ফিন রোবট, বক সিদ্ধার্থ অতঃপর মহিনের ঘোড়া

মন খারাপ হলে আমি যেন একটা যন্ত্র হয়ে যাই। সে যন্ত্র হতে পারে আমার বাসার ধুঁকে ধুঁকে টিকে থাকা সেমি বিকল ল্যান্ড ফোনটা। নম্বর চেপে কানে নিলে মাঝেমধ্যে ওপার থেকে নৈঃশব্দ-পোকামাকড়ের ড্রসোফিলান আলাপ শোনা যায়। কিংবা আমাদের ফিন নামের খেলনা রোবট, যার মন বলে কিছু নেই। রিমোটের কন্ট্রোল যেদিকে যেতে বলবে, যাবে; দরজায় ধাক্কা খাবার শোক সইতে না পেরে ধ্যানে বসে যাবে কাঠের মেঝেতে।

আমাকে বলা হলো, চার-পাঁচটা পরিবার মিলে কোথাও যাওয়ার প্ল্যান হচ্ছে। সেই কোথায়টার নাম হার্য আর তার পাহাড়। ‘অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া নিয়ে কদিন থাকলাম। একেবারে কোভিড রীতি বজায় রেখে, বাজার–সদাই, বিছানাপত্তর সঙ্গে নিয়ে। দিনের বেলা রেসট্রিকশন ফ্রি এলাকাগুলোর যেদিক যেদিক দুচোখ যাবে গেলাম, এবার তো আর তোমার দেশে যাওয়া হলো না।’

রেখে আসা পুরোনো বারান্দার প্রান্তে বসে কবেকার এই নাগরিকের আঁধার বাড়বে নির্ঘুম-নির্জনতায়। রাতের বাতাসে। মেলে দেওয়া মায়ের ওড়নার ঘ্রাণ চিনতে পারব কেবল আমিই, সেসব অনুভূতির ক্ষতিপূরণ কি আর অচেনা পাহাড়ে আর অ্যাপার্টমেন্টের ভেতর রান্নাবাটিতে হয়? লম্বা একটা নিশ্বাস নিয়ে লক্ষ করলাম, বিদ্রোহে উৎসাহ পাচ্ছি না। খুব খারাপ তো কিছু বলছে না ওরা। মনে দুঃখ বাতাস বইতে শুরু করলে নাহয় অ্যান্টেনা বসানো রোবট মিয়া ফিনই হলাম। কবাটে হোঁচট লেগে গেলে তারপর কিছুতেই না পোষালে সিদ্ধার্থের মতো নিজেকে বক ভেবে নিয়ে বাঁশবনের ওপর দিয়ে না হয় উড়ে গেলাম। কল্পনায় পাড়ি দিলাম বন পর্বত। বকের ক্ষুধায় কাতর মাছ–টাছ খেয়েও নিলাম খুব!
দ্রুত হাতে গুছিয়ে নিতে হচ্ছে এবার। নাহ্‌! বেড়াতে যাচ্ছি, নাকি গুমোট পরিস্থিতি থেকে কদিনের জন্য পালাতে যাচ্ছি, তাই নিয়ে তেমন অনুভূতি–টনুভূতি হচ্ছে না; বরং এমন দুর্দিনে আবার কোনো বিপদে পড়ি, তা–ই নিয়ে মাথার ভেতর অশান্তি। আমার আসলে হু হু করে বয়স বেড়ে যাচ্ছে; এবেলা সত্যি সত্যিই বড় হয়ে গেছি। নাহলে এত দুর্ভাবনায় আচ্ছন্ন হচ্ছি কেন! হায়রে পাষাণ করোনা! তুমি আমাকেও আমার নানুর মতো টেনশন আর টেনশন-টেনে আনা টেনশনের কৃষ্ণগহ্বরে ফেলে দিচ্ছো!

২.
যাচ্ছি হার্যে। পাহাড়ে-অরণ্যে–পর্বতের আশ্রয়ে বেড়ে ওঠা কোনো লোকালয়ে। মেদহীন ছিপছিপে এক রোদের সকালবেলা আমাদের পোষা পক্ষিরাজে চড়ে। এসব সকালে যা যা থাকা দরকার, তাই–ই আছে। বাহুল্য বর্জিত। ভীষণ মাপা মাপা সৌন্দর্য বোধের ভেতর আমাদের চাকাওয়ালা পক্ষিরাজচালকের উড়াল চিন্তার খপ্পরে পড়ে হাইওয়েতে উড়ে উড়ে চলতে চায়। অন্য পরিবারগুলোও যার যার গাড়ির ভেতর আছে। বিরতিতে দেখা হবে মাস্কের আবরণে—আমরা ডিসইঙ্কফেকট্যান্টের বর্ম হাতে দিয়ে ঘরে বানানো কেক শিঙাড়া একসঙ্গে খেয়ে নেব, ছেঁড়া ছেঁড়া দ্বীপ হয়ে কফির ধোঁয়ায় দিনযাপনের পরিকল্পনা করব।
শহরের বাঁক পেরোতেই ফসলের মাঠে মৃদু বাতাসের আনাগোনা। ঘরের গভীর কিংবা নোনা ধরা দেয়ালের লুকানো ফোঁকর থেকে তুলে আনা দুশ্চিন্তায় চিন্তিত আমার নানুর আত্মা নেমে গিয়ে পুরোনো আমিটা ফিরে এলো তখন। ঝলকে ঝলকে ওঠা পেশির শরীরে কতগুলো ঘোড়া এদিক–সেদিক হাঁটছে, মুখ ডুবিয়ে খড় বিচালি খাচ্ছে। আপন মাঠ চেঁচেঁ সেথা বেড়ানো বুঝি আহা একেই বলে! আমি আনমনে বললাম, অস্ফুট;
–এরাই মহিনের ঘোড়াগুলো। এরাই।
- মহিন কে? আউট অব নো হোয়ার তুমি কার কার কথা যে বল!
হৃদয়পুরের দেখা নেই, সান্ত্বনা বনগাঁও

হামবুর্গ থেকে হার্য অত দূরে না। সমভূমি থেকে পার্বত্যাঞ্চলে যাওয়ার কারণে গন্তব্যের নিলাদ্রি উঁকি দিচ্ছিল থেকে থেকে। হার্য পর্বতমালা মোটামুটি নিদারযাক্সেন, যাক্সেন আনহালট আর থুরিঙ্গা স্টেটজুড়ে আছে। ঘণ্টা তিনেক ব্যক্তিগত ডিসটেন্সের যাক্সনি আনহালটে যাচ্ছিলাম আমরা। মাঝে কেবল একটা ফিলিং স্টেশনে আধা ঘণ্টার স্ন্যাক্স বিরতি নিতে হয়েছিল। আমাদের সফরসঙ্গী ছানাপোনাসমেত আরও চারটা পরিবার। আজীজ অ্যান্ড দীপা, সালাউদ্দীন অ্যান্ড পপি, হায়দার অ্যান্ড রাখি, মাহবুব অ্যান্ড হাসিনা পরিবার। আমাদের দুটো চিপমাঙ্কসহ নানা বয়সের নানা স্বভাবের সব মিলিয়ে ১১টি ছানাপোনা। কফির ঘ্রাণে চাঙা হতে হতে জমাট বেঁধে উঠছিল গল্প। অন্যান্য সময় এসব গল্প জটলার ভেতর স্বাভাবিক শ্রাব্যতার সীমার ভেতর হতো, এখন দুই হাত দূরে দাঁড়িয়ে কেমন জোরে জোরে। পপি ভাবির আনা ডালপুরিতে কামড় বসাতে বসাতে খবর পেলাম রাখী ভাবি সারপ্রাইজ দেবেন আমাদের দুপুরে। দীপা ভাবি পাউন্ড কেকের থালা নেওয়ার সময় জানালেন ‘অত কফি খেয়ে খেয়ে পেট ভরে ফেলো না ঝুমি! (আমাকে শুধু উনি না, অনেকেই ঝুমি ডেকে স্বচ্ছন্দ) ফ্লাস্কে দুধমালাই চা আছে কিন্তু, এই বলে দিলাম!’
এ রকম টংঘরের মতো বাংলা চা অনেক দিন পর পেটে পড়েছে। আরামে চোখ প্রায় বন্ধ হয়ে আসছিল বারবার। আধবোজা চোখেই দেখছিলাম যাবতীয় ফুল–পাখি–লতাপাতা, পুকুর ছোট নদী বুনোহাঁস, পেতে রাখা সবুজের শতরঞ্চি, মহিনের ঘোড়া সবকিছু সঙ্গে নিয়ে দূরের নীল পাহাড়ের দিকে এগোচ্ছি। যেহেতু অন্যান্য সময়ের মতো অত গুগল–টুগল ঘেঁটে কোথায় যাচ্ছি প্রবৃত্তি ছিল না খুঁজে দেখার, তাই একবার ভাবলাম হয়তো হৃদয়পুরে যাচ্ছি।

তবে জার্মান হৃদয়ে একটা “e” থাকে (Herz) আর ফলকে লেখা হার্যে আছে “a” (Harz)। এ ফারাকের কারণে অল্পের জন্য হৃদয়পুর নামের কোনো জায়গায় যাওয়া গেল না। গুগল জানাল হার্যকে হারযগ্যাউ বা হার্যগাও ডাকা হতো মধ্যযুগে। এটা ছিল সেসময়ের জেলা শহর। পার্বত্যাঞ্চলের পাহাড়ি বন তো আছে সেখানে। হৃদয়পুর না হলেও বনগাঁও ডাকা যেতেই পারে। টের পেলাম, আমরা আসলে যেখানে যাব, সেখানেই কেমন যেন দেশি ফ্লেভার পাওয়ার ইচ্ছা। দেশে যেতে পারছি না ভাই মেলা দিন হলো!
একসময় হাইনরিশ হাইনেকে পেয়ে যাই। হার্যের ল্যান্ডস্কেপে তার রেখে যাওয়া অদৃশ্য অস্তিত্বে-পায়ের ছাপে, কবিতায়, পাথরের ফলকে। তরুণ হাইনে নরম সবুজ আর শিলীভূত গাম্ভীর্যের ভেতর নিজেকে খুঁজে দেখতে বিভোর হয়েছিলেন হার্যে।

হাইনরিশ হাইনে ভেগ কিংবা ব্রোকেন নামগুলো স্ক্রিনে পড়তে পড়তে জানালায় চোখ যেতেই টের পেলাম পুরোনো দিনের এক সরাইখানার শহরে চলে এসেছি। দুপুর রোদে তেঁতে উঠছে না, গম গম করছে না। খুব গোছানো বন্ধ কবাটের সারি সারি সব বাড়ি। হাফ টিম্বার্ড হাউস এগুলো। দেয়ালের গায়ে দৃশ্যমান কাঠের তক্তাগুলোর লম্বা বাঁকা দাঁড়িয়ে থাকা বেশ দৃষ্টি কেড়ে নেয়। নুড়িপাথরের চৌখুপি পথ চোখে পড়ে। জনশূন্য জানালার বাগান থেকে চুল এলিয়ে দেওয়া বোগেনভিলিয়ার সঙ্গে টিউলিপ, ইংলিশ ডেইজি, টিউলিপ কিংবা ভিওলাদের দেখা মিলছে। দেখা মিলছে দেয়াল আঁকড়ে ধরা আদি ল্যাম্পপোস্টের।

নিশ্চুপ হার্য

কফিখানা যেগুলো চোখে পড়ছে জনমনিষ্যির দেখা নেই। তবে দুদিকে নিপাট নানা রঙের ইটের গায়ে লম্বা লম্বা দাগটানা কিংবা পুরোনো আদলের একেবারে যথার্থ আদলের সরাইখানাসমেত টানা রাস্তায় অল্প কিছু ব্যক্তিগত ব্যবহারের গাড়ি চলছিল। মাস্ক মুখে হাতে গোনা কিছু মানুষও চলছিল ধীরে ধীরে। সে চলায় ব্যস্ততার তেমন ছাপ নেই। হয়তো তারা আমাদের মতো সীমান্তের ভেতর একটু অবকাশের আশায় এসেছেন। অন্য বছরগুলোর মতো বাইরের দেশ থেকে পর্যটক আসতে পারেনি, আবার দেশের ভেতরের পর্যটকেরা বাইরে ছুটি কাটাতে যেতে পারছে না, তাই এই দেশের ঘাসের ডগা কিংবা শিশিরবিন্দু খুঁটিয়ে দেখে নিচ্ছে।

মন্দের ভালো তো, ভালো না? চলবে...