বসন্ত এলো ঘরে

অভিনয় করা শহীদের শখ। স্কুলজীবন থেকেই সে অভিনয় করে আসছে। কলেজজীবনেও এর ব্যতিক্রম হয়নি। তবে তাকে এই নেশার জন্য বাড়িতে অনেক বকা-ঝকা খেতে হয়েছে। বরাবর পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করার ফলে বাবা-মায়ের বকুনিটা ততটা তীব্র হয় না। মেডিকেল কলেজে অনেক পড়াশোনার চাপেও অভিনয় করার ভূতটা মাথা থেকে সরাতে পারেনি। কলেজের সাংস্কৃতিক সম্পাদক হওয়ার সুবাদে বার্ষিক নাটক পরিচালনার ভারটা সব সময় তার ওপর পড়তো। আর সেও আনন্দের সঙ্গে সেটা গ্রহণ করে নিত। প্রতিবারেই নাটকের চরিত্র অনুযায়ী তাকে অভিনেতা-অভিনেত্রী নির্বাচন করার দায়িত্বে থাকতে হয়। এবারের নায়িকার চরিত্রটি বাদে সব চরিত্রের জন্য অভিনেতা-অভিনেত্রী কলেজের সহপাঠীদের মধ্যে থেকে নেওয়া হলো।

নায়িকার চরিত্রটি একটু ভিন্ন ধরনের, তাই পেশাদার নায়িকার খোঁজ নেওয়া শুরু হলো। সহসা পেয়েও গেল। তাদের পাড়া গেন্ডারিয়ায় একটি মেয়েকে পাওয়া গেল। মেয়েটির নাম, সাধনা। হেসে হেসে মেয়েটি বলল, ‘ঢাকার বিখ্যাত সাধনা কবিরাজি ওষুধের নামে তার বাবা এই নামটি রেখেছে।’ ‘নামটি অপূর্ব’, শহীদও হেসে হেসে বলল।

সাধনা স্থানীয় স্কুলে ক্লাস নাইনে পড়ে। সাধনার বাবা-মা পশ্চিমবঙ্গের উদ্বাস্তু। সাধনার জন্ম হয়েছে ঢাকাতেই। আর্থিক দিক থেকে ওর বাবা খুব একটা সুবিধা করতে পারেনি। ঢাকা জর্জ-কোর্টে একজন সামান্য টাইপিস্ট। ওর বাবা-মা, ভাইবোন নিয়ে পাঁচজন। সে বাড়ির দ্বিতীয় সন্তান। বাবার একার আয়ে সংসার চলে না। তাই তাকে অভিনয় পেশায় নামতে হয়েছে। অর্থাৎ পড়াশোনার ফাঁকে অভিনয় করে সংসারের আর্থিক দুরবস্থা লাঘবের চেষ্টা করছে। সাধনা দেখতে মন কাড়া সুন্দরী। সত্যিকারের সিনেমার নায়িকাদের মতো। খাঁটি সোনার মতো উজ্জ্বল তার গায়ের রং। এত সৌন্দর্য সে কোথা থেকে পেল? নিশ্চয়ই সে তার মায়ের কাছ থেকে পেয়েছে। কারণ, তার বাবাকে দেখে তো সে রকম সুন্দর মনে হয় না।

প্রথম যে দিন সাধনা শহীদদের কলেজে রিহার্সাল দিতে এসেছিল, সেদিন অভিনয়ের ফাঁকে ফাঁকে শহীদকে বলছিল, তারও ডাক্তারি পড়ার খুব ইচ্ছা। বার্ষিক পরীক্ষায় সে সব সময়ে টপ গ্রেড পেয়ে এসেছে। কিন্তু সংসারের ব্যয় দিনকে দিন বেড়ে যাওয়ায় লেখাপড়ার চেয়ে অভিনয়ের দিকে ঝুঁকে যেতে হচ্ছে বেশি করে। কিছুটা আক্ষেপ করে সাধনা বলল, ‘আমার স্বপ্ন, স্বপ্নই রয়ে যাবে।’

প্রতিদিন সন্ধ্যায় রিহার্সালের সময় সাধনার সঙ্গে তার বাবাও আসেন। ভদ্রলোককে দেখলে খুব করুণা হয়। কোর্ট থেকে কাজ সেরেই মেয়েকে নিয়ে সোজা কলেজের অডিটোরিয়ামের পাশের ড্রেসিংরুমে চলে যায়। চোখেমুখে সব সময় যেন দারিদ্র্যের ছাপ লেগে আছে। আর সাধনাকে দেখলে মনে হয় যেন এক জমিদার তনয়া। সাধনা যখন অভিনয় করে তখন বাস্তবকেও হার মানিয়ে দেয়। এতই নিখুঁত। শহীদ তার অভিনয়ে অভিভূত। সৌন্দর্য আর চমৎকার অভিনয়ের সংমিশ্রণে সাধনাকে করে তুলছে একজন পূর্ণাঙ্গ শিল্পী।

নাটকের শেষ রজনীর কিছুদিন পর হঠাৎ করে শহীদ অনুভব করল, আর তো কখনো সাধনাকে দেখতে পাওয়া যাবে না অথবা দেখার সুযোগ হবে না। কিন্তু এরই মধ্যে যে শহীদ সাধনার সৌন্দর্যে আটকে পড়ে গেছে। তাই একদিন বিকেলে শহীদ ওদের বাসায় গেল। সাধনার বাবা বৈঠকখানার দরজা খুলে দিলেন। শহীদকে দেখে চিনতে পারলেন এবং ওকে বসতে বলে বাড়ির ভেতরে চলে গেলেন। শহীদ বসে আর কোথায়! ভাড়া বাড়ি, ঘরের চারদিকে দারিদ্র্যের চিহ্ন। হাতল ছাড়া ভাঙা এক চেয়ারে বসল। ভেতর ঘর থেকে ফিরে এসে করিম সাহেব শহীদকে জিজ্ঞাসা করল, ‘শহীদ সাহেব, কি মনে করে? নতুন কোনো নাটক করতে যাচ্ছেন নাকি?’ শহীদ বলল, ‘না এমনি, অনেক দিন হলো, তাই আপনাদের সঙ্গে দেখা করতে এলাম।’

ইতিমধ্যেই শহীদের আসার খবর পেয়ে সাধনা ঘরের চৌকির এক কোনায় এসে বসলে। শহীদ সাধনার দিকে লক্ষ্য করে একটা জিনিস দেখল, কোনো কিছুর ওপর সে মগ্ন থাকলে নিজের, অজান্তে ওর বৃদ্ধা আঙুলটি দোলাতে থাকে। আজও তার ব্যতিক্রম দেখল না।

সাধনার বাবা করিম সাহেব বোধ হয় শহীদের আসার ব্যাপারটা আঁচ করতে পেরেছিলেন। তাই হয়তো শহীদকে ভদ্রভাবে বললেন, ‘দেখুন শহীদ সাহেব, দেখতেই পাচ্ছেন, আমরা গরিব লোক। আমার একার আয়ে সংসার চলে না। কোর্টে টাইপিস্টের মধ্যে অনেক প্রতিযোগিতা। মেয়েটি যদি অভিনয় করা ছেড়ে দেয়, তাহলে আমাদের মাঝে-সাজে উপোস করতে হতে পারে। তা ছাড়া আজকাল আমার শরীরও ভালো যাচ্ছে না। আমার চিকিৎসাতেই অনেক টাকা চলে যাচ্ছে। বরং বলতে পারেন মেয়ের আয়ের ওপরেই চলছি এবং চলতে হবে।’

করিম সাহেব একনাগাড়ে কথাগুলি বলে হাঁপাতে লাগলেন। শহীদ সাধনার দিকে তাকাল আর দেখতে পেল, ওর বৃদ্ধা আঙুলটি খুব দ্রুত উঠানামা করছে। করিম সাহেবের কথাগুলো শুনে শহীদের মনটা খারাপ হয়ে গেল। শহীদকে চা খেতে বলেছিলেন। মনে মনে শহীদ ভাবল, চায়ের জন্য যে পয়সাটা খরচ হবে, সেটা হয়তোবা তাদের অন্য কোনো দরকারি কাজে লাগতে পারে। অন্য একদিন এসে খেয়ে যাবে বলে সে বাড়ি থেকে বের হয়ে গেল।

পরদিন শহীদ সাধনার স্কুলে ওর সঙ্গে দেখা করল এবং তার মনের কথা জানাল। সাধনা দৃঢ়ভাবে বলল, ‘তুমি তো জানো, আমার আয়ের ওপর আমাদের সংসারটা কতটা নির্ভরশীল।’

–তা জানি, তোমাদের সংসারের ভার আমি নেব, সে ব্যাপারে তুমি কিছু ভেবো না। শহীদ সহানুভূতির সঙ্গে বলল।

–তুমি তো এখনো ছাত্র, নিজেই তো মা-বাবার ওপর নির্ভরশীল।

–বটে, তবে ডাক্তার হয়ে গেলে তো আর কোনো সমস্যা থাকবে না।

–তা সত্যি, তাহলে তত দিন আমাদের অপেক্ষা করতে হবে।

–ঠিক আছে, তত দিন আমরা দুজনে দুজনের জন্য অপেক্ষা করব।

শহীদ ও সাধনা দুজনেই এক বাক্যে সায় দিল।

ইতিমধ্যেই তাদের দুজনের মেলামেশার কথা পাড়ার চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। একদিন শহীদের বাবা তাকে ডেকে বললেন, ‘শহীদ, একি শুনছি। তুমি নাকি একজন অভিনেত্রীর সঙ্গে ঘোরাফেরা করছ?’

শহীদ আর কী বলবে। একটু ঘুরিয়ে সত্যি কথাটাই বলল, ‘মেয়েটি আমাদের কলেজের ফাংশনে অভিনয় করেছিল, সেই সূত্রে জানাশোনা। এর বেশি কিছু নয়।’

শহীদের বাবা একটু গম্ভীরভাবে বললেন, ‘আমরা মধ্যবিত্ত লোক, আমাদের মানসম্মান নিয়ে চলতে হয়। এটাই আমাদের জীবনের সবচেয়ে বড় পুঁজি। এটাকে নষ্ট হতে দিয়ো না। তা ছাড়া একটু চিন্তা করে দেখো দেখি, যদি তুমি ডাক্তারি পাস না করতে পারো, তাহলে আমাদের এমন কোনো জমিদারি নেই যে তুমি তোমার জীবন চালিয়ে নিতে পারবে। দারিদ্র্যের বিভীষিকায় সারা জীবন জ্বলে–পুড়ে মরবে। তখন বিবেকের কাছে প্রশ্ন করবে, কিন্তু কোনো উত্তর পাবে না। কারণ ততক্ষণে ব্যাপারটা অনেক দেরি হয়ে যাবে। আমার একটা উপদেশ, সেটা হলো বাস্তবকে গ্রহণ করো। বাস্তব–ই হলো প্রকৃত জীবন, আর জীবন–ই হলো বাস্তবতা।’

তারপর কিছুক্ষণ থেমে বললেন, ‘তুমি এখন বড় হয়েছ, এ বিষয়ে আমি আর কিছু বলতে চাই না।’

সেদিন শহীদ তার বাবার কথাগুলো নিয়ে অনেক ভাবল। তারপর বাস্তবকে সামনে রেখে তার নিজের ভুবনকে নিয়ে জীবন চালিয়ে দিল, অর্থাৎ বুকের ভেতর পাথর বেঁধে সাধনার কথা ভুলে জীবন জোয়ারে ভেসে চলল। শহীদ যথারীতি এবং যথাসময়ে ডাক্তার হলো। তবে মনটা সব সময়ে উদাস হয়ে থাকে, কিছু যেন হারিয়ে গেছে জীবন থাকে। বাড়িতে বিয়ের জন্য তাগাদা দিচ্ছে। শহীদ প্রস্তুত নয় বলে এড়িয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ করেই শহীদ পাকিস্তান আর্মির মেডিকেল কোরে যোগ দিল। উদ্দেশ্য, ঢাকা থেকে নতুন কোনো জায়গায় চলে গেলে সে তার না পাওয়ার পেছনের জীবনটাকে ভুলে যেতে পারবে। মেজরের পদবি নিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের রাওয়ালপিন্ডির কেম্বেলপুরে তার পোস্টিং হয়ে গেল। সে ভাবল, ওখানে রোগীদের সেবা–শুশ্রূষা করে ঢাকার জীবন থেকে ভুলে যাওয়ার এক বিরাট সুযোগ হলো তার।

হঠাৎ করে নতুন করে তার জীবনে আরেকটা ঝড় এসে পড়ল। পূর্ব পাকিস্তানে স্বাধীনতার আন্দোলন শুরু হয়ে গেল। রাওয়ালপিন্ডিতে সব বাঙালি ভাইয়েরা এক আত্মা হয়ে মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন জানাল। ফলে বাঙালি অফিসাররা পশ্চিমাদের কোপানলে পড়ল। ওদের সবাইকে সাসপেন্ড করে বেতন–ভাতা সব বন্ধ করা হলো। বাঙালি অফিসারদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠল। কিছু অবাঙালি বন্ধু-বান্ধবের সহায়তায় পাকিস্তানি বর্ডারের লোকদের ঘুষ দিয়ে শহীদ ভারতে ঢুকে পড়ল। ভারত থেকে সোজা স্বাধীন বাংলাদেশে। এবার শহীদের পোস্টিং হলো ঢাকার কম্বাইন্ড মিলিটারি হাসপাতালে কর্নেল হিসেবে।

একদিন ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট থেকে একটা অফিশিয়াল কাজে শহীদকে যেতে হলো যশোর ক্যান্টনমেন্টে। তার সঙ্গে জিপ চালক এবং একজন সহকারী অফিসার রয়েছে। আরিচা ঘাটে জিপটাকে কিছু সময়ের জন্য অপেক্ষা করতে হলো। কারণ, যমুনা নদী পার হতে হবে। শহীদ গাড়িতেই বসে রইল। সে দেখতে পেল সাত/আট বছরের কিছু ছেলেমেয়ে খালি গায়ে কিংবা ছেঁড়া জামাকাপড় পরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তারা লোকদের কাছ থেকে পয়সা চাচ্ছে, আবার কখনো কখনো অপেক্ষমাণ লোকদের অর্ধেক ফেলে দেওয়া খাবার কুড়িয়ে নিচ্ছে। ওদের মাঝে একটি ছেলে, খালি গা আর হাফপ্যান্ট পরা। চলমান যাত্রীদের দিকে হা করে তাকিয়ে আছে, মনে হয় কী যেন খুঁজে বেড়াচ্ছে।

শহীদ কিছুটা অবাক হয়। তার কাছে ছেলেটিকে একটু ব্যতিক্রম মনে হলো। সে কারও কাছে হাত পাতছিল না বা মাটি থেকে কোনো খাবার কুড়িয়ে নিচ্ছিল না। এবার সে ভালো করে ছেলেটির দিকে তাকাল। চেহারাটা চেনা চেনা মনে হলো। সে নিজের মনকে বোঝাল, সে ঢাকার ছেলে। এই আরিচা ঘাট এলাকায় তার কোনো চেনা জানা লোক থাকার কথাই না। কিছুক্ষণ পর ছেলেটি পাশের এক বিরাট পাথরের ওপর বসল। তারপর সে তার বৃদ্ধা আঙুলটি দোলাতে লাগল। কিন্তু শহীদ কিছুতেই কিছু মেলাতে পারল না। শহীদ সময় মতো ফেরি পার হয়ে যশোর ক্যান্টনমেন্টে পৌঁছে গেল।

প্রায় সপ্তাহ খানিক পরে অফিশিয়াল কাজ সেরে শহীদ যশোর থেকে ঢাকার অভিমুখে রওনা হলো। এবার যানজটের পাল্লায় পরে আরিচা ঘাটের সামনে আটকা পড়ল। যানজট ছাড়তে বেশ কয়েক ঘণ্টা লেগে যাবে। কী আর করা, সে গাড়িতেই বসে রইল। আজও সে একই দৃশ্য দেখতে পেল। সেই ছেলেটি হা করে বসে আছে সেই পাথরটির ওপর। আগের মতোই তার অন্য বন্ধু–বান্ধব যাত্রীদের ফেলে দেওয়া খাবার মাটি থেকে কুড়িয়ে নিচ্ছে, কেউবা হাত বাড়িয়ে পয়সা চাচ্ছে।

শহীদের কাছে এখন অফুরন্ত সময়। কৌতূহলবশত সে গাড়ি থেকে নেমে ছেলেটির সামনে গিয়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘তোমার নাম কি?’

–আমার নাম সাগর, ছেলেটি নির্লিপ্তভাবে উত্তর দিল

–তুমি হা করে গাড়িগুলোতে কি দেখছ? আর তুমি তোমার সাথিদের মতো কারও কাছ থেকে কোনো পয়সা চাচ্ছ নাতো?’ শহীদ অবাক হয়ে আবার জিজ্ঞেস করল।

–ছি, আপনি অমন কথা বলবেন না। আমি তো আমার বাবার পথপানে চেয়ে আছি।

–আমার মা বলেছে, বাবা মুক্তিবাহিনীতে গেছে। বাবা তো এখনো এল না। তাই বাবার ফিরে আসার পথপানে দিনভর চেয়ে আছি। মুক্তিযুদ্ধ তো অনেক দিন হলো শেষ হয়েছে। বলতে পারেন আমার বাবা এখনো কেন ফিরছে না?

এই বলে ঝর ঝর করে সাগরের দুচোখ বেয়ে জল পড়া শুরু হয়ে গেল। কিছুক্ষণ মৌন থাকার পর শহীদ সাগরকে জিজ্ঞাসা করল, ‘তুমি থাকো কোথায়?’

–ওই যে দূরে ছোট বিলটা দেখছেন, ওই বিলটার পাশেই আমাদের গাঁ।

–আমাকে নিয়ে যাবে তোমাদের গাঁয়ে?—শহীদ জানতে চাইল।

সাগর মলিন হাসি হেসে বলল, ‘আপনি সত্যি যাবেন আমাদের গাঁয়ে?’

–কেন যাব না! তুমি নিয়ে গেলে নিশ্চয়ই যাব—শহীদ সাগরের কথায় জবাব দিল।

–তবে চলুন। বলে সাগর শহীদের হাত ধরে তাকে টানতে টানতে তাদের বাড়ির দিকে নিয়ে চলল।

শহীদ তার ড্রাইভার মাহফুজকে বলল, ‘আমি ওই সামনের গ্রাম থেকে একটু ঘুরে আসি ততক্ষণে, তুমি আমার জন্য অপেক্ষা করো।’

বাঁশ দিয়ে তৈরি একটা ঘরের ভেতর সাগর শহীদকে নিয়ে ঢুকল। ঢুকেই শহীদ হতবাক। এ যে সাধনা তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। মানুষ কি এতটা বদলে যেতে পারে! কোথায় গেল ওর মন কাঁপানো সৌন্দর্য? রোগা পাতলা এক মহিলা। শুধু মুখটা বদলায়নি। আর সব বদলে গেছে।

সাধনা প্রথমে শহীদকে দেখে রীতিমতো ভয় পেয়ে গিয়েছিল। বিশেষ করে শহীদের মিলিটারির পোশাক দেখে। তারপর আস্তে আস্তে সাধনা শুরু করল তার অতীত জীবনের কথা।

প্রথমেই সে শহীদকে ভর্ৎসনার সুরে বলল, সে এক কাপুরুষের মতো হঠাৎ করে ওর জীবন থেকে সরে গেল। শহীদের মতো কাপুরুষকে এই মিলিটারি পোশাকে মানায় না। শহীদ কথাগুলো শুনে হজম করে যাচ্ছে।

সাধনা বলা শুরু করল, পাড়ার এক ব্যবসায়ী ছেলের সঙ্গে সাধনার আমার বিয়ে হয়। ঢাকার বাসিন্দা। পশ্চিম পাকিস্তানের করাচিতে সে পান পাতা সরবরাহ করত। প্রচুর টাকার মালিক। বাবা তাই পারভেজ, মানে আমার স্বামীর বিয়ের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিতে পারেনি। কারণ সে কথা দিয়েছিল, আমার ছোট ভাই–বোনদের মানুষ করবে বড় ভাই হিসেবে। আর আমাদের পরিবারের মাঝে সচ্ছলতা এনে দেবে। সে তার কথা রেখেছিল। ভাগ্যের লেখা অখণ্ডনীয়। আমাদের জীবনের অত সুখ সইল না। বাংলাদেশে স্বাধীনতা আন্দোলন শুরু হয়ে গেল। একদিন সাগরের বাবাকে পাকিস্তানি বাহিনী ধরে নিয়ে গেল, আর ফিরে এলো না। তখন সাগরের প্রায় এক বছর বয়স।

সাধনা বলে চলে, সাগর সব সময় জিজ্ঞাসা করে, ‘মা, বাবা কবে ফিরবে? সবার বাবা আছে, আমার বাবা নাই কেন?’ আমি বলি তোর বাবা আছে, মুক্তিবাহিনীতে গেছে, কাজ শেষ হলেই ফিরে আসবে। এরই অপেক্ষায় আজও সাগর দাঁড়িয়ে থাকে ওই আরিচা ঘাটে। তার ধারণা, তার বাবা একদিন ফিরে আসবে। এভাবে কত গ্রীষ্ম, বর্ষা, আর বসন্ত পেরিয়ে গেল, তবু তো সে এল না।’

সাধনা একনাগাড়ে কথাগুলো বলে গেল। সে কথাগুলো বলতে বলতে জোরে শব্দ করে কাশতে শুরু করল। তারপর মুখ দিয়ে ঝরে পড়ল এক ঝলক তাজা লাল রক্ত। এ দেখে শহীদ প্রায় চিৎকার করে বলে উঠল, ‘এ যে যক্ষ্মা!’

সঙ্গে সঙ্গে শহীদ লক্ষ্য করল, সাধনা তার বৃদ্ধাঙ্গুলিটি অতি দ্রুততার সঙ্গে দোলাতে শুরু করছে।

–‘হ্যাঁ, তাই!’ অতি ক্ষীণ কণ্ঠে সাধনা উত্তর দিল।

–‘চিকিৎসা করাও না?’ শহীদ জানতে চাইল।

–‘তুমি আমাকে হাসালে।’ সাধনা একটু থেমে বলল।

-মানে? শহীদের আবার প্রশ্ন।

-দুবেলা ঠিকমতো খেতে পারি না, আবার চিকিৎসা।

–ছেলেটার কথা একবার ভেবেছ?

–ভেবে আর লাভ? যে যার ভাগ্য নিয়ে জন্মায়, ওর ভাগ্যে যা আছে তাই হবে। সাধনার ভাষায় হতাশার সুর।

শহীদের পাশেই সাগর মাটিতে বসে গুণ গুণ করে গান করছিল, ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি...।’

শহীদ সাগরকে কাছে ডাকল আর জিজ্ঞাসা করল, ‘সাগর, তুমি তোমার বাবার খোঁজ পেয়েছ?’

–‘কই, নাতো!’ বলে সে জিজ্ঞাসু নেত্রে শহীদের দিকে তাকিয়ে রইল।

–‘তোমার বাবা তোমার সামনেই দাঁড়িয়ে আছে।’ শহীদ মৃদু হেসে বলল।

সাগর তৎক্ষণাৎ শহীদের বুকে এসে বলল, ‘ওহ, তুমিই আমার বাবা! তাহলে এত দিন কোথায় ছিলে?’

–‘পালিয়ে বেড়িয়েছিলাম’। শহীদ দৃঢ়তার সঙ্গে জবাব দিয়ে সাধনার দিকে তাকাল।

শহীদ দেখল, সাধনার দুচোখ দিয়ে অশ্রুর বন্যা বেয়ে চলছে। সে মনে মনে নিজেকে বলছে, দেরিতে হলেও সে আর কাপুরুষ নয়।