বন্যার গান-গানের বন্যা

রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা। নামের সঙ্গে সংগতি রেখে যেন তিনি গানের বন্যায় টেনে নিলেন বিমুগ্ধ শ্রোতাকে। আবুধাবিতে আমন্ত্রিত হয়ে দুই স্থানে অনুষ্ঠান করলেন তিনি। একটি বাংলাদেশ দূতাবাসে এবং অন্যটি ভারতীয় দূতাবাসের আয়োজনে।
হ্যাঁ, বন্যা রবীন্দ্রসংগীতই চর্চা করেন। এ জন্য তিনি এপার–ওপার দুই বাংলায়ই বিপুল জনপ্রিয়।
বাংলাদেশ দূতাবাসের একক সংগীতসন্ধ্যায় শিল্পী ১১টি গান পরিবেশন করেন। আর ভারতীয় দূতাবাসের সাংস্কৃতিক সন্ধ্যায় ১৭টি। তাঁর গান যেন রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পের মতোই—শেষ হয়েও হয় না শেষ। সে জন্য শেষ করেও যেন গাইতে হয় আর একটি গান। বড় শিল্পীদের এই এক গুণ। শ্রোতাদের ভালোবাসায় তাঁরা সিক্ত হন। সে কারণে তাঁদের ছাড়া যেন গুণীদের এক পাও চলে না। তাইতো ভক্ত–শ্রোতাদের অনুরোধে গাইতে হয়-দূরে কোথায়... দূরে-দূরে...।
১৩ ফেব্রুয়ারি শুক্রবারের আয়োজনটিতে ছিল দুই গুণী শিল্পীর পরিবেশনা। অন্যজন ছিলেন ভারতের প্রখ্যাত নাট্যব্যক্তিত্ব পদ্মশ্রী শাওলি মিত্র। অনুষ্ঠানে বন্যা গান পরিবেশন করেন আর শাওলি উপহার দেন শ্রুতি নাটক। মহাভারতে বিবৃত কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের ঘটনাকে তিনি উপস্থাপন করেন নাট্য সংলাপের মধ্য দিয়ে।

একই কণ্ঠে বিভিন্ন চরিত্রের সংলাপকে ভিন্ন ভিন্ন ব্যঞ্জনায় তুলে আনেন শাওলি। শক্তিশালী স্বর আর গলার ওঠানামার মাধুর্য দিয়ে চরিত্র রূপায়ণে তিনি বরাবরের মতোই মুনশিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন।
গানের ফাঁকে ফাঁকে প্রেক্ষাপট তুলে ধরেছেন বন্যা। গানে আর কবিতা কখনো কখনো এক হয়ে যায়। রক্তকরবীর প্রসঙ্গ আসে এ কারণে। নন্দিনী ভালোবাসে রঞ্জনকে, অন্যদিকে বিষ্ণু পাগলা নন্দিনীকে। তাই তো বিষ্ণু পাগলার নিবেদন, তোমায় গান শোনাবো...। দরদভরা মন নিয়ে শিল্পী শেষে শোনান এ গান।
বিসর্জন নাটকে রবীন্দ্রনাথ নিজে নির্দেশনা দেন। শাহানা দেবী এসেছেন-এসেছেন ঝুনু। তাদের কণ্ঠে গীত গান অন্তর্ভুক্ত হবে এতে। কিন্তু হয়নি। বন্যা রবীন্দ্রনাথের জন্মের সার্ধশতবর্ষে শ্রুতি গীতবিতান প্রকাশ করেছেন। তিনি সেখানে সংকলন করেছেন সে গান। আনন্দধারা বহিছে ভুবনে। এটা ছিল বন্যার শেষ গান।
সৃষ্টি আর স্রষ্টার প্রতি বন্যার কৃতজ্ঞতা প্রবল। এটা রবীন্দ্রনাথেরই দর্শন। তাইতো তারও শুরু ও প্রগতির গতি...গানটিকে ধরে। রেজওয়ানা চৌধুরী গানের শুরুতে তারই গুরু কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম আনেন পরম শ্রদ্ধায়।
ভারতীয় দূতাবাসের আয়োজনটি ছিল মূলত যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থীদের অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের উদ্যোগে। তারাই রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী বন্যাকে আমন্ত্রণ জানিয়ে আবুধাবিতে এনেছে। অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি পিনাকি সরকার তাঁর বক্তব্যে শিল্পীর ভ্রমণ প্রক্রিয়ায় সহযোগিতার জন্য বাংলাদেশ দূতাবাসের রাষ্ট্রদূতের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। কাকলি সেন শর্মার পরিচালনায় চার শিল্পীর সমবেত সংগীতের মাধ্যমে সাংস্কৃতিক সন্ধ্যার সূচনা হয়। এপার বাংলারও অনেক শ্রোতা ছিলেন সেখানে।

অন্যদিকে বাংলাদেশ দূতাবাসের উদ্যোগে ইসলামিয়া স্কুল অডিটোরিয়ামে পরবর্তী দিন শনিবারের একক সন্ধ্যায় স্বাগত বক্তব্য দেন রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ ইমরান। অধ্যাপক মীর আনিসুল হাসান তাঁর সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে রবীন্দ্রনাথকে শুদ্ধতম সংগীতের ধারকবাহক হিসেবে অভিহিত করেন। তিনি বলেন-বন্যা সেই সংগীত সঠিকভাবে তাঁর কণ্ঠে ধারণ করেছেন।
সত্যিই তা–ই। রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা শিক্ষকতা করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগে। সে কারণে গানের আরও কথা বলার অভ্যেস তাঁর। প্রসঙ্গটি যেমন তাঁর মুখে এসেছে, তেমনি অনুষ্ঠানের কথায় তার পাণ্ডিত্যই প্রতিষ্ঠা করলেন। বলাই যায়, তিনি তাঁর বাচন এবং এর প্রক্ষেপকে অর্জন করেছেন রাবিন্দ্রিক মাধ্যমে।
দর্শক শ্রোতারা যার যার জায়গা থেকে ভিন্ন ভিন্ন অনুভূতি প্রকাশ করেন। তবে সবটার সুর যেন এক জায়গায় এসে মিলেছে। সে সুর তৃপ্তির।
ড. হাবিব-উল-হক খন্দকার বলেন শাওলির কথা। শম্ভু মিত্র, তৃপ্তি মিত্র তাঁর মা–বাবা। নাট্যজগতের এই দুই মহীরূহ ১৫/১৬ বছরের এই কন্যাকে নিয়ে এসেছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। এটা ১৯৭৪ সালের কথা। তিনি নাট্যজগতে এই পরিবারের অবদানের কথা তুলে ধরেন। ড. মেহরুজ আলম বললেন, মনটা ভরে গেছে!

ড. রায়হান জামিল তারুণ্যের উচ্ছ্বাস প্রকাশ করলেন। বললেন, সকালে বনভোজনে কেটেছে বাউল সংগীতে আর সন্ধ্যায় গুণী শিল্পীর রবীন্দ্রসংগীতে। মনোজ কান্তি পাল বলেন, অদ্ভুত ভালো লাগা এ অনুভূতি!
মহিলা সমিতির সাধারণ সম্পাদিকা পপি রহমান অনুষ্ঠানের স্মৃতি ধারণ করে ছবি নিলেন। বললেন, রাবিন্দ্রিক এ সন্ধ্যাকে ভোলার নয়। নাশেতা নাহরির তানিয়া সমিতির সাংগঠনিক সম্পাদিকা। মুখে তাঁর এক রাশ হাসি। যেন বন্যার গানটিই উচ্চারণ করলেন, অনেক ধারা বহিছে ভুবনে... ...।
আঞ্জুমান আরা শিল্পী যেন শিল্পীর ভাবনাটাই ব্যক্ত করলেন। যেন বলেন, কী তার গুণ! কী তার মোহনীয় গলা। লাকী হালদার উল্কা বলেন, নান্দনিক একটি সময়ের মধ্য দিয়ে চলছি আমরা।
স্থপতি দেবাশীষ মান্না, প্রদীপ সেন শর্মা, জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়, নাট্যকার রানা মুখার্জী, সোমা চ্যাটার্জী, ওডিসি কত্থক নৃত্যধারার শিল্পী শিক্ষক কুন্দন মুখার্জী—সবাই তাঁদের যৌবন সময় পার করার অনুভূতি জানালেন। ধীরা মুখার্জী বললেন, অপূর্ব! প্রকৌশলী আখতারুল হক বলেন, ভাষায় প্রকাশ করার নয় এ আনন্দ!
দুই আয়োজনে শ্রোতারা অনন্য দুটি সন্ধ্যা উপভোগ করেন। বিদেশে বিভুঁইয়ে অল্পতেই সন্তুষ্ট থাকেন সবাই। তবে রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যার কাছ থেকে তাঁরা পেলেন অনেক। সত্যিই মহান তিনি।