প্রবাসে পাসপোর্ট বিড়ম্বনা

বাংলাদেশ পাসপোর্ট
বাংলাদেশ পাসপোর্ট

প্রবাসে বাংলাদেশি যারা থাকেন, তাদের একবার হলেও বাংলাদেশ দূতাবাসের সাথে যোগাযোগ করতে হয় পাসপোর্ট নবায়নসহ নানা কারণে। আমার এই লেখাটি যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনে বাংলাদেশের দূতাবাসে পাসপোর্ট নবায়নের অভিজ্ঞতা নিয়ে লেখা।
আমি ২০১২ সালে যুক্তরাষ্ট্রে আসি উচ্চতর ডিগ্রি অর্জনের জন্য। গ্র্যাজুয়েশন শেষ করে বর্তমানে একটি সফটওয়্যার কোম্পানিতে সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কর্মরত আছি। আমার মেশিন রিডেবল পাসপোর্টের মেয়াদ শেষ হয়ে যাচ্ছে আগামী বছরের মার্চ মাসে। তাই ছয় মাস হাতে রেখেই গত মাসে পাসপোর্ট নবায়ন করার জন্য প্রস্তুতি নিলাম। খোঁজ-খবর নিয়ে যা বুঝলাম, বাংলাদেশ দূতাবাসে পাসপোর্ট নবায়ন করা অনেক সময় সাপেক্ষ ও ঝামেলাপূর্ণ একটি কাজ।
যাদের হাতে লেখা পাসপোর্ট, কিংবা যাদের এমআরপি (মেশিন রিডেবল পাসপোর্ট) আছে অথচ তার ফিঙ্গার প্রিন্ট পাসপোর্ট অফিসের সার্ভারে হারিয়ে গেছে, তাদের দূতাবাসে ফোন করে অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিতে হয়। ফোন করে অ্যাপয়েন্টমেন্ট নেওয়ার রীতি প্রমাণ করে আমাদের দূতাবাসের ব্যবস্থাপনা কতটা মান্ধাতা আমলের। বর্তমান বিশ্বে অ্যাপয়েন্টমেন্ট নেওয়ার প্রক্রিয়াটা খুব সহজ। ধরুন আপনি আধুনিক সেবা সংস্থা নামক কোনো প্রতিষ্ঠানে সাক্ষাৎ করতে চাইছেন। এই জন্য আপনি তাদের ওয়েবসাইটে যাবেন। সেখানে আগামী এক মাসের সাক্ষাৎ সময়সূচি দেখাবে। আপনি নিজের ইচ্ছা মতো একটি সময়সূচি বাছাই করবেন। ওয়েবসাইটটি তখন আপনার বাছাইকৃত সাক্ষাতের সময় আধুনিক সেবা সংস্থাকে জানিয়ে দেবে। সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াটি খুবই সহজ ও এত-দুই মিনিটেই হয়ে যায়। এই জন্য ওই সেবা সংস্থার কোনো ব্যক্তির সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করার প্রয়োজন নেই। কিন্তু আমাদের দূতাবাসের অ্যাপয়েন্টমেন্ট নেওয়ার প্রক্রিয়াটা অনেক সনাতন। দূতাবাসের একটি নির্দিষ্ট ফোন নম্বরে কল করে কথা বলতে হবে। সেই ব্যক্তি খাতা দেখে আগামীতে কোনো খালি তারিখ আছে কি না সেই অনুযায়ী সময় জানাবে। এরপর যিনি ফোন করেছেন তিনি অ্যাপয়েন্টমেন্ট পাবেন। প্রক্রিয়াটি অত্যন্ত জটিল ও সময়সাপেক্ষ। যেমন প্রায় অনেকেই দুই-তিন মাস ফোন করেও দূতাবাসের কাউকে লাইনে পান না বা কেউ ফোন রিসিভ করেন না। আমার এক সহকর্মী এক মাসে ৬০ বার কল করার পর সৌভাগ্যবশত ৬১তম বারে তাদের ফোনে পেয়েছেন। আরেক বন্ধু দুই মাস হলো কল করেই যাচ্ছেন, কিন্তু ওপাশে কেউ ফোন রিসিভ করেন না।

আল্লাহর অশেষ রহমতে আমাকে অ্যাপয়েন্টমেন্ট নেওয়ার ঝামেলায় যেতে হয়নি। প্রায় মাস খানেক হলো, যাদের এমআরপি আছে ও ফিঙ্গারপ্রিন্ট পাসপোর্ট অফিসের সার্ভার থেকে হারিয়ে যায়নি, তাদের আর সশরীরে দূতাবাসে যেতে হয় না। তাই অ্যাপয়েন্টমেন্ট নেওয়ার ভাগ্যের খেলায় আমাকে পড়তে হয়নি। কিন্তু যেহেতু এটা বাংলাদেশ দূতাবাস, এখানে কাজ করেন বাংলাদেশি মানুষ ও প্রশাসনও বাংলাদেশি, তাই ঝামেলা থেকে রেহাই নেই।
এবার আমার ঘটনাটা বর্ণনা করি। আমি ডাকযোগে সকল কাগজপত্র দূতাবাসে পাঠিয়েছিলাম। পাঠানোর আগে বহুবার চেক করেছি, কোনো কিছু মিস করেছি কিনা। অনেক বন্ধুর সঙ্গে এই বিষয়ে কথা বলেছি, অনেক ফোরামে আলোচনাও করেছি। কিন্তু কথায় আছে না, যেখানে বাঘের ভয়, সেখানে সন্ধ্যা হয়। আমার আবেদনপত্র যেদিন দূতাবাসে পৌঁছায় সেদিনই দূতাবাস থেকে একজন ফোন করে আমাকে জানান, আমি যেহেতু আবেদনপত্রে পেশা লিখেছি সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার, তাই আমাকে এর প্রমাণ হিসেবে আমার ডিগ্রির সার্টিফিকেট ও কোম্পানির অফার লেটার তাদের ফ্যাক্স করে পাঠাতে হবে। আমার আরেক সহকর্মী, যিনি দুই সপ্তাহ আগে আবেদন করেছেন, তাকে জিজ্ঞেস করলাম, তার ক্ষেত্রেও কি এই সব ডকুমেন্ট চেয়েছে কি না। ওই বন্ধু বললেন, তার এই সব ডকুমেন্ট লাগেনি। এটা প্রমাণ করে দূতাবাসের নির্দিষ্ট কোনো নিয়ম নাই। যদি কারও ভাগ্য ভালো থাকে, তবে তার কাছে তারা কোনো ডকুমেন্ট চাইবে না। তারচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, আবেদনপত্রের নিয়মাবলিতে কোথাও লেখা নাই আবেদনকারীকে পেশার প্রমাণপত্র পাঠাতে হবে।
যা হোক পড়েছি মোগলের হাতে, খানা খেতে হবে এক সঙ্গে। তাই আমি সঙ্গে সঙ্গেই ফ্যাক্স করে আমার পেশার সাপোর্টিং ডকুমেন্ট দূতাবাসে পাঠিয়ে দিলাম। আবেদনপত্রের স্ট্যাটাস চেক করার জন্য দূতাবাসের একটি ফাইল আছে (সেটাও ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে আপডেট করে দূতাবাসের কেউ একজন) যেখানে আবেদনপত্রের বর্তমান স্ট্যাটাস জানা যায়। দুই দিন পর দেখলাম, তারা ওই ফাইল আপডেট করেছে। কিন্তু আমার নামের পাশে লেখা: Need to Send Occupation Documents. অর্থাৎ আমি যে তাদের ফ্যাক্স করে ডকুমেন্টগুলো পাঠালাম, সেটা তারা পেল কিনা তা জানিই না, তার ওপর এখনো তারা আমার কাছে ওই একই ডকুমেন্ট চাচ্ছেন। এরপর আমি প্রতিদিন একই ফ্যাক্স দূতাবাসে পাঠাচ্ছি, ইমেইল করছি অথচ তাদের কোনো রিপ্লাই নেই এবং আমার আবেদনপত্রের স্ট্যাটাসেও কোনো পরিবর্তন নেই। এরপর টানা এক সপ্তাহ তাদের ফোনে চেষ্টা করেছি, কিন্তু কেউ ফোন ধরেন না। ওই ফাইল থেকেই জানতে পারলাম, দৈনিক গড়ে ৮-১০টি পাসপোর্ট নবায়নের আবেদনপত্র দূতাবাসে জমা হয়, অথচ এই ৮-১০টি আবেদনপত্রের ব্যবস্থাপনা করতে তাদের এত অব্যবস্থাপনা। তাদের কর্মদক্ষতা আমাকে সন্দিহান করে তুলল। কারণ আমেরিকার একটা মুদি দোকানও এর থেকে উন্নত মানের অনলাইনভিত্তিক সেবা প্রদান করে।
আমি দুই বছর হলো দেশে যাই না। আমার প্ল্যান ছিল পাসপোর্ট নবায়ন হয়ে গেলে নভেম্বর-ডিসেম্বরে দেশে যাব। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে ওই সময় যেতে পারব কি না তা নিয়ে আমি সন্দিহান। যদিও এতে দূতাবাসের কিছু যায় আসে না। কিন্তু আর্থিক ও মানসিক ক্ষতিটা হবে আমার। যেমন পাসপোর্ট নবায়ন হতে যত দেরি হবে, বিমানের টিকিট কিনতে হবে তত দেরি করে। ফলে বিমানের টিকিটও কমপক্ষে এক শ ডলার বেশি দিয়ে কিনতে হবে। আমার এই বছরের মোট প্রাপ্ত ছুটি হচ্ছে ১৩ দিন। যার থেকে অব্যবহৃত সর্বোচ্চ আট দিন পরের বছরে নেওয়া যাবে। আর বাকি অব্যবহৃত পাঁচ দিন নষ্ট হয়ে যাবে। আমার বেতন কাঠামো অনুযায়ী যার মূল্যমান হাজার খানেক ডলার। আমরা বাঙালিরা প্রায় সবাই বিশ্বাস করি, দেশ চলছে আল্লাহর হাতে, ঠিক তেমনি আমার কাছে মনে হয়, আমেরিকার মতো একটি উন্নত দেশেও আমাদের দূতাবাস আল্লাহই চালাচ্ছেন।