বন্ধু ও বর 'বন্ধুবর'

স্বামীর সঙ্গে লেখিকা
স্বামীর সঙ্গে লেখিকা

‘বিনাইন প্যারোক্সিসমাল পজিশনাল ভার্টিগো’ রোগটার সঙ্গে আমার সখ্যতা বা অশুভযোগ যেটাই বলি না কেন, সেটা দশ বছরের ওপরে। ফারুক হোসেনের সমসাময়িক বলা যায়। এ রোগ হলে একদিন দুদিনের নয়, একেবারে পনেরো দিনের ধাক্কা। এবারের ধাক্কা সামলাতে ফারুক হোসেনের বেশ বেগ পোহাতে হলো। একা হাতে মেয়েকে খাওয়ানো পড়ানো, গোসল করানো, স্কুলে নিয়ে যাওয়া, নিয়ে আসা, সেই সঙ্গে আমার যত্ন নেওয়া তো আছেই। অবশ্য, বাড়তি আশীর্বাদ হিসেবে ছিল শারমিন ভাবি, সুইটি, নুশরাত আপা আর শায়লা আপুর পাঠানো খাবার।

ফারুক হোসেন নিজেও এর মধ্যে দুদিন ডাল-সবজি, ছোলার ঘুগনি রান্না করেছে। বলতে দ্বিধা নেই, ফারুক হোসেন এখন আমার চেয়ে ভালো রান্না করে। এক হাতে রান্না, ঘর গোছানো, মেয়ে পড়ানো, সব সামলে রোজা রাখছে, আবার আমার দেখভাল করছে। আমার এই রোগের সঙ্গে আমার না যতটুকু সম্পর্ক ফারুক হোসেনের মনে হয় তার চেয়ে বেশি। তাই সারাক্ষণ আমাকে নিয়ে তটস্থ থাকে, এই বুঝি আমি মাথা ঘুরে পড়ে গেলাম।
মানুষটাকে যত ভাবি ভালোবাসব না মানুষটা ততই আমাকে আরও বেশি ভালোবাসতে বাধ্য করে। ইদানীং আমার আর নিজের মতো করে কিছু ভাবার বা বলার অবকাশ হয় না। দেখি গড়গড় করে সেই আমার সব কথা বলে যাচ্ছে করে যাচ্ছে। মনে হয় আমারই ছায়া আমার সামনে সারাক্ষণ ঘুরঘুর করছে। মাঝে মাঝে ফারুক হোসেনের মাঝে নিজের আচরণ দেখে এটাও ভাবি—আমি এত বিরক্তিকর, এত একঘেয়ে, আমাকে এবার সংশোধন হতেই হবে। নতুবা আমারই বিরক্তিকর আচরণ ফারুক হোসেনের মধ্যে দেখতে হবে।
সৈয়দ শামসুল হকের ‘পরানের গহীন ভিতর’-এ কবিতার এক লাইন আমার মনে ভীষণ দাগ কেটেছিল সেই কিশোরী বয়সেই—‘মানুষ এমনভাবে বদলায়া যায়।’ আমার জীবনে এই লাইনের প্রভাব এত তীব্রভাবে পড়বে তখন বুঝিনি। আমি আর ফারুক হোসেন মন মানসিকতার দিক দিয়ে ছিলাম দুই মেরুর মানুষ। এই দুই মেরুর দুই রোখা মানুষ কখন কীভাবে যে এক মেরুর হয়ে গেলাম বুঝতেই পারলাম না। এখন এমন হয়েছে, সকালে রাগারাগি হলে বিকেলে আর মনে থাকে না সকালের রাগের কথা। অথচ একটা সময় আমরা মান-অভিমানের পাল্লায় সমপরিমাণ বাটখারা নিয়ে দিনের পর দিন অবিচল থাকতাম। যদিও ভালোবাসার অভাব তখনো ছিল না, অভাব ছিল সমঝোতার। মাঝে মাঝে মনে হয় হঠাৎ করেই আমরা বড় হয়ে গেছি, বুঝতে শিখে গেছি। তবে হ্যাঁ, তখনকার মান-অভিমানের পরিসমাপ্তিও কিন্তু কম উপভোগ্য ছিল না। শেষ মুহূর্তের আবেগ অনুভূতিতে ছিল একটা সিনেমা সিনেমা গন্ধ।
ফারুক হোসেন আদতে মানুষ হিসেবে বিনয়ী ও স্বল্পভাষী। তার মতো সৎ মানুষ আজ অবধি আমি খুব কম দেখেছি। আসলে ফারুক হোসেন শুধু আমার ‘বর’ নয়, সে হলো একই সঙ্গে আমার বন্ধু ও বর ‘বন্ধুবর’।
ফারুক হোসেনের কথা অনেক হয়েছে। আমি এবার আমার পুরোনো কথায় ফিরে আসি, মানে বিনাইন প্যারোক্সিসমাল পজিশনাল ভার্টিগোতে। রোগটা এমন পীড়াদায়ক এক রোগ যা নিমেষের মধ্যে একজন সুস্থ মানুষকে বিছানাগত করে ফেলে। মাথা ফেল তো সব ফেল। মাথা ঘোরার এমন কিম্ভূতকিমাকার ব্যামো আছে, নিজের না হলে আমার জানাই হতো না। ঢাকা শিশুপার্কে ঘূর্ণিপাক বলে একটা রাইড আছে। অল্প সময়ের জন্য ওই রাইডে উঠতে ভালো লাগলেও সারাসময় আমি ঘরের মধ্যে ঘূর্ণিপাকের মতো ঘুরছি, এটা কী আর উপভোগ করার মতো বিষয়। এ যেন মাথার মধ্যে সুনামি-সাইক্লোন বয়ে যাওয়ার অবস্থা। পার্থক্য শুধু এটুকুই যে, মাথার এই মহা দুর্যোগ থেকে কোনো উদ্ধারকর্মী আমাকে উদ্ধার করতে পারে না। এ রোগ স্বয়ংক্রিয়ভাবে আসে আবার স্বয়ংক্রিয়ভাবেই চলে যায়।
এই ফাঁকে রোগের শুরুর ইতিহাসটা একটু বলি। বছর দশেক আগের কথা। গ্রীষ্মের গা গুলানো এক ভ্যাপসা গরমের সকালে চোখ খুলেই দেখলাম আমিসহ আমার তামাম দুনিয়া ১৮০ কিলোমিটার গতিবেগে ঘূর্ণমান। মুহূর্তের মধ্যে চোখ বন্ধ করে হাতের কাছে যা পেলাম শক্তপোক্তভাবে ধরে থাকলাম। কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর মনের ভ্রম ভেবে ফের চোখ খুলতে গিয়ে বুঝলাম এটা মনের ভ্রম নয়, এটা মাথার ভয়ংকর কোনো ব্যামো। মাথা আমার, শুধু বিগড়েছে বললে ভুল হবে, সেটা দেখি চরকির মতো ঘুরছে। শয্যা থেকে সজ্জা কোনো কিছুই আর আমার নিয়ন্ত্রণে রইল না।
অবশেষে সন্ধ্যানাগাদ আমার বোন নিলা ও বান্ধবী রীতা মিলে বন্ধু শরিফুল ও হাসান মামার সহযোগিতায় কাঁটাবনের পাঁচতলা বাসা থেকে কোনোরকমে নামিয়ে নিয়ে গেল ধানমন্ডির পপুলারে। সেখানে অপেক্ষমাণ রোগীদের লম্বা লাইনের তোয়াক্কা না করে হুইল চেয়ারে করে অনেকটা পড়িমরি অবস্থায় আমাকে নিয়ে গেল নিউরো সার্জন অধ্যাপক ডা. কনক কান্তি বড়ুয়া স্যারের রুমে। স্যার এখন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য।
এখনো মনে পড়লে হাসি পায়। আমার বেগতিক অবস্থা দেখে স্যার তৎক্ষণাৎ যে কথাটি বলেছিলেন—‘রোগের ইতিহাস ভূগোল বর্ণনা করেন’। এমন বেহাল দশার মধ্যেও শরিফুল মুচকি হেসে বলেছিল, স্যার রোগী ভূগোলে আর রোগীর এই বোন ইতিহাসে পড়ে। কথাটা শুন স্যার নিজেও চমকে গিয়েছিলেন। তারপর স্যার যে কাজটা করলেন, একটা ছোট্ট হাতুড়ি দিয়ে আমার দুই হাঁটুতে গোটা তিন চার বারি দিলেন ঠকঠক করে।
আমি অবশ্য বুঝে উঠতে পারছিলাম না। সমস্যা মাথায়। স্যার হাঁটুতে কী করেন!
অতপর স্যার বললেন, এতটুকু মেয়ের এত কীসের চিন্তা।
মুহূর্তে যেন আমার মাথায় বিদ্যুৎ খেলে গেল। হাতুড়ি পেটানোর সঙ্গে নিশ্চয় মাথার যোগ আছে। তা না হলে স্যার কীভাবে বুঝলেন আমি এত চিন্তা করি। মনে মনে বললাম, এ জন্যই স্যার নামজাদা ডাক্তার আর আমি নামসর্বস্বহীন সামান্য রোগী।
দ্বিতীয় ফলোআপের সময় স্যারের প্রথম প্রশ্ন ছিল, চিন্তা কি কমেছে। তিন সপ্তাহ বাদেও কী করে উনি মনে রাখলেন, সে ভাবনাও আমাকে ভাবিয়েছিল। পরে মনে হয়েছিল এমন অসুখ হলে যদি এত বড় একজন ভালো মানুষের সান্নিধ্য পাওয়া যায়, তবে এমন অসুখ মাঝে মাঝে হলে দোষের কিছু নয়। কিন্তু, এবারের ভোগান্তি সত্যি আর নিতে পারছি না। একে তো দেশের বাইরে কোনো প্রিয়জন কাছে নাই, তার ওপর ফারুক হোসেনের পড়ার ক্ষতি। শেষমেশ ফারুক হোসেনের পিএইচডি মানে ‘পাইনি হাতে ডিগ্রি’ করে তো আর দেশে ফেরা যাবে না, ডিগ্রি করেই ফিরতে হবে। কথা দিচ্ছি ফারুক হোসেন, সামনের দিনগুলোতে রাত জেগে তোমার পড়ার সঙ্গী হতে পারি আর নাই পারি, তোমার ডিগ্রির অংশীদার হয়ে তবেই আমরা দেশে ফিরবই, ইনশা আল্লাহ।

লাভলী ইয়াসমীন: গজফোর্ড, নিউ সাউথ ওয়েলস, অস্ট্রেলিয়া।