বাংলাদেশকে নিঃস্বার্থ বন্ধু হিসেবে চায় উত্তর মেসিডোনিয়া
স্লোভেনিয়াতে আসার পর থেকে মেসিডোনিয়া নামক দেশটির প্রতি আমার আলাদা আগ্রহ কাজ করত। প্রথমদিকে অবশ্য এ আগ্রহের পেছনে বিশেষ কোনো কারণ ছিল না।
গত বছরের মাঝামাঝি সময়ে অ্যাঙ্গেলা নামের এক তরুণীর সান্নিধ্যে আসার সুযোগ পাই। অ্যাঙ্গেলার জন্ম মেসিডোনিয়ার রাজধানী স্কোপিয়েতে, সেখানে তার বেড়ে ওঠা। অ্যাঙ্গেলার সঙ্গে প্রথম পরিচয় হয় স্লোভেনিয়ান ল্যাঙ্গুয়েজ ক্লাসে, আমরা একই ইউনিভার্সিটিতে ব্যাচেলর সম্পন্ন করছিলাম। রসায়ন পরীক্ষার দিন তার থেকে সাহায্য নিয়েছিলাম। আমার কলমের কালি শেষ হয়ে গিয়েছিল, তখন অ্যাঙ্গেলা আমাকে তার পক্ষ থেকে একটি কলম ধার দিয়ে সহযোগিতা করেছিল। ধীরে ধীরে তার সঙ্গে আমার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। পরবর্তী সময়ে একটা পর্যায়ে এসে অ্যাঙ্গেলার প্রতি আমি দুর্বল হয়ে পড়ি, আমার মধ্যে তার প্রতি ভালোবাসার অনুভূতি সৃষ্টি হয়। এটা ঠিক যে অ্যাঙ্গেলার সঙ্গে আমার সম্পর্ক খুব একটা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। তবে মেসিডোনিয়ার প্রতি সৃষ্টি হওয়া আমার সে আগ্রহকে চূড়ান্তভাবে সাত রঙে রাঙিয়েছিল অ্যাঙ্গেলা। তারই অনুপ্রেরণায় মেসিডোনিয়া ভ্রমণের পরিকল্পনা করা।
দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর অবশেষে গত মাসের শেষ সপ্তাহে মেসিডোনিয়া ভ্রমণের সুযোগ আসে। সব মিলিয়ে বলকান উপদ্বীপের এ দেশে চার দিন অতিবাহিত করি। ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত যেকোনো দেশের বৈধ ভিসা কিংবা রেসিডেন্ট পারমিট থাকলে কোনো ধরনের পৃথক ভিসা ছাড়া মেসিডোনিয়া ভ্রমণ করা যায়। ইমিগ্রেশন অফিসার মেসিডোনিয়াতে প্রবেশের সময় পাসপোর্টে একটি অ্যারাইভাল সিল দেন।
চার দিন মেসিডোনিয়াতে থাকার সুবাদে দেশটির সাধারণ নাগরিকদের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ হয়েছে। কৌচসার্ফিং, রেডিটসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কল্যাণে বিগত কয়েক মাসে আরও বেশ কয়েকজন মেসিডোনিয়ানের নৈকট্য লাভ করার সৌভাগ্য অর্জন করেছি। এটা ঠিক যে পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলোতে বসবাস করা জাতিগোষ্ঠীর মানুষদের সঙ্গে তুলনা করলে মেসিডোনিয়ানদের রক্ষণশীল বলতে হবে। তবে জাতি হিসেবে তারা খুবই অতিথিপরায়ণ ও বন্ধুবাৎসল। বাইরের দেশ থেকে আগত পর্যটকদের তারা বিশেষভাবে সমাদর করে, যা বলে বোঝানো সম্ভব নয়।
পুরো চার দিনের সফরে দেশটির সাধারণ মানুষদের থেকে বিভিন্ন ধরনের সহযোগিতা পেয়েছি, যা কোনোভাবে বলার নয়। বিশেষত ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক হিসেবে যখন নিজেকে পরিচয় দিয়েছি, তখন তাদের অনেকের কাছ থেকে আলাদা সম্মান পেয়েছি। বিদেশি পর্যটক, বিশেষত বিদেশি লেখক কিংবা বিদেশি সাংবাদিকদের প্রতি তাঁদের এ আতিথেয়তা এবং বন্ধুবাৎসলতার কারণ একটি। বেশির ভাগ মেসিডোনিয়ান রাজনৈতিক সচেতন, তারা মনেপ্রাণে এমন কোনো দেশকে বন্ধু হিসেবে পাশে পেতে চায়, যে দেশ সময় সময় নিঃস্বার্থভাবে তাদের সঙ্গে কাজ করবে।
মেসিডোনিয়ার একটি প্রসিদ্ধ শহরের নাম ওহরিড। ওহরিড নামক হৃদের তীরে গড়ে ওঠা শহরটির সৌন্দর্য উপভোগ করতে দেশটিতে অসংখ্য পর্যটকের সমাগম হয়। ওহরিড একই সঙ্গে এ পৃথিবীর সবচেয়ে দীর্ঘ ও সবচেয়ে গভীর হৃদগুলোর মধ্যে একটি। অর্থোডক্স খ্রিষ্টানদের মানুষদের কাছে ওহরিড একটি পবিত্র তীর্থস্থান। রাশিয়া, ইউক্রেন, বেলারুশসহ দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপের বিভিন্ন দেশে লেখার কাজে ব্যবহৃত সিরিলিক বর্ণমালার উদ্ভাবন করেন সেইন্ট সিরিল ও সেইন্ট মেথোডিয়াস নামের দুই ধর্মযাজক। ধারণা করা হয়, সিরিলিক বর্ণমালার প্রথম ব্যবহার শুরু হয়েছিল এ ওহরিডে, কেননা সেইন্ট সিরিল ও সেইন্ট মেথোডিয়াসের উভয়ই জ্ঞানসাধনার জন্য ওহরিডকে বেছে নিয়েছিলেন। আবার মেসিডোনিয়া তথা স্লাভিক জাতিসত্তার ইতিহাসে প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা শুরু হয়েছিল এ ওহরিডে। ওহরিডের ওল্ড টাউন ভীষণভাবে পর্যটকনন্দিত। মেসিডোনিয়াতে পা রাখার পর প্রথম দুই রাত আমি ওহরিডে অতিবাহিত করি।
এআরবিএনবির মাধ্যমে অ্যান্তোনিও নামের এক স্থানীয় ভদ্রলোকের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়, ওহরিডে দুই রাত থাকার জন্য আমি তাঁর ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়েছিলাম। অ্যান্তোনিওর সঙ্গে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আমার আলাপ হয়। তাঁর মুখ থেকে মেসিডোনিয়ার ইতিহাস শুনছিলাম। যদিও তাঁর মতে, অতীতের ইতিহাস সব সময় দেশটির সাধারণ মানুষের ভাগ্যের সঙ্গে ছিনিমিনি খেলেছে।
১৯১২ সালে প্রথম বলকান যুদ্ধের ফলাফল: বলকান উপদ্বীপের দেশগুলোকে উসমানীয় শাসন থেকে মুক্ত করে। গ্রিস ও সার্বিয়া প্রথম বলকান যুদ্ধে নেতৃস্থানীয় ভূমিকা পালন করেছিল। আজকের দিনে বিশ্ব মানচিত্রে বলকান উপদ্বীপের দেশগুলোকে আমরা যেভাবে দেখি, তা মূলত গ্রিস ও সার্বিয়া দ্বারাই নির্ধারিত হয়েছে। তাই দীর্ঘ প্রায় ৫০০ বছরের উসমানীয় শাসন থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে মেসিডোনিয়ার আত্মপ্রকাশের পেছনে এ দুই দেশ প্রত্যক্ষ ভূমিকা পালন করেছিল। ১৯১৩ সালের ২৯ জুন মেসিডোনিয়াকে নিজেদের অংশ হিসেবে দাবি করে বুলগেরিয়া গ্রিস ও সার্বিয়ার ওপর আক্রমণ চালায়। শুরু হয় দ্বিতীয় বলকান যুদ্ধ। যদিও এ যুদ্ধে গ্রিস ও সার্বিয়ার সেনাবাহিনীর প্রতিরোধের মুখে বুলগেরিয়ানরা পিছু হটতে বাধ্য হয়। এ সুযোগে রোমানিয়া বুলগেরিয়া থেকে কিছু অংশ দখল করে নেয়। ১৯১৮ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর সার্বিয়ার নেতৃত্বে যুগোস্লাভিয়া ফেডারেশন গঠিত হলে ক্রোয়েশিয়া, স্লোভেনিয়া, মন্টিনিগ্রো, বসনিয়া অ্যান্ড হার্জেগোভিনা ও কসোভোর মতো মেসিডোনিয়াও যুগোস্লাভিয়া ফেডারেশনে যোগ দেয়।
মেসিডোনিয়ার অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন বিষয়ে সব সময় সার্বিয়ার প্রভাব অত্যন্ত প্রবল। এমনকি ১৯৯২ সালে গণভোটের ফলে মেসিডোনিয়া যুগোস্লাভিয়া ফেডারেশন থেকে আলাদা হয়ে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলেও সার্বিয়া সব সময় দেশটির ওপর নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার চেষ্টা করেছে। যুগোস্লাভিয়া ফেডারেশনের অন্তর্ভুক্ত অন্যান্য দেশ, যেমন স্লোভেনিয়া, ক্রোয়েশিয়া কিংবা বসনিয়া অ্যান্ড হার্জেগোভিনাকে কোনো যুদ্ধের মাধ্যমে নিজেদের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হয়েছে।
অ্যান্তোনিও বলেন, ‘সামরিক দিক থেকে আমরা বরাবর দুর্বল। তাই আমরা কোনোভাবে যুদ্ধে জড়াতে চাইছিলাম না। গণভোটের মাধ্যমে আমরা ঠিকই স্বাধীন হয়েছি, তবে এর জন্য সার্বিয়ার কাছে আমাদের সমর্পণ করতে হয়েছিল। আমাদের দেশের বিভিন্ন ব্যাংকে থাকা রিজার্ভের একটা বড় অংশ তারা আমাদের থেকে নিয়ে যায়, যা স্বাধীনতোত্তর মেসিডোনিয়াকে অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু করে তোলে।’ তিনি আরও বলেন, ‘সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তুরস্ক, রাশিয়া ও চীন আমাদের দেশকে অর্থনৈতিকভাবে সহযোগিতা করছে। তবে এর বিনিময়ে তাঁরা আমাদের থেকে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা আদায় করেছে। আসলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপিয়ান ইউনিয়নসহ পশ্চিমা জোটের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য তাঁরা আমাদেরকে ব্যবহার করতে চায়।’
অ্যান্তোনিও যোগ করেন, ‘করোনার মধ্যে কোনো দেশ আমাদের টিকাপ্রাপ্তিতে সেভাবে সহায়তা করেনি। সার্বিয়া আমাদের টিকা দিয়েছে। কিন্তু তার বিনিময়ে তারা আমাদের থেকে অনেক কিছু নিয়ে গিয়েছে। এখন থেকে সার্বিয়ায় রেজিস্ট্রেশন হওয়া নাম্বার প্লেটবিশিষ্ট কোনো গাড়ি কোনো ধরনের ফি ছাড়া মেসিডোনিয়ার অভ্যন্তরে যেকোনো স্থানে পার্কিং করা যায়। আমাদের দেশের অর্থোডক্স গির্জাগুলোকেও তারা নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। সরকার বিভিন্ন বিদেশি সংস্থাকে আমাদের দেশে বিনিয়োগের সুযোগ দিয়েছে। কিন্তু তাদের ওপর আমাদের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই।’
বাংলাদেশ সম্পর্কে অ্যান্তোনিওকে প্রশ্ন করেছিলাম। আমার প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘যুগোস্লাভিয়া ছিল প্রথমদিকের রাষ্ট্র, যারা বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি জানিয়েছিল। যুগোস্লাভিয়ার সাবেক রাষ্ট্রপ্রধান মার্শাল টিটোর একটি নীতি ছিল, সদ্য স্বাধীন হওয়া সব দেশকে সাহায্য করা এবং সরাসরিভাবে এসব দেশ যাতে সোভিয়েত ইউনিয়ন কিংবা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বলয়ে প্রবেশ না করে নিরপেক্ষভাবে পররাষ্ট্রনীতি তৈরি করতে পারে, সে জন্য এসব দেশকে সহযোগিতা করা। বাংলাদেশকে আমরা সব সময় নিজেদের বন্ধু হিসেবে পাশে পেতে চাই। এটা ঠিক যে ১৯৯২ সালের পর আমাদের সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক সেভাবে আর জোরদার হয়নি। এ কারণে বাংলাদেশে যেমন মেসিডোনিয়ার দূতাবাস নেই, ঠিক একইভাবে মেসিডিনিয়াতেও বাংলাদেশের দূতাবাস নেই।’ তিনি আরও জানান, ‘নিশ্চয়ই বাংলাদেশে মাদার তেরেসা একজন সম্মানিত ব্যক্তিত্ব। যতটুকু জেনেছি বাংলাদেশেও তিনি একাধিক সেবামূলক প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন। মাদার তেরেসার জন্ম হয়েছিল মেসিডোনিয়ার রাজধানী স্কুপিয়েতে এক আলবেনীয় পরিবারে। তাই মাদার তেরেসার দিকে কেন্দ্র করে হলেও বাংলাদেশের সঙ্গে যাতে মেসিডোনিয়ার সম্পর্ক হয়, সে কামনা সব সময় করি।’
অ্যান্তোনিওর সুরে কথা বলেছেন মারিনা বোজিনোভস্কা নামের আরও এক মেসিডোনিয়ান। কৌচসার্ফিংয়ের মারিনার সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। পুরো চার দিনের সফরে মারিনা বিভিন্নভাবে আমার পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। সার্বিয়া থেকে মেসিডোনিয়াতে প্রবেশের সময় তাবানোভচি নামক বর্ডার ক্রসিং এলাকায় আমাকে বেশ ভোগান্তির শিকার হতে হয়েছিল। মারিনার দায়িত্বশীলতার কারণে শেষ পর্যন্ত বেঁচে যাই। স্কুপিয়েতে তিনি আমাকে বিভিন্নভাবে সঙ্গ দিয়েছিলেন।
স্কুপিয়ের সিটি সেন্টারে আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটের স্মরণে ভাস্কর্য স্থাপন করা হয়েছে। আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটের জন্ম হয়েছিল মেসিডোনিয়াতে। যদিও তিনি গ্রিক বীর হিসেবে সব জায়গায় পরিচিত, তবে মেসিডোনিয়ানরা তাঁকে নিজেদের জাতিসত্তার অংশ হিসেবে বিবেচনা করে। এ কারণে প্রতিবেশী গ্রিসের সঙ্গে মেসিডোনিয়ার দ্বন্দ্ব সব সময় প্রবল। স্বাধীনতা–উত্তর মেসিডোনিয়ার ওপর গ্রিস একাধিকবার অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা প্রদান করেছিল। উল্লেখ্য যে গ্রিস ছিল দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপের একমাত্র রাষ্ট্র, যেখানে কমিউনিজমের তেমন একটা প্রভাব ছিল না এবং সব সময় গ্রিসের পররাষ্ট্রনীতি ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্সমুখী। তাই মারিনার মতে, গ্রিসের কারণে মেসিডোনিয়ার সঙ্গে পশ্চিমা দেশগুলোর কূটনৈতিক সম্পর্ক সেভাবে জোরালো হয়নি। এমনকি ২০১৮ সালে গ্রিসের চাপে মেসিডোনিয়া তাঁদের নাম পরিবর্তন করে উত্তর মেসিডোনিয়া রাখতে বাধ্য হয়।
বুলগেরিয়ার সঙ্গেও মেসিডোনিয়ার সম্পর্ক খুব একটা উষ্ণ নয়। বুলগেরিয়ার সাধারণ মানুষ মনে করে, জাতিগতভাবে বুলগেরিয়ান ও মেসিডোনিয়ানরা অভিন্ন। তাদের যুক্তি হচ্ছে, আজ থেকে এক শ বছর আগে মেসিডোনিয়া ও বুলগেরিয়ার ভাষার মধ্যে খুব একটা পার্থক্য ছিল না। পরে সার্বিয়ার নেতৃত্বে মেসিডোনিয়া যুগোস্লাভিয়া ফেডারেশনে যোগ দিলে দেশটির সাধারণ মানুষের ভাষায় সার্বিয়ান ভাষার প্রভাব প্রতিষ্ঠিত হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে মেসিডোনিয়ানরা নিজেদের আলাদা জাতিসত্তার মানুষ হিসেবে পরিচয় দিচ্ছে। মারিনার মতে, বুলগেরিয়া ও গ্রিসের কারণে মেসিডোনিয়া ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সদস্যপদ থেকে বঞ্চিত। পাশাপাশি মেসিডোনিয়ার মোট জনসংখ্যার শতকরা ২৫ ভাগেরও বেশি মানুষ জাতিগতভাবে আলবেনিয়ান। এ ছাড়া এনভার হোক্সার শাসন আলবেনিয়াকে দীর্ঘদিন গোটা পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছিল। এসব কারণে আলবেনিয়ার সঙ্গেও মেসিডোনিয়ার খুব একটা ভালো সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি। আলবেনিয়ার সঙ্গেও মেসিডোনিয়ার মাঝেমধ্যে স্নায়ুযুদ্ধ চলে।
মারিনা জানান, প্রায় ৫০০ বছর ধরে মেসিডোনিয়াতে অটোমানদের শাসন প্রতিষ্ঠিত ছিল। এ কারণে মেসিডোনিয়ানরা স্লাভিক হলেও তাদের সঙ্গে তুর্কিদের জেনেটিক্যাল সংমিশ্রণ ঘটেছে। তিনি আরও যোগ করেন, অনেকে মনে করেন, মেসিডোনিয়ানদের একটি গোত্রের পূর্বপুরুষ এসেছে আফগানিস্তান কিংবা মধ্য এশিয়ার কোনো একটি দেশ থেকে। এ কারণে নাকি মেসিডোনিয়ার অনেক মানুষের চেহারায় আফগান, উজবেক, কাজাখ কিংবা তাজিকদের ছাপ রয়েছে। এ ছাড়া আলেকজান্ডার তাঁর সাম্রাজ্যকে ভারতের এক অংশ পর্যন্ত বর্ধিত করেছিলেন। তাই বদ্ধমূলগত বেশ কিছু ধারণার কারণে আমাদের দেশের অনেক মানুষ মধ্য ও দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর প্রতি দুর্বল।
বাংলাদেশ বিষয়ে মারিনাকেও প্রশ্ন করেছিলাম। অ্যান্তোনিওর মতো তিনিও বাংলাদেশ ও মেসিডোনিয়ার মধ্যকার দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক জোরদার করার বিষয়ে অত্যন্ত আশাবাদী। মারিনা মনে করেন, বাংলাদেশের সঙ্গে মেসিডোনিয়ার কূটনৈতিক সম্পর্ক শক্তিশালী হলে দুই দেশ সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে ব্যাপক লাভবান হবে।
এটা ঠিক যে ইউরোপের অন্যান্য দেশের তুলনায় মেসিডোনিয়া অর্থনৈতিকভাবে খুব একটা শক্তিশালী নয়। এ কারণে দেশটিতে বসবাসরত তরুণ প্রজন্মের অনেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, ফ্রান্স, নিউজিল্যান্ড, কানাডা, অস্ট্রিয়াসহ পশ্চিম ইউরোপের বিভিন্ন দেশে পাড়ি জমাচ্ছেন। বেকারত্বের হার দেশটিতে অনেক বেশি। তারপরও বিভিন্ন ধরনের সেবা খাত থেকে শুরু করে কৃষি ও নির্মাণ খাতে মেসিডোনিয়া বাংলাদেশের জন্য একটা সম্ভাবনাময় শ্রমবাজার হতে পারে। তৈরি পোশাক ও মধু থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধরনের শাকসবজি, মৌসুমি ফল ও ওষুধ রপ্তানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের জন্য মেসিডোনিয়া হতে পারে একটি সম্ভাবনাময় বাজার।
শুধু অ্যান্তোনিও কিংবা মারিনা নন, মেসিডোনিয়াতে আরও অনেকের সঙ্গে আমার কথা বলার সুযোগ হয়েছে, যাদের প্রায় সবাই বাংলাদেশ সম্পর্কে ইতিবাচক ধারণা পোষণ করেছেন।
তানিয়া ইভানোভস্কা, আমার অপর মেসিডোনিয়ান বন্ধু একবার আলোচনার ফাঁকে আমাকে বলে উঠলেন, আমার লেখার মাধ্যমে যদি মেসিডোনিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের সত্যিকারের সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে, তবে সেটা হবে তাঁদের জন্য বড় প্রাপ্তি। এ কারণে মেসিডোনিয়াভিত্তিক আমার কোনো লেখা যখন বাংলাদেশের কোনো গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়, তখন তার লিঙ্ক আমার মেসিডোনিয়ান বন্ধুদের সঙ্গে শেয়ার করলে তাঁরা অনেক সময় নিজ আগ্রহে সেগুলো ফেসবুক কিংবা অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শেয়ার দেন, যদিও বাংলায় তাঁদের জ্ঞান একদম শূন্য।
আমার বয়স মাত্র ২৩। তবে এই ২৩ বছর বয়সে এখন পর্যন্ত ৩০টির বেশি দেশ ভ্রমণ করার সৌভাগ্য হয়েছে। তবে মেসিডোনিয়া আমার জীবনের সোনালি অধ্যায়গুলোর মধ্যে একটি। মেসিডোনিয়ানদের আতিথেয়তা আর বন্ধুবাৎসল্য আমাকে যেমনভাবে মুগ্ধ করেছে, ঠিক একইভাবে বাংলাদেশের সঙ্গে মেসিডোনিয়ার দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক জোরদারকরণে তাদের আগ্রহ আমার মনে আলাদা প্রশান্তির জন্ম দিয়েছে।
মেসিডোনিয়ানদের শুধু একটাই স্বপ্ন, এমন একটি দেশকে তারা বন্ধু হিসেবে পাশে চায়, যে দেশটি সব সময় নিঃস্বার্থভাবে তাদের জন্য কাজ করবে। অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশ ও মেসিডোনিয়ার মধ্যে পরম বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন করা যায় এবং এ দুই দেশ যাতে সব সময় একে অন্যের সঙ্গে বুকে বুক মিলিয়ে কাজ করতে পারে, সে লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য আমাদের সরকারের প্রতি বিশেষ অনুরোধ রইল।
*লেখক: রাকিব হাসান রাফি, শিক্ষার্থী, ইউনিভার্সিটি অব নোভা গোরিছা, স্লোভেনিয়া।