ফেসবুক কি কেবলই বন্ধু তৈরি করে?

গত ২২ জানুয়ারি প্রথম আলোতে সাংবাদিক আনিসুল হকের লেখা ফেসবুকের বন্ধু কি আসল বন্ধু? নিবন্ধটি পড়ে মনের ভেতরে অনেক প্রশ্নের উদয় হলো। আধুনিক মানুষের জীবনের সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে গেছে ফেসবুক। আমাদের জীবনে বিভিন্ন ভাবে প্রভাব বিস্তার করছে ফেসবুক। ঘরোয়া আড্ডা হোক, বন্ধুদের আড্ডা বা অফিস সব জায়গাতেই চলে আসে ফেসবুক প্রসঙ্গ।
ফেসবুকিং কি এক ধরনের নেশা?
নাকি বিনোদন?
সময় কাটানোর পথ?
এটা কি নিঃসঙ্গতা দূর করার উপায়?
আমরা কি ফেসবুকের মাধ্যমে বন্ধু তৈরি করতে পারি?
আনিসুল হক ফেসবুক বন্ধুদের সংজ্ঞা দিয়েছেন ভার্চ্যুয়াল বন্ধু হিসেবে। একটু তলিয়ে দেখলে দেখা যাবে এই ভার্চ্যুয়াল বন্ধুরা কি আদৌ কোনো বন্ধুর ক্যাটাগরি বা সংজ্ঞায় পড়ে?
ভার্চ্যুয়াল বন্ধুদের মধ্যে একটা বড় অংশ থাকে যাদের মধ্যে সামনাসামনি কখনো দেখা হওয়া তো দুরে থাক, হয়তো একে অপরের কণ্ঠস্বরও শোনেনি। ফেসবুকে আমরা নিজেদের যে ফেস অপরকে দেখাতে চাই সেটাই দেখাতে পারি।
বাহ্যিক চেহারা তো আছেই, সাজ পোশাক, মেকআপে ঢেকে, ডিএসএলআর ক্যামেরার কারসাজিতে রূপকথার এক কাল্পনিক জীবনকে অপরের সামনে তুলে ধরতে পারি। নিজেদের ভেতরের দৈন্যতা, কদর্যতাকে ঢেকেঢুকে আকর্ষণীয় রূপে উপস্থাপন করতে পারি।
বাইরের রূপ ছাড়াও ভেতরের রূপটাকে ঢেকে রাখাও সম্ভব। একজন দুঃখী, বিষণ্ন মানুষ হাসিখুশি, উৎফুল্লরূপ দেখাতে পারেন। একজন ভিতু মানুষ সাহসী রূপ দেখাতে পারেন। একজন চুপচাপ অন্তর্মুখী মানুষ কথার ফুলঝুরি ফোটাতে পারেন। আবার একজন দুর্নীতিপরায়ণ মানুষ নীতির মুখোশ এঁটে থাকতে পারেন।
দুজন মানুষের মাঝে বন্ধুত্ব হতে হলে কিছুটা হলেও মানসিক মিল থাকতে হয় বা একে অপরের প্রতি কোনো বিশেষ আচরণের বা চিন্তা ভাবনার কারণে আকৃষ্ট হতে হয়। যেখানে সঠিক মনের রূপটিই দেখা সম্ভব না, সেখানে বন্ধুত্ব তৈরি হবে কীসের ভিত্তিতে? বরং বলা যায়, ফেসবুকে মানুষ যে চরিত্রটি তৈরি করে নিজের প্রোফাইলে, সেই নির্মিত চরিত্রটির সঙ্গে আরেক নির্মিত চরিত্রের এক ধরনের পরিচয় বা ভালো লাগা তৈরি হয়। সেটাকেই হয়তো বলা হয় ভার্চ্যুয়াল বন্ধুত্ব। বন্ধুর প্রকৃত অস্তিত্ব নেই, তাই বন্ধুত্ব ও ভার্চ্যুয়াল।
একবার এক প্রফেশনাল ট্রেনিংয়ে আমাদের বলা হয়েছিল উন্নত বিশ্বে বিশেষ করে প্রযুক্তি ও বাণিজ্য, এসব ক্ষেত্রে পেশাগত ভাবে সফল হতে হলে নেটওয়ার্কিং অপরিহার্য। নতুন চাকরি পেতে, চাকরি বদল করতে চেনা জানা লোক অনেক সাহায্য করে। না ঠিক মামা, চাচা নন। স্কুল, কলেজে বা পুরোনো চাকরিতে যাদের সঙ্গে পরিচয় হয় তাদের কাছে আপনার কাজের, ব্যবহারের সুনাম থাকলে পরবর্তীতে তারাই আপনাকে অন্য চাকরি পেতে সাহায্য করবে। নতুন কোম্পানি খুললে ডেকে নিয়ে যাবে, নিজেদের স্বার্থেই নেবে। বিশেষ করে অভিজ্ঞ পদগুলোতে। স্কুল–কলেজ, কাজে পুরোনো পরিচিতদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখার জন্য ফেসবুক একটি ভালো উপায়। দূর দূরান্তে থাকা পূর্ব পরিচিত মানুষ, যাদের সঙ্গে এক ধরনের বন্ধন বা যোগসূত্র রাখা দরকার, অথচ আধুনিক, অতি ব্যস্ত জীবনে সময়ের অভাবে ফোন করা বা দেখা করা সম্ভব হয় না, তাদের মাসে ছয় মাসে একটা মেসেজ দিয়ে বা তাদের পোস্টে লাইক, কমেন্ট দিয়ে জানান দেওয়া যে আমি আপনাকে ভুলে যাইনি, অর্থাৎ তাদের স্মৃতিতে নিজেকে তরতাজা রাখা। প্রশ্ন হলো এ ধরনের সম্পর্ককে কি ঠিক বন্ধুত্ব বলা যায়? হয়তো ক্ষেত্র বিশেষে যায়, হয়তো না। একজন কাছের বন্ধুর কি আসলেই তার বন্ধুকে মাসে ছয় মাসে একটা ফোন করার সময় হয় না? এখানে সম্পর্কটা অনেকটা পারস্পরিক স্বার্থে বাঁধা। এর নামও বোধ করি ভার্চ্যুয়াল বন্ধুত্ব।
ভার্চ্যুয়াল বন্ধু তৈরির সঙ্গে সঙ্গে ফেসবুক কিন্তু ভার্চ্যুয়াল শত্রুও তৈরি করে এবং এই শত্রুতাটা ভার্চ্যুয়ালের সীমারেখা ছাড়িয়ে প্রায়শই বাস্তবেও ঢুকে পড়ে। এখানে ভার্চ্যুয়াল স্বার্থের লেনদেন চলে অবিরাম। স্বার্থগুলো বস্তু জগতের লেনদেন নয়, কিন্তু তারচেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণও নয়। ভার্চ্যুয়াল জগতে আমার মনের মাধুরী দিয়ে আঁকা আমিকে সবাই পছন্দ করুক, স্তুতি করুক এ ধরনের এক সুপ্ত আকাঙ্ক্ষা স্বাভাবিক ভাবেই আমাদের মনে কাজ করে। নিঃসঙ্গ মানুষ চায় মানুষ তার সঙ্গে যোগাযোগ করুক, কথা বলুক। জানতে চাক তার কথা। এই চাওয়া পাওয়ার লেনদেন চলে ফেসবুকে। আমার ছবিতে আপনি লাইক দিচ্ছেন, বিনিময়ে আপনার ছবিতে লাইক দেওয়াটা আমার একটা সামাজিক দায়িত্বের মধ্যে পড়ে যায়। আমাকে আপনার কোনো কারণে দরকার, বেড়ে যাবে লাইক, কমেন্টের আধিক্য। চাওয়া পাওয়ার এই সূত্র ধরে এক ধরনের সম্পর্ক, আশা তৈরি হয়। সেই আশা পূরণ না হলে সম্পর্কের অবনতি দেখা দেয়। চূড়ান্ত অবস্থায় ভার্চ্যুয়াল বন্ধু ভার্চ্যুয়াল শত্রুতে পরিণত হয়। যেহেতু জগৎটাই ভার্চ্যুয়াল, তাই এই বন্ধুত্ব তৈরি করতেও মানুষ খুব একটা বেশি ভাবে না, আবার বন্ধুত্বটাকে ছুড়ে ফেলতেও চিন্তা করে না। আর ফেসবুক বন্ধু যদি বাস্তব জগতেও বন্ধু হয়, এসব ক্ষেত্রে বাস্তব শত্রু তৈরি হওয়াও বিচিত্র না।
ফেসবুক শত্রু তৈরি হওয়ার আরেকটি বড় কারণ ঈর্ষা। আমরা নিজেদের যে রূপকথার জীবন ফেসবুক বন্ধুদের সামনে নিজ প্রোফাইলে তুলে ধরি, তারা ঠিক ততটুকুই দেখতে পায়। এমনকি বাস্তব জগতের পুরোনো বন্ধু, যাদের সঙ্গে এখন ফেসবুক ছাড়া আর কোনো যোগাযোগ নেই তারাও। তারা আমাদের ভ্যাকেশনের ছবি দেখে, সাজ পোশাক দেখে, নামীদামি রেস্টুরেন্টে খাওয়ার ছবি দেখে, ছেলেমেয়েদের, আমাদের নিজেদের বা স্বামী স্ত্রীর সাফল্যের গল্প শোনে, আমাদের ভালোবাসাবাসির গল্প শোনে, কিন্তু বাকি অর্ধেকটা দেখে না। বা অর্ধেকের বেশিটা। তারা আমাদের সন্তান নিয়ে দুশ্চিন্তা দেখে না, চাকরির বা অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতার কথা জানে না, দাম্পত্য কলহ বা অসুস্থতার খবরও পায় না, নিঃসঙ্গতার কান্না তাদের কাছে পৌঁছায় না। সাত রঙে আঁকা জীবনের সাফল্যের ছবি তাই অসফল বন্ধুর মনে হতাশার জন্ম দেয়, ঈর্ষা জাগায়। আর সেই হতাশা, ঈর্ষা থেকেও ইতি হতে পারে বন্ধুত্বের।
সুতরাং সাবধান। ভার্চ্যুয়াল জগৎ যেন বাস্তব জীবনের বন্ধুকে দুরে ঠেলে না দেয়, যেন গ্রাস না করে বাস্তবের হাসি কান্নাকে।