল হয়ে উঠেছেন। প্রবাসে আমাদের প্রজন্ম গ্রহণ করছে পাশ্চাত্যের আধুনিক সংস্কৃতি। কিন্তু আমাদের হাজার বছরের বাঙালি সমাজ সংস্কৃতি পরিবার-পরিজনের দেওয়া শিক্ষা ও ধর্মীয় অনুশাসন আদিম যৌনতায় ভরা আলিঙ্গনের স্বীকৃতি দেয়নি। তবে আমাদের বাংলাদেশি প্রজন্ম এসব দেখতে দেখতে এখন বেড়ে উঠছে।
সাংস্কৃতিকভাবে আমেরিকা বিশ্বের বৈচিত্র্যময় একটি দেশ। বিশ্বের প্রতিটি অঞ্চলের সংস্কৃতি এ দেশের সংস্কৃতিকে প্রভাবিত করেছে। তাই বলে প্রাচ্য সংস্কৃতির ও পাশ্চাত্য সংস্কৃতি এক নয়। বাংলাদেশিরা প্রাচ্য সংস্কৃতিকে ধারণ করেন। যুগের সংস্কৃতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে সামনের দিকে অগ্রসর হন। আমাদের সংস্কৃতির সঙ্গে পাশ্চাত্যের সংস্কৃতির পার্থক্য অনেক। আমেরিকায় খোলামেলা মিশ্র সংস্কৃতি পারিবারিক সংস্কৃতির মর্যাদা দিতে জানে না। আমাদের সংস্কৃতি মূল্যবোধের ও সামাজিক পারিবারিক মর্যাদা রক্ষা করতে জানে। বাঙালিরা পারিবারিক সামাজিক রীতি-নীতির সংস্কৃতি পালন করে। আমেরিকানরা পারিবারিক সংস্কৃতিকে মূল্য দিতে জানে না। ব্যক্তিজীবন থেকে সবকিছুতে স্বতন্ত্রতা খোঁজে। আমেরিকানরা ব্যক্তিগত জীবনযাপন ও ভোগবিলাসের কাছে পরিবার-পরিজনকে ত্যাগ করতে পারে। বাঙালিরা পরিবারের জন্য নিজের সুখ ও স্বাধীন জীবনযাপনকেও ত্যাগ করতে পারে।

লেখক: সাংবাদিক, নিউইয়র্ক