প্রবাসে দুর্গাপূজা: বৃহত্তর টরন্টোর প্রেক্ষাপট

টরন্টো ও আশপাশের শহরগুলোতে এ বছর সর্বমোট দশটি দুর্গাপূজা হয়েছে। পূজা হয়েছে সোম থেকে বৃহস্পতি (১৯ অক্টোবর থেকে ২২ অক্টোবর)। কর্মদিবস থাকলেও পুজোতে ব্যাপক ভক্ত সমাগম ছিল চোখে পড়ার মতো। প্রতিদিন সন্ধ্যায় ছিল জাঁকজমকপূর্ণ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, যেটি পুজো শেষে শনিবার পর্যন্ত অব্যাহত থাকে।
বাংলাদেশ বা ভারতের অনেকেরই হয়তো জানা নেই যে, প্রবাসে পুজো তিথি-নক্ষত্র ধরে সব সময় করা যায় না। পুজোয় ছুটি না থাকাতেই এই ঝামেলা। আগে অধিকাংশ ক্ষেত্রে সপ্তাহের ছুটির দিনেই পুজো হতো। তা তিথি-নক্ষত্র যাই হোক-না-কেন। এখনো কোনো কোনো শহরে সেভাবেই পুজো করতে বাধ্য হন উদ্যোক্তারা। জনবল কম থাকায় বা অর্থের জোগান অপ্রতুল থাকায় এটি করা ছাড়া উপায়ও থাকে না। টরন্টোতেও এক সময় তেমনটি হতো বলে জানা যায়। দিনে দিনে হিন্দু কমিউনিটির মানুষের সংখ্যা বেড়ে যাওয়াতে টরন্টোর প্রধান পুজোতে এখন সুযোগ ঘটেছে পঞ্জিকা মেনে আয়োজন করার।
এ বছর পঞ্জিকা মেনে পুজো হয়েছে বাংলাদেশ-কানাডা হিন্দু মন্দির, টরন্টো কালীবাড়ি, হিন্দু ধর্মাশ্রম ও টরন্টো দুর্গাবাড়িতে। খানিকটা এদিক-সেদিক করে অন্য যে পুজোগুলো হয়েছে সেগুলো হলো ভারত সেবাশ্রম, বঙ্গ পরিবার, বঙ্গীয় পরিষদ, বেদান্ত সোসাইটি ও আমার পুজোর আয়োজনে। এ দেশে মন্দিরগুলো বাদে সংগঠনকেন্দ্রিক পুজোগুলো সাধারণত হল ভাড়া করেই করা হয়ে থাকে। কোনো কোনো মন্দিরও সারা বছর ঘর ভাড়া করেই কাজ চালায়। তবে বিপুলায়তন নিজস্ব ভবনে বাংলাদেশ-কানাডা হিন্দু মন্দিরের আয়োজন হাজার হাজার দর্শনার্থীকে আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছে।
এবার মহালয়া দিয়ে ১২ অক্টোবর টরন্টোর প্রধান তিন মন্দিরে দুর্গাপুজোর আমেজ শুরু হয়েছে। তিনটিতেই ছিল অসামান্য টিম-ওয়ার্কের স্পর্শ। কণ্ঠ আর বাচনের নান্দনিক উপস্থাপনায় মুগ্ধ হয়েছিলেন তিন মন্দিরে উপস্থিত ধর্ম-বর্ণ-জাতি নির্বিশেষে উপস্থিত শ্রোতা-দর্শক। তিন টিমের প্রধান কুশীলব পণ্ডিত প্রসেনজিৎ দেওঘরিয়া, অরুণাভ ভট্টাচার্য, শংকর চক্রবর্তী ও অরুণাংশু হোর তাঁদের উচ্চ শিল্পমানের উপস্থাপনার জন্য প্রশংসিতও হয়েছেন। টরন্টো কালীবাড়িতে কৃষ্ণকলি সেনগুপ্তা ও বেদান্ত সোসাইটিতে সোনালি রায়ও অনুপম মহালয়া করেছেন বলে জানা যায়। তাদের মাসাধিককালের দলগত অনুশীলন মূল্যায়িত হয়েছে দর্শক-শ্রোতাদের কাছে।

পুজোর শুরু মহালয়াতে হলেও ষষ্ঠীতে হয়েছে তার চূড়ান্ত উদ্বোধন। টরন্টোতে রোববার ছিল ষষ্ঠী। সেদিন থেকেই বাংলাদেশি কমিউনিটি পরিচালিত তিনটি মন্দিরেই শুরু হয় দর্শনার্থীদের ভিড়। দশমী পর্যন্ত প্রতিদিন মন্দিরগুলোতে সহস্র মানুষের ভিড় জমেছিল। প্রতিদিন সন্ধ্যাতে ছিল জাঁকজমকপূর্ণ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। স্থানীয় শিল্পীরা ছাড়াও সেগুলোতে বাংলাদেশ ও ভারত থেকে এসে শিল্পীরা অংশগ্রহণ করেন। এ বছর পুরো পুজো পড়েছিল সপ্তাহের মাঝখানে—সোমবার থেকে বৃহস্পতিবার। তাই মন্দিরগুলোতে পুজো শেষে শুক্র ও শনিবার রাতে বিশেষ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। সকল জাতি ও ধর্মের মানুষদের জন্য মন্দিরের দ্বার ছিল উন্মোচিত। পুজো-সমাপন থেকে গভীর রাত পর্যন্ত সকল দর্শনার্থীর জন্য ছিল প্রসাদের ব্যবস্থা। উল্লেখ্য যে, বাংলাদেশ-কানাডা হিন্দু মন্দিরে প্রতিদিন দুই থেকে তিন হাজার দর্শনার্থীর প্রসাদের ব্যবস্থা করা হয়। যারা কাজের কারণে পুরো পুজোটা মিস করেছেন, ওই দুদিনে পুষিয়ে নিতে পেরেছেন তারাও।
বেশ কয়েকটি মন্দিরের উদ্যোক্তারা পুজো উপলক্ষে বিশেষ শারদীয়া ম্যাগাজিনও বের করেন। কাজটি চলছে বেশ কয়েক বছর ধরেই। দুর্গাপুজোয় বাংলাদেশি কমিউনিটি পরিচালিত তিনটি মন্দির থেকে প্রকাশিত সে ম্যাগাজিনগুলো প্রবাসে বাঙালির ভাষা ও সাহিত্যপ্রীতির উল্লেখযোগ্য নিদর্শন। বাংলাদেশ-কানাডা হিন্দু মন্দির, হিন্দু ধর্মাশ্রম ও টরন্টো দুর্গাবাড়ি থেকে প্রকাশিত পুজো ম্যাগাজিন চিন্ময়ী, নীল কমল ও দৃষ্টি দেখলে প্রবাসেও একজন বাঙালি গর্ববোধ করতে পারবেন। পাঠকেরা টরন্টো কালীবাড়ি থেকে প্রকাশিত গায়ত্রীরও প্রশংসা করে থাকেন। ওগুলো দেখলে গভীর বিস্ময়ে আপ্লুত হতে হয়। বার বার মনে হয়, প্রবাসে এমন দেড় শ থেকে দুই শ পৃষ্ঠার মুখ্যত বাংলা ভাষায় প্রকাশিত ম্যাগাজিন তারা সামাল দেন কীভাবে! কত নতুন নতুন লেখক (অধিকাংশই প্রবাসী) সেগুলোতে! গল্প-কবিতা-প্রবন্ধ-ভ্রমণকাহিনি-অভিজ্ঞতা কী থাকে না তাতে? যেমন থাকে ধর্ম-বিষয়ক লেখা, তেমনি নাস্তিক্যবাদী লেখাও সেগুলোতে ছাপা হয়। লেখকের ধর্ম, জাতীয়তা বা বয়স কিছুই তাদের কাছে বিবেচনার নয়। বিবেচ্য হয় লেখার মান। পাঁচ থেকে সাত হাজার ডলার খরচ করে তাদের এমন উদ্যোগ অবশ্যই প্রশংসার দাবিদার।

তবে বলে রাখতেই হয়, ঢাকার পত্রপত্রিকায় প্রতিদিনই বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে মন্দিরগুলোতে অবলীলায় মূর্তি ভাঙার ঘটনা ও সেগুলোর বিরুদ্ধে কোনো প্রতিরোধ বা আইনগত উদ্যোগ না থাকায় ক্ষুব্ধ টরন্টোর বাঙালি সমাজ। আর তাই, দুর্গাপুজোর বিপুল আনন্দের মাঝেও তাদের আলোচনার একটি অন্যতম বিষয় ছিল বাংলাদেশে মূর্তি ভাঙা প্রসঙ্গ। সরকারকে দায়ী করে বাংলাদেশ মাইনরিটি রাইটস অ্যালায়েন্সের (টরন্টো, কানাডা) আহ্বায়ক সংগঠক অরুণ দত্ত বলেন, দেশে ব্যাপকভাবে সংখ্যালঘু নির্যাতন চললেও সরকার কোনো দায় স্বীকার করে না। কোনো ঘটনার অদ্যাবধি কোনো বিচার তারা করে নাই। এ দিয়ে বোঝা যায় সরকার নির্যাতন-রোধে আন্তরিক নয়। টরন্টোর বাঙালি কমিউনিটির বিশিষ্ট সাংবাদিক শওগাত আলী সাগর ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, বাংলাদেশে রাজনীতির নানা বিষয় নিয়ে প্রতিনিয়তই ক্ষোভ প্রকাশ করা হলেও মন্দির ভাঙা নিয়ে প্রকাশ্যে কোনো প্রতিবাদ করা হয় না। তাহলে কি তারা এমন তৎপরতাকে সমর্থন করেন? যদি না করেন, তাহলে দেশের লেখক, বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক, শিক্ষক, শিল্পী তথা পুরো সুধী সমাজের উচিত এমন সকল ঘটনার প্রতিবাদ করা। সরকারের উচিত আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় মন্দির ভাঙার সঙ্গে জড়িতদের বিচারের আওতায় আনা।
বলে রাখা প্রয়োজন টরন্টোতে মন্দিরগুলো বাঙালি হিন্দুদের সামাজিক যোগের অন্যতম জায়গা। প্রতি মাসেই, কখনো কখনো প্রতি সপ্তাহেই সেগুলোতে লেগে থাকে কোনো না কোনো পুজো। পুজো মানেই ধর্মীয় আচারের বাইরে আরও খানিকটা সংস্কৃতি ও সংযোগ। সাংস্কৃতিক ও সামাজিক সংযোগকে তারা ধর্মের সঙ্গে যুক্ত করে অনাবিল এক বাঙালি পরিবেশ তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন মন্দিরগুলোতে।
প্রতিবারের মতো এবারের পুজোতেও কমিউনিটির মানুষেরা উপচে পড়ছেন মন্দিরগুলোতে। দর্শনার্থীদের মধ্যে বাংলাদেশের বাঙালিদের সঙ্গে ছিলেন ভারতের বিপুলসংখ্যক বাঙালিও। মন্দিরগুলোতে অন্য ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল বিপুলসংখ্যক সাংস্কৃতিক কর্মীর উপস্থিতিও ছিল লক্ষণীয়। অনেক মন্দিরে অবাঙালিদের উপস্থিতিও নজরে পড়েছে। আর এভাবেই পুজো হয়ে উঠেছিল ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলের।
সুদূর উত্তর আমেরিকাতে এসে পুজোর এই আমেজ যারা উপভোগ করেনি, তাদের পক্ষে ধারণা করাও মুশকিল কত উচ্ছলতা সেগুলোতে। নিরাপদে ধর্মীয় অনুষ্ঠান করতে পারার আনন্দ তাদের যেন মুক্ত বিহঙ্গে পরিণত করে। এ ছাড়া বহু বছর ধরে বহু উদ্যোগী মানুষের প্রয়াসে সে উদ্যোগগুলো ক্রমে ক্রমে অনেক বেশি সুসংগঠিত হয়ে উঠেছে। প্রবাসে পুজোর আয়োজনকে সফল করতে উদ্যোগী সেসব কর্মবীরের প্রতি টরন্টো বাঙালি সমাজ কৃতজ্ঞ।