বন্ধুর প্রশংসা করুন

বন্ধুহীন হয়ে পৃথিবীতে বাঁচা চায় না। বন্ধুত্ব এমন এক জিনিস যেটা ধর্ম, বর্ণ, সংস্কৃতি, বয়স—সবকিছু উড়িয়ে দিয়ে মানুষকে এক কাতারে নিয়ে আসে। বন্ধুর কাছে বিশ্বস্ততা হলো আসল জিনিস। সেই সঙ্গে অন্তরের সংযোগ স্থাপন করা। বন্ধুত্ব জোর করে হয় না। আর জোর করে করার দরকার নেইও। কারণ এটা কোনো আনুষ্ঠানিক সম্পর্ক নয়। আবার রক্তের সম্পর্কও নয়। মানসিকতার মিল থাকলে কাছে-দূরের যে কেউ বন্ধু হতে পারে। বন্ধুত্বের প্রথম শর্ত, বন্ধুকে সমর্থন করা। বন্ধুর সুসময়ে-দুঃসময়ে সাহায্য করা, না পারলে সহানুভূতিতে আচ্ছন্ন আর্দ্র মন মেলে দিয়ে তাঁর কথাটুকু শোনা। বন্ধু কোনো অন্যায় কাজ করলে তাকে সেটা বুঝিয়ে বলতে হবে। কিন্তু পরিত্যাগ করা চলবে না। আর ভালো কাজ করলে অবশ্যই প্রশংসা করতে হবে। কারণ আপনার সামান্য প্রশংসা তার মনে এনে দেবে আত্মবিশ্বাস, স্বস্তি আর সামনে চলার প্রেরণা।

সব বন্ধু এক রকম হয় না। বন্ধুর বাইরের চেহারা দেখে, একদিনের কথা, কিংবা একদিনের ব্যবহারের মাধ্যমে তাঁকে মূল্যায়ন করবেন না। মূল্যায়ন করুন তার দীর্ঘদিনের আচরণের ভিত্তিতে। সব বন্ধুর জীবনে চলার পথ একরকম হয় না। অনেককে নানা চড়াই-উতরাই আর সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে চলতে হয়। আমি যে স্কুলে চাকরি করি, সেখানে আমার ক্লাসের মূল যে টিচার, তিনি একজন সিঙ্গল প্যারেন্টস। মানে তাঁকে একাধারে বাবা ও মা দুই ভূমিকা পালন করতে হয়। তাঁর দিন শুরু হয় সূর্য ওঠার আগে। স্কুলে তিনি আমাদের চেয়ে দ্বিগুণ খাটেন। কারণ তাঁর দায়িত্ব ও জবাবদিহি অনেক বেশি। স্কুল থেকে বাসায় ফিরে আমরা যখন খেয়ে–দেয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিই, তখন তিনি আরেকটা চাকরি শুরু করেন। কারণ তাঁকে একা সংসার চালাতে হয়। তাই তো সেদিন আমাদের স্কুল সেক্রেটারি এসে যখন আমার টিচারকে বললেন, ‘হ্যাপি ফাদার্স ডে’ বলল, বিস্মিত হলাম না। কারণ তিনি তো নারী হয়ে একাধারে সন্তানদের মা ও বাবা দুই ভূমিকাই পালন করছেন।

বন্ধুত্বে সব সময় সুপরামর্শ দেওয়া জরুরি। এমন কোনো পরামর্শ নয় যেটা তার জন্য করা কষ্টকর। বন্ধুর মনের আবেগের উত্থান-পতন বুঝতে হবে। বন্ধু যেটা বলবে সেটা শুধু নিজের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে হবে। এমনকি নিজের জীবনসঙ্গীকেও বলা যাবে না। কারণ জীবনসঙ্গী এখানে তৃতীয় পক্ষ। সে অন্য মতবাদ কিংবা দৃষ্টিভঙ্গির মানুষ হতে পারে। তাই আপনার বন্ধুর জীবনের সমস্যা তাঁর পক্ষে উপলব্ধি করা সব সময় সম্ভব নয়। কিন্তু আপনি তো দীর্ঘদিন ধরে বন্ধুকে চেনেন, জানেন তাঁর জীবনের খুঁটিনাটি সবকিছু। আপনার জীবনসঙ্গী সেটা জানেন না। তাই তাঁকে বন্ধু সম্পর্কে কিছু বললে সাফল্যের কথাগুলি বলুন। ব্যর্থতার কথা বলে বন্ধু সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা না দেওয়াই ভালো।

পরিণত বয়সে এসে বন্ধুত্ব অনেক গভীর হয়। তখন চিন্তা শক্তির গভীরতা অনেক বাড়ে। অতি আবেগ হ্রাস পায়। কিছুদিন আগে অ্যাস্টোরিয়া ডিটমারস বুলভার্ডে এক পারলারে গেছি। আমার পাশের দুই চেয়ারে দুই বান্ধবী পাশাপাশি বসে কথা বলছিলেন। দুজনে বয়স্ক হলেও, বেশ ফিট, হালকা পাতলা আর স্মার্ট। তাঁরা তাঁদের সন্তান আর নাতি নাতনিদের নিয়ে গল্প করছিলেন। এক সময় পাশের একজন বললেন, ‘আমার মেয়ে তাঁর স্বামীকে ছেড়ে দিয়েছে। এখন সে একজন স্ত্রীর সঙ্গে বাস করছে।’ কথাটা প্রথমে শুনে একটু খটমট লাগল। পরে বুঝলাম, তাঁর মেয়ে একজন হোমোসেক্সুয়াল। প্রথমে সে একজন পুরুষের সঙ্গে থাকত। এখন সে নারীর সঙ্গে থাকে। আমেরিকায় এখন এই প্রবণতা খুব বেশি। বোঝা গেল মেয়েটির বর্তমান সিদ্ধান্ত মা পছন্দ করতে পারছেন না। যত আধুনিক হোক, তাঁরও তো কিছু জীবন দর্শন আছে। তখন তাঁর বান্ধবী বললেন, মেয়েকে তোমার কিছু বলা ঠিক হবে না। এটা তোমার মেয়ের জীবন। নট ইউর কাপ অব টি।

বন্ধুকে তাঁর মতো থাকতে দিন। যত ঘনিষ্ঠ বন্ধু হোক তাঁর ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে নাক গলাবেন না। কারণ বন্ধুত্ব এক ধরনের খোলা আকাশ। সেটাকে কুয়ার জল বানিয়ে ঘোলা করবেন না। তাতে দুজনের সম্পর্ক নষ্ট হবে। যতক্ষণ না বন্ধু বলছে, ততক্ষণে তাঁর ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে প্রশ্ন না করা ভালো। বন্ধুর চেয়ে নিজেকে কখনো শ্রেয় ভাববেন না। আর এটা ভেবে গুমরে মরার মধ্যে কৃতিত্ব নেই। কারণ কেউ আপনাকে দিব্যি দিয়ে বলেনি যে বন্ধুত্ব করতেই হবে। নানা কারণে বন্ধুত্বে কখনো ফাটল ধরে। বন্ধু ভেবে যে কথাগুলো আপনাকে বলা হয়েছিল, পরে সেটা কাউকে না বলাই নীতিবানের লক্ষণ। তাহলে বন্ধুত্ব না থাকলেও, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ তো থাকে।

শ্রদ্ধাবোধ, পরস্পরের কাজের স্বীকৃতি, প্রশংসাসূচক মন্তব্য, উৎসাহ, অনুপ্রেরণা, সমবেদনা, সান্ত্বনা বন্ধুত্বকে গভীর ও দীর্ঘস্থায়ী করে।