ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ঢাকার প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত একটি স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়। ১৯২১ সালে তদানীন্তন ব্রিটিশ ভারতের শিক্ষাব্যবস্থা অনুসরণে এটি স্থাপিত হয়। চলতি বছর ‘প্রাচ্যের অক্সফোর্ড’ খ্যাত এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০০ বছর হতে যাচ্ছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা পালনকারীদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন নবাব স্যার সলিমুল্লাহ। কিন্তু ১৯১৫ সালে নবাব সলিমুল্লাহর মৃত্যু হলে নবাব সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী এই উদ্যোগের হাল ধরেন। অন্যান্যদের মধ্যে ছিলেন আবুল কাশেম ফজলুল হক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় পূর্ব বাংলার হিন্দুরাও এগিয়ে এসেছিলেন। এঁদের মধ্যে ঢাকার বালিয়াটির জমিদার কিশোরীলাল চৌধুরী অন্যতম। জগন্নাথ হলের নামকরণ হয় তাঁর বাবা জগন্নাথ রায় চৌধুরীর নামে।
নবাব স্যার সলিমুল্লাহর দান করা ৬০০ একর জমির ওপর দাঁড়িয়ে আছে আজকের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও বুয়েট। ঢাকার ইঞ্জিনিয়ারিং বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য ১৯০২ সালে তিনি ১ লাখ ২০ হাজার টাকা দান করেছিলেন। সেই টাকায় এবং তাঁর দান করা জমিতে স্থাপিত হয়েছিল আহসানউল্লা স্কুল অব ইঞ্জিনিয়ারিং। ১৯২২ সালে যা আহসানউল্লা ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ এবং ১৯৬০ সালে আহসানউল্লা ইউনিভার্সিটি অব ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজিতে উন্নীত হয়। সেটিই এখনকার বুয়েট।
নবাব সলিমুল্লাহ ১৯১১ সালের ২৯ আগস্ট ঢাকার কার্জন হলে চার্লস বেইলির যোগদান উপলক্ষে সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে নওয়াব আলী চৌধুরীকে নিয়ে পৃথক দুটি মানপত্রে ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবি জানান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি জমিই শুধু দান করেননি, প্রধান অর্থদানকারীও ছিলেন। এতে তাঁর অর্থ ভান্ডারে ঘাটতি দেখা দিয়েছিল। শেষে সরকারের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে মহাজনদের কাছ থেকে নেওয়া ঋণ পরিশোধ করতে হয়েছিল। জমিদারি চলে গিয়েছিল কোর্ট অব ওয়ার্ডসে।
এই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এ ভর্তি পরীক্ষা দেওয়ার জন্য আমি কোনো কোচিং করিনি। ১৯৮১ সালে ভর্তি পরীক্ষা দিতে ঢাকায় এসেছি। তখন আমার নানি সিএমএইচে চিকিৎসাধীন। আমি একবেলা নানির কাছে সিএমএইচে থাকি। সেখান থেকেই প্রথমে কলা অনুষদের পরীক্ষা দিই। পরে দিয়েছি সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদে। ফল যেদিন ঘোষণা হলো, সেদিন আমার নানির রিপোর্ট এল—ক্যানসার। ভয়ে ভয়ে রোকেয়া হলে এসে শুনলাম ফল প্রকাশিত হয়েছে। এক বড় বোন জানালেন, আমি লোক প্রশাসনে সুযোগ পেয়েছি। নিজের চোখে দেখার জন্য ক্যাম্পাসে গেলাম। প্রকাশিত তালিকায় নিজের নাম দেখতে পেয়ে কত যে আনন্দিত হয়েছি।
এরপর রোকেয়া হলে নাম সংযুক্ত করা রেজিস্টার্ড বিল্ডিং আর টিএসসি, ব্যাংকে ছোটাছুটি করে ভর্তির সব কাজ শেষ করেছি। তারপর প্রথম দিন দুরুদুরু বুকে ক্লাসে গিয়েছি। নূর মুহাম্মদ মিয়া স্যার বিভাগীয় প্রধান। দোতলার এক রুমে পরিচিতি পর্ব হলো। রাজশাহী বোর্ডের মানবিকে প্রথম নূরে আলম সিদ্দিকী, কুমিল্লা বোর্ডে মানবিকে প্রথম আফরোজা সুলতানা দিপু, ঢাকা বোর্ডে মানবিকে দ্বিতীয় নায়লা সুরাইয়া, কুমিল্লা বোর্ডে পঞ্চম নাহিদ মোস্তফা। এ ছাড়া প্রায় সবাই বোর্ডের প্রথম সারিতে থাকা। নিজেকে মনে হতে লাগল কী দুর্বল এক শিক্ষার্থী। শিক্ষকদের মধ্যে যাদের ক্লাস পেয়েছি তাঁরা হলেন—মহব্বত খান, লুৎফুল হক, গিয়াসউদ্দীন, জিন্নাহ, নাজমুন্নেসা মাহতাব, আহসান হাবীব, মাহবুব রহমান, নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ প্রমুখ।
প্রথম কিছুদিন ভালো চললেও পরের বছর ১৪ ফেব্রুয়ারি থেকে বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ হয়ে গেল। অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ হওয়ার নাম হয়েছিল এরশাদ ভ্যাকেশন। যার পাল্লায় পড়ে আমরা ১৯৮৮ সালে অনার্সসহ মাস্টার্স সম্পন্ন করি। আমাদের নূরে আলম সিদ্দিকী চ্যান্সেলর গোল্ড মেডেল জয় করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে লোক প্রশাসন বিভাগে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেয়। বর্তমানে সে অস্ট্রেলিয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত। নায়লা সুরাইয়া যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী। আফরোজা সুলতানা দিপু চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক প্রশাসন বিভাগে শিক্ষকতায় যোগ দেয়। আর নাহিদ মোস্তফা জাতিসংঘের প্রোগ্রাম বিশেষজ্ঞ হয়ে আফ্রিকা কানাডা তোলপাড় করছে। শাহদীনা মোস্তফা দেশেই শিক্ষকতা করছে। আমাদের বন্ধুরা যারা দেশে আছে তাঁদের অনেকেই উচ্চ পদে আসীন।
আমরা চার বোন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষার্থী। ১০০ বছরের ইতিহাসের কিছু অংশ আমি। তাই আমিও গর্বিত। প্রাণের বিশ্ববিদ্যালয়ের সব সাথিদের জানাই শুভেচ্ছা। আর প্রয়াত শিক্ষকদের আত্মার শান্তি কামনা করি।