বাংলাদেশের কীর্তিমান সন্তান ফজলুর রহমান খান

উইলিস টাওয়ারের নিচে ফজলুর রহমানের স্মৃতিফলক
উইলিস টাওয়ারের নিচে ফজলুর রহমানের স্মৃতিফলক

শিকাগো শহরের ভবনগুলো মেঘে ঢেকে যায় সহজেই। মেঘ যে খুব নিচ দিয়ে ভেসে যায়, তা নয়। প্রাণহীন এই স্থাপনাগুলোই একটু বেশি উঁচু। শিকাগো আমেরিকার তৃতীয় বৃহত্তম শহর। ক্রমশ ঊর্ধ্বমুখী এই নগর, স্থাপনা শিল্পের এক সূতিকাগার। শিকাগো শহরের সর্বোচ্চ ভবনের নাম উইলিস টাওয়ার। এ এক নান্দনিক শিল্পকর্ম! ভবনটি ১১০ তলা। আমেরিকার দ্বিতীয় সর্বোচ্চ এই ভবন, ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত ছিল পৃথিবীর সর্বোচ্চতম ভবন। এই ভবনের পূর্বনাম ছিল সিয়ার্স টাওয়ার। যার সঙ্গে মিশে আছে বাংলাদেশের সন্তান ফজলুর রহমান খানের নাম। তিনি ছিলেন এই ভবনের স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ার (Structureal Engineer)। সুচারু শিল্পের মাধ্যমে মানব সভ্যতার জন্য কাজ—এমনই বিশ্বাস করতেন ফজলুর খান। ভবনটির ১০৩ তলা ওপর থেকে, সস্ত্রীক শিকাগো শহর দেখছিলাম। কী অবিশ্বাস্য সুন্দর! সমগ্র শিকাগো যেন একখণ্ড তৈলচিত্র! উইলিস টাওয়ারের অদূরেই হ্যানকক ভবন (Hancock Center), উচ্চতায় শত তলা। সেই স্থাপনার সঙ্গেও জড়িয়ে আছে ফজলুর খানের নাম। তিনি ছিলেন শিকাগো শহর তথা পৃথিবীর গগনস্পর্শী স্থাপনা শিল্পের পথিকৃৎ।

সম্মানসূচক ফজলুর রহমান ওয়ে
সম্মানসূচক ফজলুর রহমান ওয়ে

তরুণ বয়সেই জেনেছিলাম এই কীর্তিমানকে। তার কর্ম দেখার ইচ্ছে ছিল অনেক দিনের। তাই গত বছর আমেরিকা ভ্রমণে গিয়ে দেখতে যাই শিকাগো শহর। আমেরিকান কেমিক্যাল সোসাইটির কনফারেন্সে যোগ দেওয়ার উদ্দেশ্যে ইউরোপ থেকে আমেরিকা গমন। আগেই জানা ছিল, শিকাগো শহর মানেই ফজলুর রহমানের শৈল্পিক স্পর্শ। ষাটের দশকে এ শহরের জীবন্ত কিংবদন্তি ছিলেন বাংলাদেশের এই সন্তান! তাঁর সৃষ্টির সম্মুখে দাঁড়িয়ে রোমাঞ্চিত হয়েছি প্রবল। আবিষ্ট হয়েছি এক তীব্র সম্মোহনে। লেক মিশিগানের (Lake Michigan) ওপর দাঁড়িয়ে আছে শিকাগো। নিথর অথচ কত জীবন্ত ভবন সারি সারি। এই শহরের বিকাশ শুরু হয়েছে তার হাত দিয়েই। বিভোর হয়ে ভেবেছি তার অনুপম সৃষ্টিশীল ক্ষমতা নিয়ে। উইলিস ভবন থেকে বের হওয়ার পথে যে স্মৃতিফলক চোখে পড়ে, তা দেখে আবেগাপ্লুত হয়েছি। স্মৃতিফলকে খচিত আছে খানের ছবি। স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে কালের এক মহান স্থপতিকে। সমগ্র শিকাগো শহরে ফজলুর খানের পরশ। তাঁর পদচিহ্ন ও কর্ম অনুসরণ করেছি আর মোহিত হয়েছি বারবার।

গগনচুম্বী উইলিস টাওয়ার
গগনচুম্বী উইলিস টাওয়ার

ফজলুর খান জন্মেছিলেন বাংলাদেশে, ১৯২৯ সালে। তৎসময়ের পাকিস্তান সরকারের বৃত্তি নিয়ে ১৯৫২ সালে পাড়ি জমান শিকাগো শহরে। মাত্র তিন বছরে উচ্চশিক্ষার পাট চুকে যায় তার। কী অবিশ্বাস্য মেধা ও সৃষ্টিশীলতা! ফিরে গেলেন দেশে। সহসাই উপলব্ধি করলেন, তাঁর মেধা বিকাশের সুযোগ নেই দেশে। শিকাগো ফিরে এলেন পুনরায়, বছর চারেক পর। কাজ শুরু করলেন পৃথিবীর বিখ্যাত স্থাপনা নির্মাণ কোম্পানিতে। ভালোবাসলেন এক অস্ট্রো-আমেরিকান নারী, লিজেলোটকে। ১৯৫৯ সালে দুজন বিয়ে করেন। দুই দশকের কর্মময় জীবনে তিনি পাল্টে দিলেন ইতিহাস। নিজেকে তুলে ধরলেন পৃথিবীর মঞ্চে। তাদের একমাত্র সন্তান ইয়াসমিন সাবিনা খান, পেশায় স্থপতি। মাত্র ৫৩ বছর বয়সে খান মারা যান ১৯৮২ সালে। জীবদ্দশাতেই দেখে গিয়েছেন তার খ্যাতি। রেখে গেছেন তার কর্ম—পৃথিবীর অনেক শহরে।
ফজলুর খান চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন শিকাগো শহরেই। তিনি বাংলাদেশে বিস্মৃত প্রায়! কিন্তু শিকাগোবাসী তাকে ভুলবে না কোনো দিন। শিকাগোর গ্র্যাসল্যান্ড গোরস্থান। আয়তনে বিশাল। সহস্র সহস্র মানুষের কবর। ছুটে যাই সেখানে। ওখানে চিরনিদ্রায় শায়িত ফজলুর রহমান খান। সেখানের দায়িত্বরত একজন কর্মকর্তা আমাকে একটি ম্যাপ দিলেন। খানসহ শিকাগোর বিখ্যাত প্রায় ৫০ জনের কবর নির্দিষ্ট করে চিহ্নিত করা। তিনি শুধু বললেন, খান

ফজলুর রহমান খানের সমাধি
ফজলুর রহমান খানের সমাধি

ইজ গ্রেট! আমি অদ্ভুত এক আনন্দ বোধ করলাম। তার অভিব্যক্তি থেকেই বুঝলাম খান এখনো মরে যাননি। ম্যাপল গাছের নিচে তার কবর। বৃষ্টির পানি ও ঝরা পাতায় ঢাকা পড়েছে তার নাম। বহু মনীষীর কবর দেখতে গিয়েছি। কিন্তু খানের কবর দেখতে যাওয়া ছিল বহুমাত্রায় ভিন্ন। এত আবেগ, এত সম্মোহন ছিল না কখনো! সে অনুভূতি ব্যক্ত করা যায় না। তার স্ত্রী, লিজেলোট খানও শায়িত তার সঙ্গে। ফজলুর রহমান খান রবীন্দ্র সংগীত ভালোবাসতেন। গুনগুন করে গাইতেন। গীতবিতান পড়তেন অবসরে। তার এপিটাফে উৎকীর্ণ রবীন্দ্রনাথের গান—তোমার হলো শুরু/ আমার হলো সারা, তোমায় আমায় মিলে/ এমনই বহে ধারা। সেই তো সত্যি। এই প্রবহমানতায় তোমার সারা, আমার শুরু। শিকাগোর মিডওয়ে বিমানবন্দর থেকে উইলিস টাওয়ার দেখা যায়। ফেরার পথে বিমানবন্দর থেকে বারবার দেখছিলাম সেই আকাশছোঁয়া ভবন। ঝাপসা হয়ে আসছে চোখে। মোহিত হয়েছিলাম, যেন মোহ ভাঙছে না। রবীন্দ্রনাথের সেই গান মনে পড়ছিল বারবার। আর প্রবলভাবে চেয়েছি ফজলুর খান ফিরে আসুক এই বাংলাদেশে, আমাদের তারুণ্যে, আমাদের মেধায়।
*গত ২৭ মার্চ ছিল ফজলুর রহমানের জন্মবার্ষিকী।
রউফুল আলম: ডক্টরাল গবেষক, স্টকহোম বিশ্ববিদ্যালয়, সুইডেন। ইমেইল: <[email protected]>