ফিরে আসার অনুভূতি

ছবিটি প্রতীকী
ছবি: কবির হোসেন

কিছু লিখতে গেলে যদি কলমের কালি শেষ হয়ে যায়, সেই ক্ষেত্রে লেখকের লেখার মাঝে বাধা থেকেই সৃষ্টি হয় একটি সার্থক উপন্যাস, গল্প, কবিতার। এর পেছনের ইতিহাস কজন জানেন। যদি জানতেন তাহলে বুঝতেন এর কদর কত বেশি। থাক না এসব কথা।

সাজু সব সময়ই এসব সাহিত্যিক নানা দিক সম্পর্কে গবেষণা করে। এটা রীতিমতো তার একটা নেশা হয়ে গেছে। কিছুদিন পরেই বিশ্ববিদ্যালয় প্রথম ক্লাস শুরু হবে। প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাস করার আনন্দই অন্য রকম। যা বলে প্রকাশ করা যায় না। যা–ই হোক, ক্লাসে সাজু প্রবেশ করেন সাহিত্যিক ও কবি কবি ভাব নিয়ে। প্রবেশ করতে না করতেই তার চোখে পড়ে পেছনের সারিতে। অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখছে সে কালো কেশে ঝোলানো, হাতের আঙুলের বড় বড় নখ, কাচের ফ্রেমে আবদ্ধ সানগ্লাস চোখে পরা। সামনে রয়েছে বিভূতিভূষণের ‘পথের পাঁচালী’ বইখানা। মুখের স্পষ্টতা এখনো চোখে পড়েনি। শুধু বাহ্যিক গঠনে চোখ এলিয়ে নিচ্ছে সাজু। মাঝে মাঝে হাতের স্পর্শে কেশগুলোর অবস্থান ঠিক করে নিচ্ছেন। সাজুর মনের ভেতর অন্য রকম একটা ভালো লাগা কাজ করছে। এমন অবস্থায় সাহিত্য রচনা না করলে তার সাহিত্য গবেষণাই বৃথা। সঙ্গে সঙ্গে মাথায় চলে এল কিছু কবিতার লাইন,
‘প্রথম দেখাতেই মন ভরিয়ে
কেন চোখে চোখ না রেখে
কালো মেঘের অস্পষ্টতা দিয়ে
ওই মিষ্টিমুখ রেখেছ ঢেকে।’

এমন করে কিছুদিন চলে থাকে হঠাৎ করে সাজু লক্ষ করে মেয়েটিও তাকে দেখছে। মনে হয় যেন দুজন দুজনের বহু যুগ ধরে চেনে। এরপর থেকে সাজুর মেয়েটার সম্পর্কে জানার আগ্রহটা অনেক গুণ বেড়ে যায়। হঠাৎ করেই কয়েক দিন ধরে মেয়েটা বিশ্ববিদ্যালয়ে দেখা যাচ্ছে না। কারণ, অন্য একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে সে। মেয়েটা সম্পর্কে অনেক তথ্যও জোগাড় করেছে সাজু। কিছুদিন পরে আবেগতাড়িত হয়ে সেই মেয়েটার বিশ্ববিদ্যালয় যায় সাজু। অনেক কষ্ট করে তার নাম জানল সে। তার নাম অর্পা। নাম শোনার পর থেকে সাজু যে সুখ পেয়েছে, তা প্রকাশ করার মতো না। সাজুর মনের মধ্যে যে প্রেম দোলা দিচ্ছে, তা স্পষ্ট বুঝতে পারছে সে।

সাহিত্য গবেষণায় সব সময়ই একটা কথা বলত, ভালোবাসলে নারীর মন হয়ে যায় নরম নদী আর পুরুষেরা জ্বলন্ত কাঠ। অর্পার মনকে নদীর মতো নরম করাই হচ্ছে এই মুহূর্তে সাজুর বড় প্রাপ্তি। এর মধ্যে একটা তথ্য উদ্‌ঘাটন করেছে সাজু। তাদের দুজনেই সাহিত্যপ্রেমী।

যা–ই হোক, অবশেষে অর্পার বিশ্ববিদ্যালয়ের আঙিনায় সাজু। কিন্তু কীভাবে এত অজানা মেয়ের মধ্যে থেকে অর্পাকে সে খুঁজে পাবে। শুধু কি ওই হাতের আঙুলের বড় বড় নখ, কাচের ফ্রেমে আবদ্ধ সানগ্লাস কিংবা হাতে বিভূতিভূষণের ‘পথের পাঁচালী’ বই।
তার বিশ্বাস, ১৪ ফেব্রুয়ারিতেই সে অর্পাকে খুঁজে পাবে। তখন সাজুর মনে বেজে ওঠে,
‘তুমি কোথায় আছ অর্পা
একটিবার দাও দেখা
এ সাজু তোমাকে ছাড়া
বড় একা।’

ইদানীং অর্পাকে আর তার বিশ্ববিদ্যালয়ে দেখা যায় না। নতুন বিশ্ববিদ্যালয়জীবনে তেমন কোনো বন্ধুবান্ধব হয়ে উঠেছি তার। তাই কারও খোঁজখবরও কেউ জানে না। সাজু অর্পাকে না দেখতে পেয়ে সে অস্তির হতে পড়ল। কী করে সে অর্পার খবর নিতে পারবে, এ নিয়ে ভাবতে লাগল। অবশেষে সে একটা মাধ্যম খুঁজে পেয়েছে, সাজু খুব ভালো কবিতা লিখতে পারে। অবশ্য এ কবিতাই হতে পারে তার বড় একটা মাধ্যম অর্পাকে খুঁজে বের করার। তাই সে অর্পার বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে সব শিক্ষার্থীর কাছে কবিতা প্রচার করে, প্রতিটি কবিতাই অর্পাকে উৎসর্গ করা এবং পাশেই করা নিজের নম্বরটা লেখা থাকত। অনেক দিন কেটে গেল কিন্তু তার সামনে অর্পা নামক কোনো মেয়ে এসে দাঁড়ায়নি কিংবা ফোনও করেনি। এভাবেই চলতে লাগল বহুদিন একদিন রাস্তার পাশে কয়েকজনকে কবিতা দিচ্ছিল সাজু। হঠাৎ পেছন থেকে একটা গাড়ি ধাক্কা দেয় সাজুকে। পায়ে প্রচণ্ড ব্যথা পায় সাজু। এর জন্য তাকে তিন-চার দিন হাসপাতালের থাকতে হয়। যেদিন হাসপাতাল থেকে ফিরে আসবে সাজু, সেই দিনই ঘটে এক অবাস্তব ঘটনা।

পাশের রুম থেকে রোগীর সিরিয়াল কল করা হচ্ছে, তখনই অর্পার নামটি শুনতে পায় সাজু। দৌড়ে পাশের রুমে যায় অদৃশ্য অর্পাকে দেখার জন্য। কিন্তু ডাক্তার তাকে বাধা দিয়ে বলে, আপনি কে? সাজু বলে রোগীর পরিবারের সদস্য। প্লিজ ডাক্তার আমাকে একটু দেখতে দেন। ডাক্তার অবাক হয়ে বলেন এসব আপনি বলছেন! অর্পার পরিবারে আমি ছাড়া ওর আপন কেউ নেই এখানে। আর আপনি বলছেন আপনি রোগীর পরিবারের সদস্য। ঠিক আছেন আপনি…? কী বলছেন আপনি ওর পরিবারের কেউ নেই? জি আমি ঠিকই বলছি, অর্পার জন্ম ছয় লন্ডনে। ওর যখন ছয় বছর বয়স। তখন পরিবারের সঙ্গে বাংলাদেশে আসে। দুর্ভাগ্যবশত ঢাকায় সে তার মা–বাবাকে হারিয়েছে। অনেক খোঁজাখুঁজির পরও তার মা–বাবার সন্ধান পাওয়া যায়নি। সেই দিন থেকে অর্পা আমার কাছেই বড় হয়েছে। আমিই ওর বাবা, আমিই ওর মা। যা–ই হোক সাজু আপনি মনে হয় অন্য কোনো অর্পার কথা বলছেন।

পরে সাজু ডাক্তারকে সবকিছু খুলে বলে। অর্পা ও আমি একই বিশ্ববিদ্যালয় পড়ি। দয়া করে আমাকে একটু দেখতে দিন। ডাক্তার তাকে অনুমতি দিল। যখন পর্দা সরিয়ে অক্সিজেন মাস্ক পরা অর্পাকে দেখল, সাজুর ভেতরটা কেমন জানি করে উঠল। পরে ডাক্তারের কাছে সে জানল তার একটা বড় অসুখ হয়েছে। সুস্থ হতে সময় লাগবে। এসব কথা না ভেবে সাজু তার প্রিয় মানুষটার পাশে গিয়ে বসল। সাজু তার হাত অর্পার হাতে রেখে কিছু সময় নীরবে বসে রইল এবং চুপি চুপি বলল, কোথায় হারালে সুন্দরী…? সাজুর হাতের স্পর্শে প্রিয়তমার শ্বাসপ্রশ্বাস কেমন জানি শীতল হয়ে আসছে। অর্পা চোখ খুলে সাজুর দিকে হালকা একটা হাসি দিল। অন্য রকম একটা ভালো লাগা কাজ করল সাজুর। কিছু সময় পর ডাক্তার আসে বলল রোগী দেখার সময় শেষ, এখন বের হতে হবে। সাজু বের হয়ে গেল এবং মনে মনে ভাবতে লাগল কালই সে অর্পাকে তার মনের কথা বলে দেবে। পরদিন সকালে এসেই শোনে এক অশুভ সংবাদ। হঠাৎ অর্পার অবস্থা খারাপ হওয়ায় তাকে দেশের বাইরে পাঠাতে হলো। অর্পা যাওয়ার সময় অপরিত্যক্ত টিস্যুতে কিছু লেখা লিখেছিল সাজুর জন্য। ডাক্তার চিঠিটা সাজুকে পড়ে শোনাল।

অর্পার লেখাগুলো ছিল এমন:
‘সাজু আশা রাখি তুমি ভালো আছ? প্রথমে আমি তোমাকে চিনতে পারিনি। কিন্তু পরে আমি তোমার নাম বহুবার শুনেছি। আমার বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে তোমার লেখা কবিতা নিয়ে আলোচনা হতো। অনেকেই বলত কে এই অর্পা, যার জন্য সাজু এত উদাসীন হয়ে আছে। তোমাকে খোঁজার জন্য অনেকবার কল করেছি, কিন্তু কোনো খবর পাইনি। তোমায় খুঁজে না পাওয়া নিয়ে একটা কবিতাও লিখেছি। অনেক কষ্ট করে তোমার বাসার ঠিকানা খুঁজে পেয়েছি। ভাবছি, ১৪ ফেব্রুয়ারি তোমাকে কবিতাটা দিয়ে বলব আমি তোমার সেই অর্পা—আমাকে গ্রহণ করো।’ অপরিত্যক্ত টিস্যুতে জায়গাস্বল্পতার কারণে আর লিখতে পারছি না। এতক্ষণে হয়তো পরবর্তী কথাগুলো তুমি জেনেছ। আমার ফিরে আশার অপেক্ষায় থেকো, প্রিয়। সবকিছু শোনার পর সাজু ব্যথিত কণ্ঠে দুটি লাইন বের হলো,
সীমান্তে আজ আমি প্রহরী
অনেক রক্তাক্ত পথ অতিক্রম করে
আজ এখানে থমকে দাঁড়িয়ে
শুধু তোমাকে পাব বলে।

সবকিছু এখানেই শেষ হতে পারত কিন্তু না এর মধ্যে পাঁচ বছর কেটে গেল। সাজু তা টেরও পায়নি। বর্তমানে দেশের খ্যাতিমান সাহিত্যিকদের একজন সাজু। হাঁটতে বের হলেই তাকে ঘিরে জটলা পাকে। তবে প্রতিবছর ১৪ ফেব্রুয়ারি সে নির্জনতায়–নিঃসঙ্গতায় কিছু সময় কাটাতে চায়। আশপাশে ফুলের আদান-প্রদান দেখে সাজুর মনে তার প্রিয় মানুষটার ছবি বেশে ওঠে। ভাবনার অন্তরালে ডুবে থাকা সাজু হঠাৎ পেছন থেকে একটা গলার আওয়াজ শুনতে পায়। প্লিজ শুনুন, এই দিকে কোথাও কি পানি পাওয়া যাবে? চোখে চোখ রাখতেই সাজু চমকে ওঠে। নিশ্চিতভাবে হাতের বোতলটা এগিয়ে দেয়। এ তো আর কেউ নয় সাজুর প্রিয় মুখ অর্পা,
দুজনে চোখে চোখ রেখে
চিরচেনা সেই রূপে মুগ্ধ আলিঙ্গনে
হারিয়ে গেল স্বপ্নের মাঝে।
দুটো মন বলে ওঠে।