বন্ধু

বিছানায় শুয়ে ছটফট করছে আলো। কিছুতেই ঘুম আসছে না। মাথার ওপরে ছাদের গায়ে লাগানো ছোট ছোট প্লাস্টিকের তারাগুলো কী সুন্দর নীলচে আভার মায়াবী আলো ছড়াচ্ছে। মনে হচ্ছে এক টুকরো রাতের আকাশ। এই রুমটায় নাকি এক নবদম্পতি ছিল। ওরা লাগিয়েছিল এই তারাগুলো। ঘুমাতে যাওয়ার আগে পানির গ্লাসটা দিতে এসে বলেছিল সোহেল। বলতে বলতে ওর চোখদুটো কী একটু অন্য রকম হয়ে গিয়েছিল। তারার আলোর মতোই কোমল আলোর দ্যুতি ছিল বোধ হয়। কী জানি ওরই হয়তো দেখার ভুল। বাইরে ঝুম ঝুম করে বৃষ্টি পড়ছে, সেই সঙ্গে বিদ্যুতের চমক। বিদেশে এসেও এ রকম দেশের মতো বৃষ্টি দেখতে পারবে সেটা আশা করেনি আলো।
আলো আর সোহেল ইউনিভার্সিটির শুরু থেকেই খুব ভালো বন্ধু। রাজীবের সঙ্গে আলোর পরিচয় হওয়ার আগে থেকেই ওদের বন্ধুত্ব।
কিছু কিছু ছেলে থাকে যাদের মন একটু নরম গোছের। মেয়েদের সঙ্গেই যেন বেশি স্বাচ্ছন্দ্য পায় তারা। সোহেল অনেকটা সেরকম। ক্লাসের রানা ও তপু, ওদের সঙ্গে ওর খাতির থাকলেও গভীর বন্ধুত্ব ছিল আলো আর ঝুমার সঙ্গে। ওদের সঙ্গেই ও সব মনের কথা বলত। কোনো ছাত্রীকে পড়াতে গিয়ে ক্র্যাশ খেয়েছে, কিন্তু বলতে পারছে না কিছুতেই। সেই নিয়ে দিনের পর দিন মন খারাপ করা আর তখন আলো আর ঝুমার কাজ ছিল ওর মন ভালো রাখা। এ কথা সে কথায় ওকে ভুলিয়ে রাখা। ঝুমা খুব সিরিয়াস ছাত্রী। পরীক্ষার সময় সোহেল আর আলোর ভরসা ছিল ঝুমা। আবার প্রজেক্টগুলোতেও ওরা সব সময় এক গ্রুপে থাকত ইচ্ছে করেই। রাত করে বাড়ি ফিরতে হলে সোহেলতো আছেই।
প্রথমদিকে রাজীবকে নিয়ে সোহেল মাঝে মাঝেই হাসাহাসি করত। খোঁচা দিয়েও কথা বলত। আলো কিছু মনে করত না। বন্ধুরা তো একটু খোঁচাখুঁচি করেই। পরে অবশ্য ওর সম্পর্কটা সিরিয়াস হয়ে যাচ্ছে দেখে সোহেল চুপ করে গিয়েছিল। ওর বিপদ, দুঃসময় ও সুখের সময়ে পুরো ইউনিভার্সিটি লাইফটাই তো সোহেল ওর পাশে ছিল। শুধু রাজীবকে নিয়ে কিছু সমস্যায় পড়লে ও কেন যেন এড়িয়ে যেত। শুনত ঠিকই, কিন্তু কিছু বলত না।
আজ কত দিন পরে ওর সঙ্গে দেখা হলো। বছর তিনেক প্রায়। পাস করেই বিদেশে চলে এসেছে সোহেল। মাস্টার্স শেষ করে এখন পিএইচডি করছে। আলো আর রাজীব বিয়ের পর দেশেই ছিল এত দিন। দেশে থাকবে না বিদেশে আসবে সিদ্ধান্ত নিতে পারছিল না। আর ভাগ্যটাও যেন কেমন। আলোর ভিসা হয়ে গেল ঠিকই, আটকে গেল রাজীব।
তুমি তাহলে একাই যাবে? বেশ আহত গলায় জানতে চেয়েছিল রাজীব।
এভাবে আর কত দিন ঝুলে থাকব? আমি গেলে তুমি অন্তত স্পাউজ ভিসায় আসতে পারবে।
নাহ, আমি ভাবছিলাম তুমি একা থাকতে পারবে? রাজীবের মুখটা অন্ধকার হলেও ওর উদ্বেগটা কিন্তু খাঁটি ছিল।
তবু জেদ করে চলে এসেছে আলো। শ্বশুর বাড়িতে দম বন্ধ হয়ে আসছিল। আর কিছুদিন থাকতে হলে কী যে হতো বলা যায় না। রাজীব ব্যাপারটা জানত। জেনেও কিছু করতে পারেনি সে। আর এ জন্যই বোধ হয় শেষ পর্যন্ত ওকে একা আসতে দিতে রাজিও হলো।
কি রে বিয়ে করবি না? মাথায় তো দু-একটা পাকা চুল উঁকি দিচ্ছে মনে হয়? ' সোহেলকে খোঁচানোর সুযোগটা হাত ছাড়া করতে রাজি না আলো।
এত তাড়া কীসের? ব্যাচেলর জীবন কত স্বাধীন, তুই এই সব বুঝবি না।
গাড়িতে আসতে আসতে সেই পুরোনো দিনের কথা মনে হচ্ছিল। ঝুমাকে নিয়েও কিছুক্ষণ গল্প হলো। অনেক দিন পরে ইউনিভার্সিটি লাইফের মতো প্রাণ খুলে হাসল আলো।' কত বদলে গেছে সে এই কয় বছরে। নিজের কাছেই ভীষণ অবাক লাগে। সে যে এভাবে হাসতে পারে সেটাই তো ভুলে গিয়েছিল।
সোহেলের দুই বেডরুমের অ্যাপার্টমেন্টটা বেশ ছিমছাম। আর এই কয় বছরে ওর বেশ উন্নতি হয়েছে। চার আইটেম তরকারি রান্না করেছে সে আলোর জন্য। তার ভেতরে এক রকম মাছ আর একটা ভিন্ন ধরনের ডালও আছে। যতই দেখছে ততই মুগ্ধ হচ্ছে আলো।' বিদেশে আসলে ছেলেরা অনেক কিছু শিখে নেয় বুঝি? ওর সরল প্রশ্নের উত্তরে সোহেল খালি হাসে।
খেতে খেতেই ফোনটা এল ওর রুমমেটের। চাইনিজ ছেলেটা আজ রাতে ওর গার্ল ফ্রেন্ডের ওখানে থাকবে। সোহেলের বান্ধবী এসেছে, ওদেরকে প্রাইভেসি দেওয়ার জন্য। খবরটা শুনেই আলোর মুখ শুকিয়ে গেছে, সোহেলের সেটা চোখ এড়ায়নি।
কি ভাবছিস?
আলো আসলে ভাবছে রাজীব শুনলে কীভাবে নেবে। কিন্তু কেন যেন সেটা সোহেলকে বলতে পারে না ও। নাহ, ভাবছি তোর বউয়ের কত মজা হবে, পায়ের ওপরে পা তুলে বসে খাবে।
বিছানায় শুয়ে শুয়ে এই সব হাবিজাবি ভাবছিল আলো। স্বামী হিসেবে রাজীব খুব ভালো। বেশ দায়িত্ববান। কিন্তু বিয়ের পর থেকে ও যেন আর একদম বন্ধু নেই। আচ্ছা, আমি কি ওকে ভয় পাই? ধুর কেন ভয় পাব? কেন যেন ঘুরে ফিরে সোহেলের সঙ্গে একটা তুলনা মাথার মধ্যে একটা দুষ্টু পোকার মতো বিরক্ত করছে। সোহেল ওকে এত মায়া করে, সেই কবে থেকে, এত দিন দেখা হয়নি, তারপরও। বাথরুমে পরিষ্কার তোয়ালে, সাবান, শ্যাম্পু, কন্ডিশনার পর্যন্ত রাখা ছিল। ধোয়া বিছানার চাদর, এমনকি বিছানার পাশের ছোট্ট টেবিলটায় এক গোছা ফুল।
ঘুমাতে যাওয়ার আগে চা খেতে চাচ্ছিল আলো। সোহেল দেয়নি, এখন চা খেলে আরও ঘুমাতে পারবি না, জেটল্যাগ কাটবে না। ও আছে বলেই একটুও ভয় লাগছে না এই নতুন পরিবেশে আলোর। মনে মনে ভাবে, ও এত ভালো কেন?
কয়েক ঘণ্টা ছটফট করে যখন চোখের পাতা দুটো সবে লেগে এসেছে, ঠিক তখনই প্রচণ্ড শব্দে ঘুম ভেঙে গেল আলোর। কাছেই কোথাও বাজ পড়েছে। প্রবল ঝড়ের শো শো শব্দে জানালার কাচগুলো কাঁপছে ভীষণ জোরে। আকাশের এ মাথা থেকে ও মাথা চিরে গেল বিদ্যুতের ঝলক। প্রচণ্ড ভয় পেয়েছে আলো।
এমন সময় দরজায় ঠক ঠক শব্দ। আলো, এই আলো দরজাটা খোল। তুই ঠিক আছিস তো?
সোহেলের গলা পেয়ে ভরসা পায় আলো। তড়িঘড়ি দরজা খুলতেই ওপাশে দাঁড়িয়ে আছে সোহেল। বেশি বাতাস হলে এ রুমের জানালাটা খুলে যায়। একটু দেখি ঠিকঠাক আছে কিনা।
সোহেল আলোকে পেরিয়ে জানালার পাশে চলে যায় দ্রুত। সব ঠিক আছে নিশ্চিত হয়ে ঘুরে দাঁড়াতেই একটা ধাক্কা খায় ও। ওর খুব কাছে দাঁড়িয়ে আছে আলো। খোলা চুল ও সাদা রাতের পোশাকে ওকে দেখে মনে হয় যেন দেবী। এই মধ্যরাতে দেবীর পুজোয় আত্মাহুতি দিতে ইচ্ছে করে। সেই ইচ্ছেকে দলিয়ে যাওয়ার সাধ্য যে তার নেই। খুব সাবধানে আলোর মুখটা দুই হাতে তুলে নেয় সোহেল।
ভয়, বিস্ময়ে পাথর হয়ে গেছে আলো।' সোহেলের কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে?
মধ্য রাতের নিস্তব্ধতাকে খান খান করে দিয়ে বেজে ওঠে বাসার ফোনটা। সোহেল চমকে উঠে ধড়মড় করে গিয়ে ফোনটা ধরে। যেন ফোনের ওপাশে যে আছে সে সব দেখতে পাচ্ছে।
তোর ফোন। রাজীব ভাই ফোন করেছে। শুকনো গলায় কোনোমতে কথাটা বলে ফোনটা এগিয়ে দেয় সোহেল।
আর কয়েক ঘণ্টা পরেই আলোর ফ্লাইট। ইচ্ছে করেই একটা রাত ট্রানজিট নিয়েছিল সোহেলের শহরে। ওর সঙ্গে দেখা করবে বলে। কাল রাত থেকে ওরা আর কেউ কারও সঙ্গে সহজ হতে পারছে না।
একটু পরেই সোহেল ওকে এয়ারপোর্টে নামিয়ে দিয়ে আসবে। ধোঁয়া ওঠা কফির মগ নিয়ে নাড়াচাড়া করছে আলো। কখন যেন সেই কফি ঠান্ডা হয়ে গেছে।
কিছুই তো খেলি না। কফিটা কি বেশি কড়া হয়ে গেছে? চা করে দিই?
আলোকে কিছু একটা বলতেই হবে এখন। একটা ভুলের জন্য এত বছরের বন্ধুত্ব নষ্ট হতে দিতে পারে না সে।
আচ্ছা দে। আসলে সকালে মিষ্টি কিছু খেতে ভালো লাগে না আমার।
চায়ের সঙ্গে একটা ডিম পোজ আর এক টুকরো টোস্ট করে আনে সোহেল। আলোর খাওয়া হলে কতগুলো কমলা নিয়ে বসেছে। ও নিজেও খাচ্ছে আর আলোকে কমলা খুলে খুলে দিচ্ছে। আলোর চোখে পানি আসে। এত যত্ন করে বহুদিন কেউ ওকে খাওয়ায়নি। রাজীব কখনোই খেয়াল করে না ও কী খেয়েছে, নিজেরটা ঠিকমতো পেলেই সে সন্তুষ্ট।
অনেক চেষ্টা করেও কেন যেন আলোর কাছে ক্ষমা চাইতে পারল না সোহেল। তার মন বলছে আলো ওকে ক্ষমা করে দেবে ঠিকই। ওর সুন্দর ঠোঁট দুটোর কোনায় কি অভিমান জমে আছে? নাকি, ঘৃণা? এই ভুলের মাশুল তাকে দিতে হবেই।
ইমিগ্রেশনে ঢুকে যাওয়ার আগ মুহূর্তে একবার ভেবেছিল ওর হাত দুটো ধরে ক্ষমা চেয়ে নেবে, সংকোচ হলো। শুধু তাকিয়ে ছিল ওর দিকে অনেকগুলো কথা বুকে নিয়ে।
বন্ধু কি কখনো বন্ধুর ওপরে রাগ করে থাকতে পারে?