প্রযুক্তির আলোতে আসার আকুলতা
কোনো বীরত্বের ইতিহাস তাদের নেই। বহুকাল আগে ইউরোপীয়রা তাদের ধরে নিয়ে দাস বানাতো। দেশটার নামই দিয়েছিল ‘দ্য স্লেভ কোষ্ট’। দাসত্ব থেকে বেরিয়ে আসলেও দারিদ্র্যতা কিন্তু তাদের পিছু ছাড়েনি। প্রতিদিনের মাথাপিছু আয় মাত্র এক ডলারের কাছাকাছি। বাংলাদেশের সবচেয়ে নিম্ন আয়ের একজন মানুষের অর্ধেকেরও কম। এত কিছু খারাপ খবরের পরেও দেশটির তরুণ সমাজের মাথা তুলে দাঁড়ানোর প্রত্যয় দেখে অভিভূত হতে হয়।
দেশটির নাম টোগো। পুরো নাম টোগোলিস রিপাবলিক। আটলান্টিক মহাসাগরের কোল ঘেঁষে পশ্চিম আফ্রিকার দেশটিকে মানচিত্রে প্রথম দেখাতে মনে হতেই পারে ঘানা আর বেনিনকে দুপাশে ভাগ করে দেওয়া একটা লম্বা প্রশস্ত নদী। মানচিত্রে দেখতে যে রকমই হোক, দেশের কালো কুঁচ কুঁচে মানুষগুলোর মনটা কিন্তু নদীর মতোই সরল সোজা। ওপর মহলের সীমাহীন দুর্নীতিকে তারা যে কতটা হাসিমুখে মেনে নিয়েছে তা টের পেলাম বিমানবন্দর থেকে বের হওয়ার আগেই। প্রথমে ভেবেছিলাম ইমিগ্রেশনের কর্তা ব্যক্তিটি মনে হয় আমার বাংলাদেশি পাসপোর্ট তাই ঝামেলা করছেন। বারবার ফোনে ডাকছেন যারা আমাদের আমন্ত্রণ করে তাদের দেশে এনেছেন তাদের। অবশেষে বিমানবন্দরের বহির্গমনের শেষ দরজা পর্যন্ত আমাদের সঙ্গে আসা ব্যক্তির সঙ্গে যখন দেখা হলো রিসিভ করতে আসা সদা হাসিমাখা কৃষ্ণকলির সঙ্গে, তখন বুঝলাম আসল হেতু। আসলে সে টাকা চায়। কালো মুখের লাল লিপস্টিকে হাসিভরা সুন্দরী মেয়েটিও কর্তাব্যক্তির হাতে দিয়ে দিল কচকচে কয়েকটি নোট। দেখে মনে হলো, এটা যেন তার পাওনাই ছিল।
আমরা টোগোতে এসেছি ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের অর্থায়নে ওয়াজিয়াপ (WAZIUP) নামক একটি প্রজেক্টের ইউরোপীয় দেশসমূহের প্রতিনিধি হয়ে। আমার বাংলাদেশি প্রকৌশলী বন্ধু ড. আবদুর রহিম ইতালিয়ান কোম্পানির হয়ে এই প্রজেক্টটি সমন্বয় করছেন। আমি কাজ করছি একটি জার্মান কোম্পানির হয়ে। আমাদের সঙ্গে আছেন ফ্রান্স ও পর্তুগালের প্রতিনিধিরাও। কৃষিক্ষেত্রে আইওটি-বিগডাটা টেকনোলোজিকে কাজে লাগিয়ে সাব-সাহারান অঞ্চলের মানুষের ভাগ্য উন্নয়নই এই প্রজেক্টের প্রধান লক্ষ্য। সাগর পাড়ের বালুময় উষ্ণ দেশটির প্রকৃতির বৈরিতার মাঝে সাধারণ মানুষের বিশেষ করে তরুণ সমাজের প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে জেগে ওঠার যে অদম্য ইচ্ছা, তা চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা সত্যিই কঠিন হতো।
কম্পিউটারে কারও যখন প্রথম হাতেখড়ি, একটি ভালো ডেস্কটপ কিংবা ল্যাপটপ কেনার মতো সামর্থ্য নেই, তাতে কী হয়েছে, খুচরা যন্ত্রাংশগুলো আলাদা করে কিনলেতো দাম অনেক কম আসে। নিজেরা লাগিয়ে নিলেই হয়। কেসিং-এর দাম দেওয়ার দরকার কি! ফেলনা প্লাস্টিক বাক্সের মধ্যে রাখলেই হয়। তাতে কোনো রকমে কাজ হচ্ছে তা কিন্তু নয়, অনেক ভালোভাবেই হচ্ছে। কম্পিউটারকে যে মসৃণ টেবিলের মধ্যে রাখতে হবে, সেটা কে বলেছে। কাঠের লম্বা টুকরাগুলোকে কয়েক ইঞ্চি ফাঁকা করে বসিয়ে দিলেইতো অর্ধেক কাঠের খরচ বেঁচে যায়। তাদের কনফারেন্স রুমের টেবিলগুলোও এভাবেই বানানো। অর্থনৈতিক দৈন্যর মাঝে তাদের অতিসজ্জা যেন একেবারেই মানায় না। যতই হোক না সেটা বিদেশি টাকা। তবে তাদের উদ্ভাবনী শক্তিতে রয়েছে ঐশ্বর্য। ইউরোপিয়ান সহযোগিতা আর তার সঙ্গে উন্নত প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে তাদের কৃষিভিত্তিক উন্নয়নের যে চিন্তাধারা তা সত্যিই আমাদের জন্য অনুকরণীয়।
বিকেলের অধিবেশন চলছে। ২৫-৩০ জনের একটি দল পাঁচ ভাগে বিভক্ত হয়ে বসেছে কনফারেন্স রুমে। তারা জানাচ্ছেন নিজেদের উদ্ভাবনী চিন্তার কথা। আমরা ইউরোপ থেকে আসা দলটি তাদের সেই উদ্ভাবনগুলোকে যুগোপযোগী করে দেব। এ কথা মনে হতেই পারে, কম্পিউটার যাদের প্লাস্টিকের ঝুড়িতে তাদের আবার উদ্ভাবন! এখন কিন্তু তাদের সবার হাতেই ল্যাপটপ। তবে সেই ল্যাপটপগুলো দেখে একটা বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া গেল যে, ইউরোপের রাস্তার পাশে অতি পুরোনো ল্যাপটপের যে স্তূপ দেখা যায় তার প্রধান বাজার নিশ্চয় এই টোগো। আমার সঙ্গে যে দলটি কাজ করছিল তাদের কারও ল্যাপটপের কিবোর্ড ঠিকমতো কাজ করছিল না। তাতে অসুবিধা কী! তাদের আছে ফন্টের সফটওয়্যার। তারা মাউস দিয়ে সেটাতে কাজ করছে। একজনের মেমোরি আবার এতই কম যে, এই সফটওয়্যারটিও নিতে পারেনি। আগে থেকে নোটপ্যাডে রাখা অক্ষরগুলোকে মাউস দিয়ে কপি করে তার কম্পিউটারে লিখতে দেখে সত্যিই আমার চোখে পানি এসে গেল।
সুপেয় পানির অভাব তাদের অনেক বেশি। প্লাস্টিকের ব্যাগ বা বোতলের পানির ব্যবহার অনেকটাই অপরিহার্য। যেখানে সেখানে প্লাস্টিকের বোতল বা অন্যান্য সামগ্রী ফেলে রাখার প্রবণতা এত বেশি যে, ছোট দেশটাতে বসবাসকে আরও কঠিন করছে এই সকল পুনর্ব্যবহারের উপযোগী বর্জ্য। এই সমস্যা সমাধানের পথ নিয়ে এসেছে একটি দল। তারা বিভিন্ন এলাকায় নিজেদের বিন রেখে এসেছে। সেই বিন থাকছে কোনো একজনের নামে। যখন বিনটি পূর্ণ হয়ে যাচ্ছে তখন সে মোবাইল ফোনে একটি মিস কল দিলেই সংগ্রহকারী এসে বিনটি নিয়ে যাচ্ছে। প্লাস্টিকের এসব বর্জ্য বিক্রয়ের যে টাকা আসছে তা ভাগাভাগি করে নিচ্ছে এর সঙ্গে কাজ করা সকলেই। তাদের এই উদ্ভাবনে এখন রাস্তার বর্জ্য সহজেই পকেটের টাকায় পরিণত হচ্ছে। তবে সমস্যাটা হলো এই বিনটা পূর্ণ হলো কিনা তা সব সময় দেখার জন্য একজনকে নিয়োজিত থাকতে হচ্ছে। আবার সংগ্রহকারীও সঠিক সময়ে সঠিক বিনে পৌঁছাতে পারছে না বিনটি পূর্ণ হওয়ার প্রকৃত সময় আগে থেকেই জানা না থাকায়। জার্মান কোম্পানি ইনোটেক ২১ (INNOTEC 21) তাদের দিল আইওটি নির্ভর সমাধান। এবার তাদের কাঠের বিনের ওপরে বসানো থাকবে তারবিহীন যন্ত্রের সঙ্গে দূরত্ব মাপার সেন্সর যন্ত্র। যেটা বিনের বিভিন্ন সময়ের অবস্থা পাঠাবে শহরের কোনো অবস্থানে থাকা গেটওয়েতে। সেখান থেকে তথ্য ইন্টারনেটের মাধ্যমে চলে যাবে দূরের কম্পিউটারে। সেখান থেকে মোবাইল মেসেজের মাধ্যমে স্বয়ংক্রিয়ভাবে তথ্য যাবে সংগ্রহকারীর মোবাইল ফোনে। সময় ও শ্রম দুটোই বেঁচে গেল। তৈরি হলো অটোমেটিক বর্জ্য সংগ্রহ পদ্ধতি।
অন্য সব উদ্ভাবনী ধারণাগুলোর প্রায় সবই ছিল কৃষি উৎপাদনের ওপর। শুধু একটি দল বানিয়েছে মোবাইল ফোনের মাধ্যমে টাকা পাঠানোর নিজেদের তৈরি সহজ পদ্ধতি।
দেশের কৃষি খাত তাদের কাছে সবচেয়ে সম্ভাবনাময়। তারা এ বিষয়ে নিয়ে এসেছে অনেক তথ্য উপাত্ত। বাৎসরিক মুরগির চাহিদা ৮ হাজার টন হলেও তারা উৎপাদন করতে পারে মাত্র মাত্র দুই হাজার টন। এর প্রধান কারণ মুরগির খামারের জন্য উপযোগী প্রকৃত তাপমাত্রা কিংবা বাতাসের আর্দ্রতা জানা না থাকা। তারা বানিয়েছে এমন একটি যন্ত্র যা খামারের তাপমাত্রা জানাবে। আর একটি দলের বানানো যন্ত্র মুরগির ওজন মেপে সঠিক খাবার নিশ্চিত করবে। কৃষি জমিতে মাটির আর্দ্রতা কিংবা পুকুরের পানির সঠিক পরিমাণ জানতে বানানো পদ্ধতিগুলোতে প্রযুক্তির ছোঁয়া লাগাতে তাদের চেষ্টার কমতি নেই। ইউরোপ থেকে আসা দলটি তাদের সকল চিন্তাগুলোকে আইওটি-বিগডাটা প্রযুক্তির মাধ্যমে মোবাইল অ্যাপলিকেশনে সম্পৃক্ত করে দিল।
টোগোর তপ্ত মাটিতে অসুখী মানুষগুলোর সঙ্গে পাঁচ দিনের টানা হ্যাকাথন-‘ওয়াজিহ্যাক (WAZIHack)’ শেষে আমরা ইউরোপের পথে। কালো মুখে চকচকে সাদা দাঁতের হাসিতে আমাদের বিদায় জানাল তারা। তাদের সেই হাসি স্থায়ী হোক। বিশ্বটা এগিয়ে যাক এক সঙ্গে। এটাই প্রত্যাশা।
ফিজার আহমেদ: পিএইচডি গবেষক ও জার্মানিতে কৃষিক্ষেত্রে ইন্টারনেট অব থিংকস (আইওটি)-এর ব্যবহার বিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠানে কর্মরত।
ইমেইল: <fizar.ahmedinnotec21.de>