ফোর কিস টু দ্য স্কুল

ছবি: সংগৃহীত

‘লেখাপড়া করে যেই গাড়ী–ঘোড়া চড়ে সেই। লেখাপড়া যেই জানে সব লোক তারে মানে।’ ছোটবেলায় বহুবার কবি মদনমোহন তর্কালঙ্কারের এই কবিতার অংশ শ্লোকবাক্য হিসেবে আমার আব্বাসহ অনেক গুণীজনদের কাছে শুনেছি। আমাদের সব ভাইবোনের লেখাপড়ার হাতেখড়ি আমার আব্বার হাত ধরে। আমাদের পড়াতে বসিয়ে আব্বা আমাদের এ শ্লোকবাক্য দিয়ে স্বপ্ন দেখাতেন এবং স্বপ্ন পূরণে পড়ালেখার প্রতি মনোযোগী হওয়ার গুরুত্বকে বোঝাতেন। আবার কখনো লেখাপড়াতে অমনোযোগী হলেও আব্বা এ শ্লোকবাক্য শুনিয়ে লেখাপড়াতে বশীভূত করার চেষ্টা করতেন। তবে বলা যায়, এ শ্লোকবাক্য ছোটবেলায় আমার বেশ মনে ধরেছিল।

ছোটবেলায় আমাদের ভাইবোনদের সকালে ঘুম ভাঙানোর জন্য আব্বা আমাদের গায়ে–মাথায় হাত বুলিয়ে মদনমোহন তর্কালঙ্কারের ‘আমার পণ’ কবিতা সুর করে আবৃত্তি করতেন ‘সকালে উঠিয়া আমি মনে মনে বলি, সারা দিন আমি যেন ভালো হয়ে চলি।’ সত্যিকার অর্থে কবিতাটির মধ্যে একটা জাদু ছিল। আমরা সবাই আলসেমি ঝেড়ে সুড়সুড় করে ঘুম থেকে উঠে পড়াশোনার জন্য তৈরি হয়ে যেতাম।

আমাদের ভাইবোনদের কারও কোনো কাজে কিংবা পড়ালেখায় কখনো অপারগতা বা হতাশা প্রকাশ পেলে আব্বা কালীপ্রসন্ন ঘোষের ‘পারিব না’ কবিতাটি আবৃত্তি করতেন, ‘পারিব না এ কথাটি বলিও না আর,....একবার না পারিলে দেখো শতবার।’ নিঃসন্দেহে বলতে পারি, কবিতাটি শুনে আমি আসলেই মনে জোর পেতাম এবং কাজটা শেষ করার জন্য অনুপ্রাণিত হতাম। মা–বাবার সফল হওয়ার কলাকৌশল শেখানো এবং অনুপ্রেরণায় আমরা ভাইবোনেরা সবাই মোটামুটি লেখাপড়ায় বেশ ভালোই ছিলাম।

আমার ছোট ভাই ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজে পড়ার সময় বেশ অনেকবার আমার ক্যাডেট কলেজে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। কলেজের প্রধান ফটক পেরিয়ে বেশ একটু সামনের দিকে হেঁটে গেলেই হাতের বাঁ দিকে চোখে পড়ত বেশ একটু জায়গা নিয়ে তৈরি সাদা রঙের শিক্ষা ভবনের বিল্ডিং। বিল্ডিংয়ের ওপরের দিকে গাঢ় সবুজ রং দিয়ে লেখা কলেজটির মূলনীতি ‘সুশিক্ষিত জনই সুবিবেচক’। সকালের সোনালি রোদে লেখাটা ঝলমল করত, যা সত্যিকারেই আমার কাছে দৃষ্টিনন্দন ছিল। ওই লেখার মাঝে আমার কাছে ফুটে উঠত ক্যাডেট কলেজে ছাত্রদের চিন্তাচেতনার মানবিক উন্নয়ন সাধনে একাডেমির অঙ্গীকারের এক অভূতপূর্ব প্রচেষ্টা। অনেকবার লেখাটার দিকে তাকাতাম, লেখাটা পড়তাম, খুব ভালো লাগত লেখাটা দেখতে ও পড়তে। কেমন যেন একটা বিশেষ আলোড়ন অনুভব করতাম মনের গভীরে। নিজের মনে নিজেই ‘সুশিক্ষিত’ শব্দটাকে বিভিন্নভাবে বিশ্লেষণ করে সংজ্ঞায়িত করতাম। ‘শিক্ষিত আর সুশিক্ষিত’ শব্দ দুটির মধ্যে তফাৎ বুঝতে বেশ ভাবনায় পড়তাম। তবে আমার আব্বার আবৃত্তি ‘আমার পণ’ কবিতাটি ‘সুশিক্ষিত’ শব্দটার তাৎপর্য বুঝতে আমার কচি মনের অন্বেষণক্ষমতাকে সহজ করার জন্য যথেষ্ট সাহায্য করত।

আমি একটা সরকারি স্কুলে পড়তাম। আমার খুব ইচ্ছা হতো আমাদের স্কুলসহ যদি অন্য সব স্কুল বিল্ডিংয়ে ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজের মতো কোনো নীতিকথা বা মূলনীতি লেখা থাকত। আমার মতো অন্যান্য শিশুর মনে এতটুকু হলেও ওই নৈতিক শিক্ষা ও মূল্যবোধের তাৎপর্য জানতে কখনো ভাবনায় ডুবে যেতে হতো। কেউ না কেউ সেই বাণীতে উদ্বুদ্ধ হয়ে জীবনটাকে সেইভাবে গড়ার প্রত্যয় করত। তবে স্কুলের কারিকুলামে আমরা বেশ কিছু নীতিকথা বা উপদেশ বাণীর ভাবসম্প্রসারণ পড়েছিলাম। যেটা আমাদের দৈনন্দিন শিক্ষাচর্চার সঙ্গে প্রয়োগ ছিল না বললেই চলে। সেগুলো ছিল শুধু মুখস্থ করে পরীক্ষার খাতায় সুন্দরভাবে লিখে আসা। বাস্তব জীবনে সেই নীতি শিক্ষার যতটুকু না গুরুত্ব ছিল, তার চেয়ে অধিক গুরুত্ব ছিল পরীক্ষাতে ভালো নম্বর পাওয়ার আশায়।

কানাডায় এসে আমার মেয়েটাকে অন্টারিও প্রদেশের কিচেনার শহরের A.R. Kaufman Public School–এ ভর্তি করতে গেলাম। স্কুলের প্রবেশপথের দেয়ালে লেখা 4 Keys to the School: Caring—যত্নশীল, Responsibility—দায়িত্ব, Respect—সম্মান এবং Honesty—সততা। কোমলমতি শিশুদের অন্তরে মানবিক গুণাবলির সমন্বয়ে মনুষ্যত্বের বীজ বপনের এই অভিনব কৌশল আমাকে দারুণভাবে নাড়া দিল। মনটা আমার প্রশান্তিতে ভরে গেল এ ভেবে যে আমার ছোটবেলার স্বপ্নের স্কুলে আজ আমার মেয়েটা পড়বে। শিক্ষিত আর সুশিক্ষিতের মধ্যে পার্থক্য জানার জন্য ‘আমার পণ’ কবিতাটা নিয়ে আমার মেয়েকে আর আমার মতো করে ভাবতে হবে না।
মেয়েটা স্কুল থেকে একদিন একটা কাগজে লেখে নিয়ে এল তাদের স্কুলের কর্মীদের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের একটি তালিকা (1. Principal—অধ্যক্ষ, 2. Office Assistant—অফিস সহকারী, 3. Janitor—দারোয়ান বা পরিচারক এবং 4. Teacher—শিক্ষক)। কীভাবে একজন Office Assistant এবং Janitor স্কুলের একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হতে পারে! লেখাটা আমাকে অনেকক্ষণ আমার অতীত স্মৃতি নিয়ে ভাবিয়ে তুলল।

আমার স্কুলজীবনে আমি কখনোই একজন Office Assistant কিংবা Janitor–কে স্কুলের শিক্ষকদের পাশাপাশি সমতুল্য একজন সম্মানিত ব্যক্তি হিসেবে শিখে বা জেনে আসি নেই। আমি যে স্কুলে ক্লাস থ্রি থেকে এসএসসি পাস করেছিলাম সেই স্কুলেই আমার শিক্ষক হিসেবে প্রথম সরকারি চাকরি হয়েছিল। আমার সেই স্কুল জীবনের Janitor-কে (সেলিনা আপা) আমার শিক্ষকতা জীবনে আবার Janitor হিসেবেই পেলাম। স্কুলে পড়ার সময় ওনাকে আপা ও আপনি বলে সম্বোধন করতাম এবং উনি ছাত্রদের তুই বা তুমি বলে সম্বোধন করতেন। শিক্ষক হিসেবে স্কুলে যোগ দেওয়ার পর উনি আমাকে আপা এবং আপনি বলে সম্বোধন করলেন। আমি ওনাকে আপনি বলে সম্বোধন করতে নিষেধ করাতে উনি জিহ্বায় কামড় কেটে বলেন, ‘না, না, আপনি এখন স্কুলের ম্যাডাম। আপনাকে তুমি বলা যাবে না।’ তবে স্কুলজীবনের অভ্যাস অনুযায়ী ওনাকে আপনি বলে সম্বোধন করতেই উনি খুবই বিব্রত বোধ করতেন এবং অতিশয় বিনীতভাবে বারবার আমাকে অনুরোধ করতেন যেন উনাকে আপনির পরিবর্তে তুমি বলে সম্বোধন করি।’ হায় সেলুকাস! কী বিচিত্র পদমর্যাদা!

কার্যত মানবিক নৈতিকতা শিক্ষা দেওয়ার পদক্ষেপ শিশুকাল থেকে নিতে হবে। আমি মনে করি, প্রথম থেকেই সন্তানের আদর্শ মনোভাব গড়ার দায়িত্ব পরিবারের পাশাপাশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে গুরুত্ব দিতে হবে। তাহলে আমাদের প্রথমেই শিশুদের জন্য এমন পরিবেশ তৈরি করতে হবে, যার মাধ্যমে সঠিক শিক্ষা-দীক্ষার মাধ্যমে তাদের মধ্যে আদর্শ মানবিক গুণাবলি জাগরণের স্পৃহা আসে। পারিবারিক ও স্কুল ব্যবস্থাপনার যৌথ প্রচেষ্টায় শিশুদের লেখাপড়ার পাশাপাশি নৈতিক আদর্শের সুষ্ঠু অনুশীলনের মাধ্যমে মানবিক মূল্যবোধ গড়ে ওঠাতে হবে। তবেই–না আমাদের শিশুরা নিজেদের সুশিক্ষিত করে গড়ে তোলার প্রতি যত্নবান হবে। আমরা জানি, শিশুরাই একটি সমাজ, দেশ ও জাতির ভবিষ্যৎ কর্ণধার। সবার প্রচেষ্টায় শিশুদের মানবিক নৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত করে নৈতিকতাবোধের সার্বিক উদ্ভাসের মাধ্যমে সারা পৃথিবীতে মানবজাতির মধ্যে মানবতার গণজাগরণ আসুক, এটাই হবে আমাদের আগামী দিনের প্রত্যাশা।