প্রবাসে কেন এলাম

ছবি: সংগৃহীত

অনেক দিন ধরে টেলিভিশন সাংবাদিকতা করার কারণে সবকিছু ছোট করে বলা বা লেখার অভ্যাস হয়ে গেছে। তারপরও চেষ্টা করছি। ১৯৯২ সালের ১৪ অক্টোবর বাংলাদেশ বিমানে ঢাকা ছেড়েছিলাম একবুক স্বপ্ন নিয়ে। ছোটবেলায় আমার বড় ভাই দুবাইয়ের আল ফুতাইন কোম্পানির ডেটা প্রসেসিংয়ে চাকরি করতেন, সেই সুবাদে বিদেশি পারফিউম ও বড় ভাইয়ের রুমের ডানহিলের ধোঁয়ায় স্বপ্ন তৈরি হয় ও ঢাকায় সাপ্তাহিক সুগন্ধায় সাংবাদিকতা করতে গিয়ে স্বপ্নটা আরও বেড়ে যায়। স্বপ্নটা ছিল এমন যে বিদেশ গিয়ে বছর তিনেক থেকে টাকা জমিয়ে দেশে এসে ছোট একটা প্রেস কিনে নিজেই পত্রিকা বের করব, সংসার শুরু করব, দেশেই থাকব। সেই যে উড়াল দিলাম জীবন–জীবিকার তাগিদে, আজও ফেরা হয়নি।

আমি যখন সাপ্তাহিক সুগন্ধায় লিখি, তখন নির্বাহী সম্পাদক ছিলেন শ্রদ্ধেয় আলম রায়হান, অন্যদের মধ্যে ছিলেন মাসুদ কামাল, মোস্তফা কামাল, সন্তোষ শর্মা, সাগর ভাই ও লুৎফা শাহানা। আলম ভাই আমাকে ও লুৎফা শাহানাকে একই স্টোরি করার জন্য দিতেন। সাপ্তাহিক রোববারেও লিখতাম, রোববারের দায়িত্বে ছিলেন মাহবুব নিরু। মাঝেমধ্যে দৈনিক বাংলার বাণীর অফিসে গিয়ে করিম ভাই ও ওবায়দুল কাদের ভাইয়ের কাছে লেখা দিয়ে আসতাম। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও মন্ত্রী তখন বাংলার বাণীতে কাজ করতেন। তৎকালীন উদীচীর সভানেত্রী পান্না কায়সার ও হেলেন করিমের সঙ্গে অসুস্থ কমরেড মনি সিংকে দেখতে গিয়েছিলাম, সেখানে ওবায়দুল কাদের ভাইয়ের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল। তৎকালীন সাংবাদিক মানে ছিল, আদর্শের প্রতীক, খদ্দরের কুঁচকানো পাঞ্জাবি পরা, কাঁধে কাপড়ের ব্যাগ, কম দামি সিগারেট ফুঁকা, টিনের মুড়ি বাসে যাতায়াত। অনেকেই আবার দুপুরের বিশ্রামে আলুবাজারে কাঠের চৌকিতে হেলান দিয়ে ভিসিআর দেখতেন, আমিও দেখতাম।
কথা ছিল প্রবাস নিয়ে, শরতের সকালে ঢাকা ছেড়ে সাড়ে চার ঘণ্টায় মরুর দেশ আবুধাবি গিয়ে পৌঁছালাম। বাইরে তাপমাত্রা ছিল ৪০–এর ওপরে, মনে হচ্ছিল আগুনের ফুলকি বাতাসে। সেজো ভাই আবদুল কুদ্দুস খান নিতে এসেছিলেন বিমানবন্দরে। তিনিই আমার চাকরির কোম্পানি টেইলস রিয়েল স্টেটের (Taylos real estate) মালিক। বিকেল থেকেই অফিস শুরু হলো। ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানে, মানে অফিস সময় ছাড়া অফিসে বসতাম না। ভাই চাইতেন, নিজেদের ব্যবসা যেহেতু, একটু বেশি সময় দিই। কিন্তু আমি মজা পেতাম না। আমি অন্যদিকে নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর কাজে বেশি সময় দিতে থাকি। মিজানুর রহমান সাহেবের খবর পত্রিকার আমিরাত ব্যুরো চিফ হিসেবে কাজ শুরু করি। আবুধাবি বঙ্গবন্ধু পরিষদের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করি। সব মিলিয়ে মহাব্যস্ত সোশ্যাল ওয়ার্কে, চারদিকে পরিচিতি। বছর তিন এভাবে চলতে থাকলে, ভাই বিরক্ত হয়ে জার্মানিতে পাঠিয়ে দেন।

গালফ এয়ারের প্লেনটি যেদিন (৪ ফেব্রুয়ারি) ফ্রাঙ্কফুর্ট বিমানবন্দরে নেমেছিল, বাইরে তাপমাত্রা ছিল মাইনাস ১০। নেমে একা একা কোলনে ব্রুল গেলাম কিশোর ও মাহতাবের বাসায়। এখানে এসে দেখলাম, ‘কর্ম মুখ্য নয়, অর্জনই মুখ্য’। ভিন ভাষার ভিন দেশে রক্তজল পরিশ্রমে সবাই নিজেকে নির্মাণ করে। আমিও শরিক হলাম এ মিছিলে—ডুসেফড্রফ, লুটিংগেন, এসেন, রোম, ফ্রাঙ্কফুর্ট। ঘরে ফেরা আর হলো না ছোট খোকার। সাংবাদিক হয়ে জীবন–যৌবন, অস্তিত্ব—সব প্রবাসে ফেলে খোকা একাই ফিরবে হয়তো সাদা চাদরে জড়িয়ে কাঠের বাক্সে শুয়ে নীরবে।