প্রবাসে কেমন আছেন আমাদের বাবা মা?

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

রহমান সাহেবের ঘুম ভেঙে গেছে সেই ফজরের সময়। দীর্ঘ দিনের অভ্যাস, বিদেশে এসেও বদলায়নি। ঘুম ভেঙে গেলে আর শুয়ে থাকতে পারেন না। বিছানা ছেড়ে অজু করে নামাজ পড়লেন। তার স্ত্রী হাসিনা বেগমও উঠে ঘুম জড়ানো চোখে নামাজ পড়লেন। আর তার পরেই গিয়ে আবার গুটিসুটি মেরে শুয়ে পড়লেন। ঢাকায় এ সময় তারা দুজন একটু রং চা খেতেন দুটো বিস্কুট দিয়ে। তারপরে হাঁটতে বের হতেন। হাঁটা শেষ করে আসতে আসতেই নাতি-নাতনিদের স্কুলে যাওয়ার সময় হয়ে যায়। কিন্তু এই আমেরিকাতে তার ছেলের বাসায় তার সবকিছুই খাপছাড়া লাগে।
প্রথম দিন না বুঝে একা একা হাঁটতে বের হয়ে গিয়েছিলেন। রাস্তা পারাপারের সিগন্যাল ঠিকমতো বুঝতে পারছিলেন না। না বুঝেই বড় রাস্তার মাঝখানে বোকার মতো ভয়ে দাঁড়িয়ে কাঁপছিলেন। ভাগ্যিস তার বড় নাতি সাদমান স্কুলে যাওয়ার পথে তাকে দেখতে পেয়ে রাস্তা পার করে বাড়ি নিয়ে আসে। আর এসেই চিৎকার করে সারা বাড়ি মাথায় তোলে। দাদাকে নিয়ে ভীষণ লজ্জায় পড়ে গিয়েছে সে রাস্তায়। তা ছাড়া যদি কোনো বিপদ হতো? নাতনি আফ্রার মুখে শুনেছে এখানে নাকি অনেক সাপ আছে। বাসার জানালা দিয়ে উঁকি মারলে বড় বড় কুকুর দেখা যায়। সাপের গল্প শোনার আগে একদিন বিকেলে সাহস করে হাঁটতে বেরিয়ে তিনি আর হাসিনা পর পর দুটো ভয়ংকর কুকুরের সামনে পড়েছেন। তারপর থেকে আর হাসিনা হাঁটতে যেতে চায় না। সাপের কথা শুনে বাইরে যাওয়ার শেষ আশাটুকুও শেষ হয়ে গেল।

ঘুমন্ত হাসিনার দিকে তাকিয়ে তিনি একটু দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। কী তৃপ্তিতে ঘুমাচ্ছে। তিনি এখন আর শুয়ে থাকতে পারবেন না। চায়ের তৃষ্ণা জেগেছে। কিন্তু কে বানাবে? হাসিনা না ওঠা পর্যন্ত উপায় নাই। সারা বাড়ি এখন ঘুমাচ্ছে। তিনি উঠে পা টিপে টিপে নিচতলায় আসেন। এদের কাঠের বাড়ি। একবার শুনেছিলেন কাগজ আর ফোমও আছে নাকি। একটুতেই শব্দ হয়। ছেলে ও ছেলের বউ অক্লান্ত পরিশ্রম করে। সকালের ঘুমটুকু তাদের বড় জরুরি। তিনি অত বোঝেন না। প্রথম প্রথম সিঁড়ি দিয়ে নামতে শব্দ হতো। উঠে টিভি ছেড়ে দিতেন। দুই চার দিন পরেই ছেলে শোভন মাকে দিয়ে বলেছে, বাবা এত শব্দ করে সকালে, সাবার ঘুমের খুব ডিস্টার্ব হয়, ওর যা পাতলা ঘুম। এতক্ষণে হাসিনা বেগম সাবার মুখ ভারের রহস্য বুঝতে পেরেছেন। তাই এখন বউমা না ওঠা পর্যন্ত পা টিপে শব্দ না করে চলাফেরা করেন তারা।
নিচে এসে রহমান সাহেব জানালার পর্দা সরান। এই দিকটায় ব্যাকইয়ার্ড। ভারী সুন্দর, ছিমছাম বাগান, গালিচার মতো ঘাস। একটা ছোট ফড়িঙের মতো পাখি মধু খাচ্ছে ফুলে ফুলে। আফ্রা কী যেন একটা নাম বলেছিল হ দিয়ে, নামাটা মনে পড়ছে না। কিছুক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে থেকে বাড়ির সামনের দিকটার জানালার পর্দা তোলেন তিনি। তৃষিত নয়নে তাকিয়ে থাকেন যদি একটা মানুষও দেখা যায়। কিছুই দেখা যায় না। প্রতিবেশীদের বাড়িগুলোর সামনে সারি সারি গাড়ি। অনেকক্ষণ পরে হয়তো একজন কাউকে দেখা যাবে গাড়িতে। তার বুকের ভেতরটা খাঁ খাঁ করে। কি শূন্যতা। সাজানো গোছানো এই দেশটাকে তার অপার্থিব মনে হয়। কেমন যেন রূপকথার গল্পের মতো। রাক্ষস ধরে নিয়ে গেছে যেন সব মানুষ।
কিছুক্ষণ পরেই একে একে শোভন, সাবা, সাদমান, আফ্রা সবাই দুরদার করে নামবে। ভীষণ তাড়াহুড়া করে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দুধ বা সিরিয়াল খাবে। মুখ পুড়িয়ে চায়ে চুমুক দিয়ে সেই মগ হাতেই দৌড়াবে। আর দৌড়াতে দৌড়াতেই ছোট আফ্রার বাড়ির কাজের হিসাব, কে কাকে তুলবে, কী বাজার এই সব প্ল্যান প্রোগ্রাম করবে। তিনি বোঝেন না এরা এত দৌড়ায় কেন সারাক্ষণ? দু দণ্ড সময় নাই কারও। তিনি আসলেই এত শত বোঝেন না। না বুঝে ছেলেকে দুম করে ফোন করে বসেন, বাবা আসার সময় অরেঞ্জ জুস আনতে পারবা? মুখে কিছু স্বাদ পাই না। ছেলে তখন মিটিংয়ে। বাবার কথা শুনে ফোনের ওপাশে বিরক্তি চাপে। হাসিনার সামনে দু একবার ধরা পড়ে গেছেন। আর তারপরে হাসিনা তাকে বেশ ভালো করে ধমকে দিয়েছেন।
তুমি জান না ও কত ব্যস্ত? তুমি এই সব হাবিজাবি যা মন চায় খেতে চাও, ছেলেটা সারা দিন অফিসের পরে আবার দৌড়াতে হয়। যত বুড়ো হচ্ছ তোমার তত লোভ বাড়ছে। রহমান সাহেব লজ্জায় মিশে যান। তার মনে পড়ে অফিস ফেরত তিনিও ছেলের আবদারে কত দিন আইসক্রিম কিনতে দোকানে গেছেন। কিন্তু সে কথা বলতে পারেন না কাউকে।
হাসিনা ঘুম থেকে উঠলে তবু মনে হয় বাড়িটায় মানুষ আছে। চা বানায়, যত্ন করে রুটি ভেজে দেয়। সঙ্গে ডিম পোজ বা ভাজি। নাশতা খেয়ে তারা ঘড়ি দেখেন ঢাকায় এখন কয়টা বাজে। দেশে থাকা ছোট ছেলে রবিনকে ফোন করা যাবে নাকি। তিন বছরের নাতনিটার জন্য বড় মন পোড়ে। এখানকার নাতি-নাতনিরা বাংলা বোঝে, কিন্তু বেশির ভাগ সময় উত্তর দেয় ইংরেজিতে। সেই ইংরেজিও তারা বোঝেন না অনেক সময়। আর বাংলা বললেও কেমন যেন এলোমেলো করে বলে। তাদের কথাও ওরা পুরোপুরি বোঝে না।
দেশের সব খবর খুঁটিনাটি জানতে ইচ্ছা করে প্রতিদিন। দোতলার ভাড়াটের মেয়েটা পরীক্ষা দিয়েছে। ওর ফলাফল কেমন হলো? সামনের বাসার করিম সাহেবের কেমোথেরাপি কী শেষ হয়েছে? বুয়ার জ্বর ছিল, কমেছে? পানির ট্যাংকটা সারান হয়েছে? কখনো ঘুম জড়ানো গলায় রবিন বলে, বাবা আজকে সারা দিন বড্ড ধকল গেছে। তিনি বুঝতে পেরে ফোন নামিয়ে রাখেন। হাসিনার মুখটা কালো হয়ে যায়।
হাসিনা নিজেকে বেশ ব্যস্ত রাখে। এটার সঙ্গে সেটা মিশিয়ে রান্না করেন পাঁচ পদ। ছেলের কী পছন্দ মনে করে করে রাঁধেন। দেশ থেকে আসার আগেই ঠিক করে রেখেছেন কী কী রাঁধবেন। শুঁটকি দিয়ে বেগুন, ইলিশ মাছের পাতুরি, করলা ভাজি, ভাপা পিঠা। কিন্তু তার মন ভরে না। ছেলেটাকে প্রায় তিন বছর পর কাছে পেয়েছেন। ওরা সপ্তাহে একদিন নাকি রান্না করে। এক মুরগি আর গরুর ওপরেই আছে। কত দিন ভালো মন্দ কিছু খায় না তার ছেলেটা। কিন্তু রান্না করতে চাইলেই তো হবে না। বাজার লাগবে। সে জন্য আবার তার ছেলেকেই দৌড়াতে হবে। তিনি শনি-রোববারের আশায় বসে থাকেন। অপরাধীর মতো শুক্রবার রাতে তার সারা সপ্তাহের করা লম্বা লিস্ট তুলে দেন ছেলের হাতে। সেটা দেখে ছেলে তার চাপা একটা নিশ্বাস ফেলে বলে, এই বাজার করতে আমার পাঁচটা দোকানে যেতে হবে মা, দুটা দিনই যাবে। বিরক্ত হয় ঠিকই। তবে যায়। আর যখন খেতে বসে, তার মুখটা দেখে বোঝা যায় কত তৃপ্তি নিয়ে খাচ্ছে। এটুকুই তার শান্তি।
বউমা কঠোর ডায়েটে থাকে। মেপে মেপে খাওয়া। তার এত পদ রান্না দেখলে বিরক্ত হয়। মাঝে মাঝে লোভ সামলাতে না পেরে খেয়ে ফেলে আর তারপরই আফসোস করে বলতে থাকে, আপনি আসলেই ওজন বাড়ে মা। তা ছাড়া, আপনি যে আপনার ছেলের অভ্যাস এত নষ্ট করে দিচ্ছেন তারপরে আপনারা চলে গেলে এই ঠেলা সামলাবে কে?
বউমার কথা গায়ে মাখেন না হাসিনা। বড় সাধ হয় নাতি-নাতনিগুলো যদি তার রান্না খেত। শোভন-রবিন তো ওদের নানুর রান্নার জন্য পাগল ছিল। কিন্তু সাদমান-আফ্রা তার রান্না দেখলে পালিয়ে যায়। ঠোঁট উল্টে বলে, আর কিছু নাই? একদিন জোর করে আফ্রাকে একটা ভাপা পিঠা খাওয়াতে পেরেছিল। তখন কী যে খুশি লেগেছিল তার।
রহমান সাহেবের সময় কাটে না একেবারেই। কতক্ষণ আর নামাজ, কোরআন শরিফ পড়া যায়। দেশে অবশ্য বেশির ভাগ সময় মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়তেন। নামাজের পর সমবয়সী পাড়ার অন্যান্য ভাইদের সঙ্গে কথাবার্তা বলে দিনের বেশ বড় এটা অংশ কেটে যেত। এ ছাড়া বাজারে যেতেন তিনি। দরকার হলে দিনে দুই বার। নাতি-নাতনিদের স্কুলে আনা নেওয়া করতেন। এখানে তিনি খাঁচায় বন্দী পাখির মতো ছটফট করেন। যে কোনো খানে যাওয়ার জন্য ছেলের ওপরে নির্ভর করতে হয়। মাঝে মাঝে অফিস থেকে এসে শোভন দেখে বাবা বসে আছে চুপচাপ। লম্বা একটা ঘুম দিয়ে উঠেছে। তারপরেও পরে আছে পুরোটা বিকেল। মাগরিবের আগে রাতের খাওয়া খেতে পারে না তারা দুজন। ছেলেকে দেখে অসহায়ের মতো বলে, এত লম্বা দিন তোমাদের এখানে। কোনো দিন যদি সে একটু আগে বাসায় আসতে পারে, তার মা বাবার মুখটা কেমন ঝলমল করে। আর একটু দেরি হলে বলে, আজকে এত দেরি করলা বাবা? কী কষ্ট করে যে পয়সা কামাও তোমরা। সন্ধ্যায় কোনো মিটিং না থাকলে মাঝে মাঝে তাদের নিয়ে ওয়ালমার্ট বা কসকোতে যায় শোভন। সেখানে তাদের মতো আরও অনেক বৃদ্ধ-বৃদ্ধার সঙ্গে দেখা হয়, বেশির ভাগই ভারতীয়।
ছেলে তাদের জন্য বেশ কটি বাংলা হিন্দি চ্যানেল এনে দিয়েছে। দুপুরে মাঝে মাঝে দেখেন সেগুলো। কিন্তু এদের ফোন, রিমোট, টিভি সবই উলটা পাল্টা লাগে। সবই নাকি ইন্টারনেটে চলে, মাঝে মাঝেই তার নিজেকে বড় বেশি অচল মনে হয়। একটু পর পর নাতি-নাতনিদের ডাকতে হয় এটা ওটা দেখিয়ে দিতে। আর তারা হেসে লুটোপুটি। দাদুর ইংরেজি উচ্চারণ তাদের কাছে এক মজার জোকস। প্রথম প্রথম তো ঢাকায় ফোন করার জন্য তারা বসে থাকতেন ছেলে শোভনের জন্য। কখন শোভন আসবে, সে এসে ফোন করে দেবে।
শনিবার রাতে ওদের প্রায়ই দাওয়াত থাকে। শোভন বাবা-মাকে রেখে যেতে চায় না। রহমান সাহেব প্রথমদিকে বেশ আগ্রহ নিয়ে গিয়েছেন। কিন্তু গিয়েই বুঝতে পেরেছেন যে একটা ভুল হয়ে গেছে। এখানে দাওয়াত মানেই সাজগোজ ও খাওয়া দাওয়ার বিরাট আয়োজন। তারা এখন আর এত গুরুপাক খাওয়া খেতে পারেন না। হজমে সমস্যা হয়। বেশ গল্প-গুজবও হয়। কিন্তু যৌবনের ধর্মই তো যৌবনকে ভালোবাসা। বুড়ো-বুড়িদের সঙ্গে সবাই সালাম দিয়ে দুই একটা কথা বলে অন্যদের সঙ্গে গল্পে মেতে যায়। হাসিনা তাকে বলেছেন, তার নাকি তেমন অসুবিধা হয় না। সে আলাপী মানুষ। তা ছাড়া মেয়েরা কেমন করে করে যেন কমন টপিক খুঁজে বের করে ফেলে। বউমা তার বান্ধবীদের নিয়ে ব্যস্ত হয়ে যায়। একটু খারাপ লাগলেও পাত্তা দেয় না হাসিনা বেগম। খুঁজে খুঁজে সে ঠিকই একজন না একজন গল্পের সঙ্গী পেয়ে যায়। বরং পাঁচ ছয় দিন পরে ঘর থেকে বেরোতে পেরে সে একটু হাঁপ ছেড়ে বাঁচে। কিন্তু অভিমানী রহমান সাহেব একা একা বসে থাকেন এক কোনায়। যদি কারও বাবা আসে, তাহলে হয়তো একটু ভালো সময় কাটে। তিনি খুব গল্প করতে পছন্দ করেন। তাই মুখ বুজে বুজে ছেলের বন্ধুদের গল্পের জটলা দেখতে দেখতে ভীষণ ক্লান্ত লাগে তার। দশটা বাজতে বাজতেই অস্থির হয়ে যান বাড়ি ফেরার জন্য। তার তাড়ায় পরে মুখ অন্ধকার করে গাড়িতে উঠে নাতি-নাতনি, বউমা। ওরা নাকি সাধারণত বারোটার আগে বাড়ি ফেরে না। (চলবে)