ফেসবুক-ব্লক সমাচার

ছবি: গুগল

আমরা ফেসবুকে কমবেশি সবাই কারও না কারও কাছ থেকে ব্লক খাই এবং ব্লক দিই। আমি সাধারণত কাউকে ব্লক করি না, বড়জোর আনফ্রেন্ড করি। তবে কেউ পাকনা কথা বললে বা কমেন্ট করলে তাকে ব্লক করি। পাকনামি আমি দুই চক্ষে দেখতে পারি না। যা–ই হোক, আজ সিরিয়াস লেখা দিতে ইচ্ছা করছে না, হালকা কিছু বলি। আমার ব্লক হয়ে যাওয়ার পেছনের তিনটি ছোট গল্পই বরং বলি।


গল্প–১
এক বয়স্ক ভদ্রলোক আমাকে মেসেজ দিয়েছেন।
‘হালা আমি তুমার লেকার বক্ত। তুমি খুব বাল লেকো। এড মি।’
আমি কিছুক্ষণ ঝিম মেরে বসে থাকলাম। তারপর উত্তর দিলাম, ‘থ্যাংকু আংকেল।’
এর পরপরই দেখি আমি ব্লকড।

অদ্ভুত ব্যাপার, মানুষ এত অল্পতে মাইন্ড করে কেন? উনি যে আমাকে ‘হালা’ বললেন, আমার লেখাকে...কই আমি তো কিছু মনে করিনি।

গল্প–২
আমার ফ্রেন্ড রিকোয়েস্টগুলো দেখছিলাম। এর মধ্যে একজন রিকু দিয়েছেন, যাঁর সাথে আমার প্রায় ২০ জনের ওপর কমন বন্ধু। তাঁর নামটা পরিচিত লাগছে কিন্তু চেহারা চিনতে পারছি না। সাধারণত মানুষ আগে নাম ভুলে যায় কিন্তু চেহারা দেখেই চিনে ফেলে। কিন্তু আমার উল্টো ঘটনা। আমি চেহারা ভুলে যাই কিন্তু নাম মনে থাকে। তো এই ভদ্রলোক একজন সরকারি কর্মকর্তা, ভালো পজিশনে আছেন। খুব সম্ভবত আমার ক্লাসমেট বা ব্যাচমেট। অতএব আমি তাঁকে অ্যাড করলাম।

অ্যাড করার কিছুক্ষণ পরই তিনি দুটি কাজ করলেন। এক, তিনি আমাকে ‘ভলভো পানির পাইপ গ্রুপে’ অ্যাড করলেন আর দুই, আমাকে একটা মেসেজ দিলেন। সেখানে লেখা, ‘জাস্ট চিল’।

আমি কিছু মনে করলাম না। চিল করা তো আর খারাপ কিছু নয়। আমি চিল করতে থাকলাম। তার পরদিন তিনি আমাকে একটা মেসেঞ্জার গ্রুপে অ্যাড করলেন।
গ্রুপের নাম, ‘ছুটির মেলা’।

ভাবলাম এ গ্রুপে সবার নামই বোধ হয় ছুটি কিংবা ছুটি কাটানোমূলক পরিকল্পনা হয় বা হবে এমন কোনো গ্রুপ।

গ্রুপে ঢুকে আমি হতভম্ব হয়ে দেখলাম, আরও আটজন ছেলে–মেয়ে সেই গ্রুপে আছে, যাদের কারও নামই ‘ছুটি’ নয়, তাদের কাউকেই আমি চিনি না। গ্রুপে কয়েকটা পোস্টার শেয়ার করা হয়েছে, যার সবগুলোই করোনার লক্ষণ নিয়ে লেখা। মানে করোনা হলে কী করবেন, কীভাবে বুঝবেন ইত্যাদি। গ্রুপের নাম হওয়া উচিত ছিল ‘করোনার মেলা’ তা না হয়ে ‘ছুটির মেলা’ হলো কেন, বুঝলাম না।

ঘটনা এখানে শেষ হলেও হতো। কিন্তু ঘটনা শেষ হলো না। শুরু হলো সেই গ্রুপ থেকে গ্রুপ ভিডিও কল আসা, কল আসতেই থাকল। একসময় তিন–চারবার ফোন কেটে দেওয়ার পর আমি তাঁকে মেসেজ দিলাম, ‘প্লিজ, আমাকে ভিডিও বা অডিও কল দেবেন না এবং অকারণে কোনো গ্রুপে অ্যাড করবেন না। ধন্যবাদ।’

তিনি আমার মেসেজ পেয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলেন। তারপর আমার মেসেজটাতে অ্যাংরি রিএক্ট দিলেন। কিছুক্ষণ পর আমাকে ‘ছুটির মেলা’ গ্রুপ থেকে বের করে দিলেন। তারও কিছুক্ষণ পর দেখলাম, আমাকে দেওয়া ভলভো পানির পাইপ গ্রুপের রিকোয়েস্টটাও রিমুভ করেছেন এবং সবশেষে তিনি আমাকে ব্লক করে দিলেন।
বুঝলাম না, উনি এত রেগে গেলেন কেন?

গল্প–৩
কেউ আমাকে কটু কথা বললে আমার খুব মন খারাপ হয়। কিন্তু এ ঘটনায় মন খারাপ নয়, হয়েছে মেজাজ খারাপ। ফেসবুকে আমাকে কেউ কটু কথা বলবে বা অসম্মান করবে, এমন ঘটনা আসলে বিরল। কেউ আমাকে ইনবক্সে গালিগালাজ করে না, নোংরা কথা বলে না। দুঃখজনকভাবে ফেসবুকে অনেক মেয়ের স্ক্রিনশট দেখেছি, সেখানে অসম্মান, অশ্লীলতাও দেখেছি। আমার এখনো তেমন কিছু হয়নি। সে জন্য সবাইকে আমার পক্ষ থেকে আন্তরিক ধন্যবাদ।

ইনবক্সে আমাকে সাধারণত অল্প কিছু মানুষ বিরক্ত করে, সেগুলোও হয় ইনোসেন্ট পর্যায়ের। সেগুলো নিয়ে বিরক্ত হতেও আমার লজ্জা লাগে।
বিরক্তির কয়েকটা নমুনা দিই। যেমন:
-আমি দুপুরে কী খেলাম!
-আমি অস্ট্রেলিয়ায় থাকি নাকি ক্যানবেরা?

-কেউ হয়তো অস্ট্রেলিয়ায় আসার জন্য আইএলটিএসের প্রস্তুতি নিচ্ছে কিন্তু এরপর কী করণীয় জানতে চাচ্ছে? আমি কোনো সাহায্য করতে পারব কি না?
-অথবা গুড মর্নিংয়ের সঙ্গে গোলাপ ফুল বা জবা ফুলের স্টিকার;
-খুব বেশি হলে কেউ কেউ একই দিনে, একই সময়ে, তিনবার হাই লিখে পাঠায়। সেই হাইয়ের বানান হয় ‘হায়’!

ছবি: লেখক

এগুলো ছাড়া আর কোনো বিরক্তিকর মেসেজ আসে না, যা আসে, তা জরুরি। হয়তো আমার জন্য জরুরি না। তবে যে পাঠায় তার কোনো গুরুতর ঝামেলার কথা সে বলে, অতএব তার জন্য জরুরি। তো আমার বই বের হওয়ার পর একজন মেসেজ দিয়েছে। সে লিখেছে, আমি ফেসবুকে যা লিখি, তা ‘ছাতার মাথা’।

সমালোচনা হিসেবে ছাতার মাথা খুব আপেক্ষিক মন্তব্য। এর অর্থ করলে যা দাঁড়ায়, তা হলো হয় আমি অর্থহীন বিষয় নিয়ে লিখি বা যা লিখি তা অর্থহীন হয়। মেসেজটি এসেছে ফেক আইডি থেকে।

একেই দুর্বল মন্তব্য। তার ওপর যে পাঠিয়েছে, তার সেলফ এস্টিম হাঁটুর নিচে। হাঁটুর নিচে সেলফ এস্টিম নিয়ে ঘোরাঘুরি করা মানুষদের আমি মায়ার চোখে দেখি। সেলফ এস্টিম যেহেতু পুরোপুরি মানুষের জীবনের পারিপার্শ্বিকতার সঙ্গে জড়িত। অতএব লো-সেলফ এস্টিমদের সঙ্গে আমি ধৈর্য নিয়ে কথা বলি।

আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কোন লেখা ‘ছাতার মাথা’?’ সে বলল, ‘সবগুলো।’ আমি বললাম, ‘সবগুলো?’ সে বলল, ‘ইয়েস।’ আমি বললাম, ‘সব লেখা পড়েছেন?’ বলল, ‘ইয়েস, না পড়ে বলব কেন?’
তার কথায় যুক্তি আছে। সব লেখা না পড়ে সে ছাতার মাথার মতো গঠনমূলক (!) সমালোচনা করবে কেন?

আমি নিশ্চিত হওয়ার জন্য বললাম, ‘আমি লেখালেখি করি মাত্র দুই বছর, তার আগে আমি দুই লাইনের স্ট্যাটাসও ফেসবুকে দিইনি। এই দুই বছরে প্রায় দেড় শো পোস্ট করেছি, আপনি সবগুলো পড়েছেন?’ সে বলল, ‘ইয়েস, অফকোর্স।’

আমি আবার জিজ্ঞাসা করলাম, ‘প্রথম প্রথম কি আমার লেখা ছাতার মাথা মনে হতো? না এখন মনে হয়?’ সে হুট করে বলল, ‘ইয়েস ম্যাডাম’। হঠাৎ কথার মাঝখানে সে আমাকে ম্যাডাম ডাকা কেন শুরু করল, সেইটা আরেক রহস্য।

আমাদের প্রশ্নোত্তর এ পর্যায়ে চোর–পুলিশের মতো মনে হচ্ছে। নিজেকে এফবিআই এজেন্ট এজেন্ট লাগছে। আমি তার চরিত্র বোঝার চেষ্টা করছি। সেও খুব সাবধানে ইংরেজিতে এক কথায় উত্তর দিচ্ছে। সব ক্লোসড উত্তর। সে বেশি আলোচনায় যেতে চাচ্ছে না। খুব সম্ভবত তার ব্যাকগ্রাউন্ড পুলিশ, আর্মি বা ক্যাডেট কলেজে পড়া টাইপ কিছু। বেশি কথা বলা মানেই বেশি তথ্য দেওয়া। অতএব ইয়েস, নো, ভেরি গুড হলো সেফ আনসার।

আমার পরিচিত এসব ব্যাকগ্রাউন্ডের কেউ নেই, যে আমাকে গোপনে অপছন্দ করবে। তবে আমার এক কাজিন আছে পুলিশ। সে ২০ বছর আগে আমার মাকে নিয়ে বাজে মন্তব্য করেছিল। তখন আমার হাতের কাছে বিছানা ঝাঁট দেওয়ার ঝাড়ু ছিল, আমি সেটা তার দিকে ছুড়ে মেরেছিলাম। ২০ বছর পর কি সে ঝাড়ুর বাড়ির ঝাল মেটাতে আসবে? বুঝতে পারছি না।

আমি আবার বললাম, ‘একটু স্পষ্ট করে বলুন, প্রথমদিকের লেখাগুলো ছাতার মাথা ছিল, নাকি এখনকার লেখা?’ সে বলল, ‘সব।’

আমি বললাম, ‘এত দিন ধরে লেখি, এর মধ্যে আমার লেখার মান কি একটুও উন্নত হয়নি?’ সে বলল, ‘নো ম্যাডাম।’ আমি বললাম, ‘একটা মানুষ দুই বছর ধরে ছাতার মাথা লিখছে, আর আপনি দুই বছর ধরে অতি আগ্রহের সঙ্গে সেগুলো পড়ে যাচ্ছেন? কেন বলেন তো?’

এ পর্যায়ে সে চুপ করে গেল। নিজের জালে নিজেই ধরা পরে যাওয়ার মতো অবস্থা। আমি তাকে চিনি না, কিন্তু তার অসহায়ত্ব আমি বুঝতে পারছি। এ পর্যায়ে বোধ হয় তার সেলফ এস্টিম হাঁটুর নিচ থেকে গোড়ালিতে চলে এসেছে। আমি তাকে বললাম, ‘ঠিক আছে, আপনাকে আপনার সমালোচনার জন্য ধন্যবাদ। এখন থেকে আমি ছাতার মাথার বাইরে গুরুত্বপূর্ণ কিছু লেখার চেষ্টা করব, সেই পর্যন্ত আপনার কাছে দুটি অপশন আছে।’

সে প্রায় সঙ্গে সঙ্গে বলল, কী?
আমি বললাম, ‘এখন থেকে আপনি আমার পোস্টগুলো অ্যাভয়েড করবেন। সে জন্য হয় আমাকে আনফলো অথবা ব্লক করতে পারেন। অথবা এখন থেকে আমার লেখাগুলো নিয়মিত পড়বেন শুধু এইটুকু দেখার জন্য যে আমি কবে ছাতার মাথা থেকে ভালো লেখক হয়ে উঠতে পারি।’
এর কিছুক্ষণ পর সে আমাকে ব্লক করে দিল। নিজের ওপর নিজেরই মেজাজ খারাপ হলো। তাকে একটাই অপশন দেওয়া উচিত ছিল। তা হলো নিয়মিত আমার পোস্ট পড়ার অপশন। হেলায় একজন একনিষ্ঠ পাঠক হারালাম। আফসোস!!
সবাই নিজেকে নিরাপদ রাখুন। স্ব্যাস্থ্যবিধি মেনে চলুন।

পুনশ্চ

ভাবলাম লেখার সঙ্গে একটা মজার ছবি দিই। এ ছবিতে আপাতদৃষ্টে মজার কিছু নেই, তবে গভীরভাবে দেখলে দেখা যাবে, ছবিতে আমাকে সামান্য ট্যারা লাগছে। ট্যারা হওয়াটাও মজার কিছু নয়, যখন আমাদের এক চোখ আরেক চোখের চাইতে দুর্বল হয়, তখন সেই দুর্বল চোখ আমাদের মস্তিষ্ককে ইনস্ট্যান্ট মেসেজ দিতে পারে না যে সে কী দেখছে। ফলে সে যা দেখতে চায়, সেই জায়গায় ফোকাস করতে আমাদের মস্তিষ্কও তাকে সাহায্য করে না। ফলাফলে দুই চোখ দুই দিকে তাকিয়ে থাকে। অনেকটা ব্লক খাবার বা দেওয়ার মতো। ঘটনা সামান্য, কিন্তু ভুল–বোঝাবুঝিতে দুজন মানুষ একই জিনিসের দিকে দুভাবে তাকিয়ে থাকে।


*লেখক: শাহিদা আরবী ছুটি, সাইকোলজিক্যাল ইনজুরি ম্যানেজমেন্ট কাউন্সিলর, অস্ট্রেলিয়ান ফেডারেল কোর্ট, ক্যানবেরা, অস্ট্রেলিয়া