প্রবাসে বসে লেখক থেকে প্রকাশক হওয়ার আনন্দ-নিরানন্দের অভিজ্ঞতা

ফাইল ছবি: প্রথম আলো

দেশে (ঢাকায়) অনুষ্ঠিত একুশে বইমেলায় আমি কত সালে যে প্রথম গিয়েছি, সে কথা এখন আর মনে করতে পারছি না। তবে মেলায় যাওয়ার শুরুর দিকে যে মেলায় আমি দল বেঁধে ঘুরতে যেতাম, সে কথা বেশ মনে আছে। কখনো কখনো মেলায় যেতাম শুধু ঘুরতে, আবার কখনো কখনো যেতাম সত্যিই বই কিনতে। একুশে বইমেলা উপলক্ষে প্রকাশিত নতুন কোনো বই কিনে লেখকদের অটোগ্রাফ নেওয়ার জন্য স্টলের সামনে লাইন দিয়ে অপেক্ষা করতাম, কখন লেখক বইতে অটোগ্রাফ দেবেন, সে জন্য। কখনো কখনো স্টলের সামনে লোকজনের ভিড়ে ধাক্কাধাক্কি করে খ্যাতিমান লেখকের অটোগ্রাফ নিয়েছি। খ্যাতিমান লেখকদের অটোগ্রাফ নিতে পারলে কত যে আনন্দ পেতাম, সে কথা বলে আর বোঝানো যাবে না।

হিসাব করলে দেখা যাবে, ছাত্রজীবনে আমি সংখ্যায় বেশি বই কিনেছি খ্যাতিমান লেখক-নাট্যকার ইমদাদুল হক মিলনের। এরপর হুমায়ূন আহমেদের। এটাও ঠিক যে (আগেই বলেছি) সেসময় একা কখনো মেলায় যাওয়া হতো না। প্রতিবারই যাওয়া হতো সঙ্গে কাউকে না কাউকে নিয়ে। আর আমার কেনা পছন্দের বইটি মেলায় সঙ্গে যাকে নিয়ে যেতাম, তাকেই দিয়ে দিতাম উপহার হিসেবে। এতে আমি অসম্ভব আনন্দ পেতাম।

দেশে থাকাকালেই আমি ছাত্রজীবন থেকে লেখালেখি করেছি। সুতরাং আমাদের সময়কালের অনেকেই এখন প্রতিষ্ঠিত লেখক। তাঁরা এখনো নিয়মিত লেখালেখি করছেন। নিয়মিত বইমেলায় যান, আড্ডা দেন লেখক হিসেবে। তাঁদের কাতারে থেকে বইমেলায় আমার অংশ নেওয়ার সুযোগ হয়নি। তার আগেই চলে আসি জাপানে। তাও এটি ছিল ১৯৯১ সালের আগের কথা। জাপান আসার পর অনেক বছর আমার আর দেশে ফিরে যাওয়া হয়নি।

জাপানে প্রবাসজীবনে শখ জাগল মনে লেখক হওয়ার। দেশে ছাত্র অবস্থায় লেখালেখি করার বদৌলতেই এমন শখ জেগে ওঠা। কিন্তু জাপানের মতো যান্ত্রিক (ব্যস্ততম) দেশ, যেখানে দিনরাত মানুষ কাজ করে চলে, কাজ ছাড়া অন্য আর কিছু ভাবতে পারে না, সেই দেশে এসে আমি নিজেও হয়ে উঠেছিলাম একধরনের রোবট।

সেসময় আজকের দিনের মতো যোগাযোগের এত ভালো কোনো ব্যবস্থা ছিল না। ডাক বিভাগই ছিল আমাদের যোগাযোগের একমাত্র ভরসা। কথায় আছে, শখের তোলা আশি টাকা। তাই শখ পূরণের ইচ্ছায় বড় সেই লেখা ডাকযোগে বাংলাবাজারের এক প্রকাশকের ঠিকানায় পাঠিয়ে দিলাম। প্রকাশক আমার সেই লেখা পড়ে নিজ দায়িত্বে কম্পোজ করানোর পর এডিট করিয়ে আবার ডাকযোগে জাপান পাঠালেন আমার ঠিকানায়। সেটা আমি আবার পড়ে যেখানে এডিট করা প্রয়োজন, সেখানে এডিট করে পাঠিয়ে দিলাম দেশে প্রকাশকের ঠিকানায়। এভাবে কয়েকবার এডিট করে ডাকযোগে লেখা পাঠানোর পর চূড়ান্ত করা হয়েছিল আমার প্রথম প্রকাশিতব্য গ্রন্থটি প্রকাশের।

অমর একুশে বইমেলা
ছবি: প্রথম আলো

১৯৯৭ সালের একুশে বইমেলায় প্রকাশিত হলো আমার প্রথম গ্রন্থ ‘অনুশোচনা’। প্রকাশ করেছিলেন খ্যাতিমান প্রকাশক মজিবর রহমান খোকা। এরপর ডাকযোগে তিনি আমার জন্য এক কপি জাপানে পাঠালেন। বই পেয়ে সেকি আনন্দ হয়েছিল আমার, এখনো তা মনে পড়ে। ছাপা অক্ষরে দেখার পর লেখাটি আমি গল্প বলব না উপন্যাস বলব, বুঝতে পারছিলাম না। এমনকি কাউকে আমার প্রকাশিত এ গ্রন্থ সম্পর্কে বলতে গিয়ে থেমে যাচ্ছিলাম বারবার, এটাকে আসলে বড় গল্প নাকি উপন্যাস বলব, তাই। এর সঠিক উত্তর দিতে অভিজ্ঞ কয়েকজনের সঙ্গে আলোচনা করার পর তাঁদের পড়তে দিলাম হাতে পাওয়া বইটি। তারা আমার লেখা পড়ে বলেছিলেন এটাকে একটি উপন্যাস বলা যায়। সেই থেকে বলি আমার প্রকাশিত প্রথম উপন্যাস গ্রন্থের নাম ‘অনুশোচনা’।

যে বছর আমার প্রথম গ্রন্থ প্রকাশ হয়েছে, সে বছরই একুশে বইমেলা উপলক্ষে গ্রাম থেকে মা ঢাকা এসে গিয়েছিলেন মেলায় আমার বই কিনে আনতে। মা আমার অনুশোচনা গ্রন্থ কিনে নিয়ে গেলেন একুশের বইমেলা থেকে। এর দুই সপ্তাহ পর দেশ থেকে মায়ের লেখা চিঠি পেলাম। চিঠিতে মা লিখেছিলেন, মেলায় গিয়ে আমার বই দেখে তিনি কেঁদে ফেলেছিলেন আনন্দে। মায়ের সেদিন আরও বেশি আনন্দের কারণ ছিল, মেলার মাঠে মাইকে আমার নাম ঘোষণা করতে শুনে। মা এমন করে আমাকে চিঠি লিখেছিলেন যে মায়ের সেদিনের সেই চিঠি পড়ে আমি নিজেও আনন্দে কেঁদেছি।
দেশের বাইরে থাকার কারণে অনেক দিন বইমেলা তো দূরের কথা দেশেই যেতে পারিনি। সুতরাং অনেক ইচ্ছাকে মনের ভেতর রেখে দিয়েছিলাম ভাঁজ করে। এরপর মনে হয় আবার আমি ২০০০ সালের পর থেকে একুশে বইমেলায় জাপান থেকে দেশে গিয়ে যেতে শুরু করি। এত দিনে জাপানে আমি পুরোদমে সাহিত্যিক হতে না পারলেও লেখক-সাংবাদিক পরিচয় নিয়ে যাতায়াত শুরু করেছি সর্বত্র। ২০০৫ সালে প্রকাশিত হলো আমার মুক্তিযুদ্ধের ওপর লেখা উপন্যাস ‘পোড়া বাড়ি’। সেসময় থেকেই আমি বই প্রকাশের স্বাদ ও আনন্দ নিতে একুশে বইমেলায় বিভিন্ন প্রকাশনীর স্টলের সামনে গিয়ে দাঁড়াই।

এর কয়েক বছর পর থেকে একদম স্টলের ভেতর গিয়ে শুরু হয় আমার দাঁড়ানো। লেখক হিসেবে ভক্ত–পাঠকদের সঙ্গে ফেসবুকের বদৌলতে দেখা হতে থাকে আমার একুশে বইমেলায়। কত বড় পাগল না হলে জাপানে কাজ বন্ধ রেখে অর্থাৎ রোজগার বন্ধ রেখে, টাকা খরচ করে বইমেলায় অংশগ্রহণ করা হয় আমার। দেশে গেলেও যে খরচ আমার কম হয় না, তা–ও কিন্তু নয়। এভাবেই চলতে থাকে আমার লেখালেখি আর বইমেলায় অংশগ্রহণের পাগলামি।

এ পর্যন্ত বেশ কয়েকবার বইমেলায় অংশ নিতে পুরো মাস আমি দেশে থেকেছি। আড্ডা দিয়েছি বিভিন্ন লেখক, প্রকাশক ও ভক্তদের সঙ্গে বইমেলা প্রাঙ্গণে। ফলে নানা ধরনের অভিজ্ঞতা হয়েছে আমার গ্রন্থ প্রকাশ নিয়ে। প্রকাশকদের মধ্যে যাঁদের সঙ্গে এ পর্যন্ত আমি নিজে থেকে এগিয়ে গিয়ে বিশ্বাস করে কাজ করেছি, তাঁদের সঙ্গে কাজের ভালো কোনো অভিজ্ঞতা থলিতে জমা হয়নি। তাই ২০২০ সালের শেষ দিকে এসে নিজেই প্রকাশনার কাজ শুরু করি। এর আগেও দুবার দেশে বিবেক নামে প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান শুরু করেছিলাম, কিন্তু নিজে দেশে উপস্থিত না থাকলে যা হওয়ার তা–ই হয়েছিল। দুবারই প্রতিষ্ঠানের কর্মকাণ্ড বন্ধ করে দিতে হয়েছে আমাকে। এবার আবার নতুন করে নতুন আঙ্গিকে যাত্রা শুরু করা।

এ বছর অন্যবারের তুলনায় অনেকটা ভিন্নভাবে প্রস্তুতি নিয়ে কাজ শুরু করেছি, যে কারণে মনে হলো দেশে আমার একুশে বইমেলায় অংশ নেওয়াটা খুব জরুরি, তাই নানা জনের সঙ্গে পরামর্শ করে মেলায় স্টল দেওয়ার আশায় আমি আবেদন করলাম। এ পর্যন্ত কাজ করার পর জাপান বসে মেলায় স্টল পাওয়া না পাওয়া বিষয়ে আমি আর কোনো খোঁজখবর নিতে পারছিলাম না। এমনকি মেলায় স্টল পেলাম কি না, সে বিষয়েও জানতে পারছিলাম না। একপর্যায় আমি আশা ছেড়েই দিয়েছিলাম, স্টল হয়তো পাইনি বা আর পাব না।

মেলা শুরুর মাত্র দুদিন আগে, অর্থাৎ একদম শেষ সময় জানতে পারি যে এবার মেলায় বিবেকের স্টল দেওয়ার সুযোগ পেয়েছি। অর্থাৎ লটারিতে বিবেক সুযোগ পেয়েছে। তাই দ্রুত কাজে হাত দিয়ে এক রাতের মধ্যে স্টল ডেকোরেশন করার সব কাজ সম্পন্ন করার ব্যবস্থা করি। তখনো আমি জানি না, মেলা চালাবে কে বা কীভাবে চালানো হবে? আমি দেশে নেই, দেশে আমি যাব কি যাব না, সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছি তখনো। মাথায় আমার এ নিয়ে কোনো কিছু আর খেলছিল না। শেষ পর্যন্ত মেলার শুরুর দিন লোক নিয়োগ দিয়ে মেলা শুরু করার ঘোষণা দিই ফেসবুকে।

ভেবেছিলাম মেলার শুরু থেকে আমি দেশে গিয়ে স্টলে থাকব, মেলার কাজ নিজেই তদারকি করব। কিন্তু মেলার শেষ দিন পর্যন্ত দেশে যাওয়ার মতো পরিবেশ-পরিস্থিতি আর তৈরি করতে পারিনি। এ জন্য মনে আমার প্রচুর কষ্ট রয়ে গেছে।

এ বছর একুশে বইমেলা ফেব্রুয়ারি মাসের মাঝামাঝি সময়ে শুরু করে মার্চের ১৭ তারিখ পর্যন্ত চালানো হয়েছে। ১৭ মার্চ হচ্ছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মদিন। বলা হচ্ছে, প্রথম আমার গ্রন্থ প্রকাশকালে আমি যেমন বইমেলায় অনুপস্থিত ছিলাম, তেমনই প্রকাশক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে মেলায় প্রথমবারের মতো স্টল নিয়ে তেমনিভাবে অনুপস্থিত ছিলাম। এ যে কত যন্ত্রণা, সেটি আমি ছাড়া আর কাউকে বোঝানো যাবে না। মেলা এ বছর পুরো এক মাস চলেছে, যা মেলা শুরুর দিকে পুরো এক মাস চলবে কি চলবে না, তা ধারণা করা যায়নি।

করোনাকালে এত কিছুর পরও মেলার সঙ্গে জড়িত সংশ্লিষ্ট সবার আন্তরিক প্রচেষ্টায় খুব সুন্দর ও সুষ্ঠুভাবে মেলা সম্পন্ন করতে পেরেছে এ জন্য কর্তৃপক্ষকে ধন্যবাদ জানাই। আমি প্রবাসে বসে লেখক থেকে প্রকাশক হওয়ার মাঝখানের সময়গুলো বইমেলায় কাটিয়ে যে আনন্দ আর নিরানন্দের স্মৃতি সঞ্চয় করেছি, প্রবাসে বসে সেসব স্মৃতি রোমন্থন করা ছাড়া এখন যে আমার আর কোনো উপায়ও নেই।