প্রথম আলোর ২৩ বছর: স্মৃতিচারণামূলক লেখা
আজকের থেকে ঠিক ১৮ বছর আগের কথা। তখন আমি প্রথম শ্রেণিতে পড়ি। আমার শৈশবজীবনের একটি বড় অংশ কেটেছে ফরিদপুরে। শহরের প্রাণকেন্দ্রে ঝিলটুলিতে সানরাইজ প্রি–ক্যাডেট স্কুল নামের একটি কিন্ডারগার্টেন স্কুল রয়েছে। নার্সারি থেকে দ্বিতীয় শ্রেণি পর্যন্ত প্রায় তিন বছর আমি সেখানকার শিক্ষার্থী ছিলাম। ছোটবেলা থেকে আমি ছিলাম ভীষণভাবে দুরন্ত আর পাগলাটে স্বভাবের। এ জন্য আমার পরিবারের সবাই আমাকে নিয়ে ভীষণভাবে চিন্তিত থাকতেন।
আমার সঙ্গে প্রথম আলোর প্রথম পরিচয় ২০০৩ সালে, যখন আমি প্রথম শ্রেণির ছাত্র। আমার আম্মা সব সময় আমাকে স্কুলে যাওয়া-আসা করাতেন। আমাদের বাসা ছিল আলীপুরের বাদামতলী সড়কে। বাদামতলী সড়কের যে অংশে আমাদের বসবাস ছিল, সে অংশের নাম বর্তমানে পরিবর্তন করে রওশন খান সড়ক রাখা হয়েছে।
স্কুল থেকে বাসায় ফেরার পথে ছায়াবানী নামের একটি সিনেমা হল পড়ত। পরে অবশ্য এ সিনেমা হলের নাম পরিবর্তন করে কিরণ সিনেমা হল রাখা হয়। স্কুল থেকে বাসায় ফেরার সময় আম্মা প্রায়ই ছায়াবানী সিনেমা হলের কাছে একটি দোকানে এসে কিছুক্ষণের জন্য দাঁড়াতেন এবং প্রথম আলো পত্রিকা কিনতেন। এভাবে প্রথম আলোর সঙ্গে আমার পরিচয়, তখন বাইরের জগত সম্পর্কে খুব একটা ধারণা ছিল না। তাই পত্রিকার ভেতরের অংশে সেভাবে চোখ বোলাতে পারতাম না। তবে মাঝেমধ্যে পত্রিকায় প্রকাশিত বিভিন্ন নিউজ আর্টিকেল কিংবা ফিচার থেকে অংশবিশেষ আম্মা আমাকে পড়ে শোনাতেন। প্রথম আলো সে সময় সমসাময়িক বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কার্টুন ছাপাত। ছয় বছর বয়সে আমার কাছে এসব কার্টুন ছিল বিনোদনের অন্যতম প্রধান মাধ্যম যদিও তখন সেগুলোর অর্থ সেভাবে বুঝতাম না। আমার সঙ্গে আমার আম্মাও এসব কার্টুন দেখে হাসত।
আমার আম্মা ভীষণভাবে মতিউর রহমান ও মাহফুজ আনামের গুণগ্রাহী। মাহফুজ আনাম একসময় প্রথম আলো পত্রিকার প্রকাশক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। বিভিন্ন টেলিভিশন প্রোগ্রামে যখন মতিউর রহমান কিংবা মাহফুজ আনাম অতিথি হিসেবে উপস্থিত হতেন, আম্মা অত্যন্ত আগ্রহ সহকারে তাঁদের সে অনুষ্ঠান উপভোগ করতেন। আমাকেও সে সময় তিনি তাঁর সঙ্গে রাখতেন।
২০০৪ সালের শেষের দিকে আমরা সপরিবার জাপানে চলে আসি। আমার আব্বা জাপান ইন্টারন্যাশনাল রিসার্চ সেন্টার ফর অ্যাগ্রিকালচারাল সায়েন্স থেকে পোস্ট ডক্টরেট ডিগ্রি লাভের সুযোগ পেয়েছিলেন। প্রায় এক বছর আমরা সপরিবার জাপানে বসবাস করেছি। সে সময় আব্বা ইন্টারনেট ব্যবহার করে দূর পরবাসে বসে প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার পত্রিকা দুটিকে অনুসরণ করতেন। অফিস থেকে বাসায় ফেরার পথে আব্বা বেশির ভাগ সময় প্রথম আলো ও ডেইলি স্টারে প্রকাশিত বিভিন্ন নিউজ কিংবা ফিচার প্রিন্ট করে নিয়ে আসতেন। আমার আম্মা সেগুলো পড়তেন এবং আমাকে ও আমার ছোট বোনকে পড়ে শোনাতেন।
এরপর ধীরে ধীরে যতই বড় হতে থাকলাম, ততই সংবাদপত্রের প্রতি আমার ঝোঁক বাড়তে লাগল। তবে অষ্টম শ্রেণিতে ওঠার আগপর্যন্ত রাজনীতি বিষয়ে আমার তেমন আগ্রহ ছিল না। তাই এর আগে বেশির ভাগ সময়ে ফিচারজাতীয় লেখা পড়ার জন্য বিভিন্ন সংবাদপত্রকে অনুসরণ করতাম। প্রথম আলো একসময় সাপ্তাহিকভাবে আলপিন নামের একটি রম্য ম্যাগাজিন বের করত। ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় এক বিতর্কের জেরে আলপিনের প্রকাশনা বন্ধ করে দেওয়া হয়। আলপিনের পরবর্তী সংস্করণ হিসেবে প্রথম আলো ‘রস+আলো’ নামের অন্য একটি ম্যাগাজিন বের করতে শুরু করে। স্কুলজীবনে বেশির ভাগ সময় আলপিন কিংবা ‘রস+আলো’র টানে প্রথম আলো পড়তাম। ২০১০ সালে অষ্টম শ্রেণিতে ওঠার পর আমার মধ্যে অন্য অনেক বিষয় নিয়েও নতুনভাবে আগ্রহ সৃষ্টি হয়। মূলত সে সময় থেকে আমি প্রকৃত অর্থে পত্রিকা পড়তে শিখেছি।
প্রথম আলোর ১২ নম্বর পৃষ্ঠায় পড়াশোনা নামের একটি স্বতন্ত্র পাতা থাকত, পঞ্চম শ্রেণির বৃত্তি পরীক্ষা থেকে শুরু করে অষ্টম শ্রেণির জেএসসি পরীক্ষা এবং নবম ও দশম শ্রেণিতে থাকাকালীন বিভিন্ন সময়ে এ পাতা থেকে অসংখ্যবার সহায়তা ও দিকনির্দেশনা গ্রহণ করেছি।
ইন্টারমিডিয়েটে পড়ার সময় আমাদের শিক্ষক-শিক্ষিকারা বিশুদ্ধ বাংলা চর্চার জন্য প্রথম আলোকে অনুসরণ করার পরামর্শ দিতেন। সেন্ট জোসেফের শিক্ষার্থী থাকা অবস্থায় আমাদের এক শিক্ষক একবার সরাসরি বলছিলেন, প্রথম আলোর বাংলা বানানরীতি বরেণ্য ভাষাবিদ মাহবুবুল হক দ্বারা প্রণীত। এ কারণে বানান লিখার ক্ষেত্রে কোনো ধরনের সংকোচ তৈরি হলে তিনি সরাসরি প্রথম আলোক অনুসরণ করার পরামর্শ দিতেন। গত বছর আমার সঙ্গে মাহমুদ মনি নামের জার্মানিপ্রবাসী এক বড় ভাইয়ের সঙ্গে পরিচয় হয়। তিনি একসময় বাংলাদেশে সাংবাদিকতা করেছেন। লেখক হিসেবে নিজেকে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে নিঃস্বার্থভাবে তিনি আমাকে বারবার সহায়তা করেছেন, মাহমুদ মনি ভাইও আমাকে একাধিকবার একই কারণে সঠিকভাবে বাংলা বানানচর্চার জন্য প্রথম আলোকে অনুসরণ করার পরামর্শ দিয়েছেন।
প্রথম আলোকে আরও একটি কারণে সব সময় ভালো লেগেছে। প্রথম আলো ও বন্ধুসভা বিভিন্ন সময়ে দেশের তরুণসমাজের মধ্যে নেতৃস্থানীয় গুণাবলি সৃষ্টিতে কাজ করে যাচ্ছে। জাতীয় পর্যায়ে গণিত উৎসব কিংবা ভাষা প্রতিযোগিতার মতো ইভেন্ট আয়োজনের ক্ষেত্রে প্রথম আলোর ভূমিকা সব সময় অগ্রগণ্য।
২০১৮ সালে আমি উচ্চশিক্ষার উদ্দেশ্যে মধ্য ইউরোপের দেশ স্লোভেনিয়ায় পাড়ি জমাই। প্রবাসজীবনে শত ব্যস্ততার মধ্যেও এক মুহূর্তের জন্য প্রথম আলো, ডেইলি স্টার, নিউ এইজ এবং বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর—চারটি পত্রিকাকে ভুলে থাকতে পারিনি। ছোটবেলায় যখন আমি একটু একটু করে পুরো পৃথিবী ও চারপাশের পরিবেশ সম্পর্কে জানতে শিখেছি, ঠিক সে সময় থেকে আমি আমার বাসার সবাইকে বাংলা পত্রিকার মধ্যে একমাত্র প্রথম আলো ও ইংরেজি পত্রিকার মধ্যে কেবল ডেইলি স্টারকে অনুসরণ করতে দেখেছি।
করোনাভাইরাসের সংক্রমণে আজ সমগ্র বিশ্ব এক কঠিন বিপর্যয়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে। করোনার ছোবলে বিগত প্রায় দেড় বছরে আমরা অসংখ্য মানুষকে হারিয়েছি। গত বছরের মার্চের ৪ তারিখে স্লোভেনিয়ায় প্রথম করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত করা হয়। ধীরে ধীরে মধ্য ইউরোপের এ দেশেও কোভিড-১৯–এ আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়তে থাকে। সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতিকে নিয়ন্ত্রণে আনার লক্ষ্যে বিশ্বের অন্য অনেক দেশের মতো স্লোভেনিয়ার সরকারও করোনার বিধিনিষেধ দেয়। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়, যদিও বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে আগের থেকেই অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম চালু করা হয়েছিল।
স্লোভেনিয়ায় আসার পর সবচেয়ে বেশি ঝামেলা পোহাতে হয়েছে বাসা নিয়ে। ইউনিভার্সিটি অব নোভা গোরিছার তিনটি ক্যাম্পাস রয়েছে। মূল ক্যাম্পাস স্লোভেনিয়া ও ইতালি—এ দুই দেশের সীমান্তসংলগ্ন শহর নোভা গোরিছায় হলেও ফিজিকস অ্যান্ড অ্যাস্ট্রোফিজিকসের ক্লাস হয় আইডোসচিনায়। অন্যদিকে ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট, ভিটিকালচার অ্যান্ড এনোলজি কিংবা এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্সের মতো অল্প কিছু বিষয়ের ক্লাস হয় ভিপাভা ক্যাম্পাসে। আইডোসচিনা থেকে ভিপাভার দূরত্ব সাড়ে চার মাইলের কাছাকাছি। যেহেতু আইডোসচিনায় সাধ্য অনুযায়ী থাকার জায়গা খুঁজে পাচ্ছিলাম না, তাই বাধ্য হয়ে আমাকে ভিপাভায় থিতু হতে হয়। ভিপাভায় স্কোফিস্কে নামের একটি স্কুল রয়েছে। ক্যাথলিক মিশনারি দ্বারা পরিচালিত এ স্কুলের ডরমিটরিতে শেষ পর্যন্ত আমার ঠাঁই হয়। ভিপাভাকে ছোট কোনো গ্রামের সঙ্গে তুলনা করলে ভুল হবে না। ঢাকার মতো ঘনবসতিপূর্ণ কোনো শহরে যাঁরা বেড়ে উঠেছেন, তাঁদের কাছে ভিপাভা খুব একটা ভালো লাগবে না। তাই ভিপাভাকে আমিও সেভাবে ভালো লাগাতে পারিনি, যদিও স্লোভেনিয়ায় পা রাখার পর আমাকে প্রায় দেড় বছর সেখানে কাটাতে হয়।
করোনার বিধিনিষেধের অনুভূতি অন্য অনেকের মতো আমার কাছে দুঃস্বপ্নের মতো ছিল। ইউরোপের অন্যান্য দেশের তুলনায় স্লোভেনিয়ায় নগরায়ণের হার সে অর্থে প্রকট নয়, এমনকি দেশটির রাজধানী ও বৃহত্তম নগরী হিসেবে পরিচিত লুবলিয়ানাও আয়তনের দিক থেকে একেবারে ছোট একটি শহর। অন্য কোনো উপায় না থাকায় বিধিনিষেধের দিনগুলোতে আমাকে ভিপাভার মতো ছোট একটি গ্রামের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতে হয়, যা ছিল মড়ার উপর খাঁড়ার ঘায়ের মতো এক যন্ত্রণাদায়ক অভিজ্ঞতা।
২০২০ সালের ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহ পর্যন্ত আমি ছিলাম একজন সাধারণ পাঠক। সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর প্রথম আলো, ডেইলি স্টার ও বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের ওয়েবসাইটে চোখ বোলাতে না পারলে পুরো দিনটিকে ফিকে মনে হতো। গত বছরের মার্চের প্রথম সপ্তাহ থেকে, অর্থাৎ করোনার বিধিনিষেধ শুরু হওয়ার পর আমি পাঠকের পাশাপাশি লেখক হিসেবে নিজেকে আবিষ্কার করতে শুরু করলাম। এর আগে কখনো সেভাবে কোনো গণমাধ্যমে আমার লেখা প্রকাশ হয়নি। ইতালির রাজধানী রোমে জমির হোসেন ও যুক্তরাজ্যে নাঈম হাসান নামের আমার দুজন শুভাকাঙ্ক্ষী রয়েছেন। তাঁরা আমাকে ছোট ভাই হিসেবে স্নেহ করেন। ফেসবুকের কল্যাণে তাঁদের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় ও তাঁদের অনুপ্রেরণায় লেখালেখির জগতে আমার পদার্পণ। জমির হোসেন ভাই অল ইউরোপ বাংলাদেশ প্রেসক্লাব নামের সাংবাদিক সংগঠনের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। তিনি দীর্ঘদিন সম্মানের সঙ্গে অল ইউরোপ বাংলাদেশ প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন।
‘স্লোভেনিয়ায় বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের বিড়ম্বনা, সরকারের হস্তক্ষেপ কামনা’ শিরোনামে গত বছরের ১৪ মার্চে আমার একটি লেখা প্রকাশিত হয়। এটি ছিল প্রথম আলোতে আমার প্রকাশিত প্রথম কোনো লেখা। আমার এ লেখা প্রথম আলোতে প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে পাভেল ভাই আমাকে মেসেঞ্জারে লিংক পাঠান। প্রথম আলোর মতো শীর্ষস্থানীয় গণমাধ্যমে নিজের লেখা দেখতে পেয়ে মনের মধ্যে সম্পূর্ণ ভিন্ন ধাঁচের এক অনুভূতির স্বাদ পাচ্ছিলাম। বারবার মনে হচ্ছিল, ঈদের চাঁদ এই বুঝি মর্ত্যলোকে এসে নিজের হাত স্পর্শ করল।
এর ঠিক ১২ দিন পর, অর্থাৎ গত বছরের ২৬ মার্চ প্রথম আলোর দূর পরবাসে ‘ক্রিস্টিনা: অসম ভালো লাগা ও হারিয়ে যাওয়া স্মৃতির গল্প’ শিরোনামে আমার দ্বিতীয় লেখা প্রকাশিত হয়। ২০১৪ সালে ফেসবুকের কল্যাণে আমার সঙ্গে আলিনা ক্রিস্টিনা উদরেস্কু নামের এক রোমানিয়ান তরুণীর সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল। ক্রিস্টিনা পেশায় একজন মোটরবাইক রেসার। ২০১৮ সালের মার্চের শেষ সপ্তাহে ইস্টারের ছুটিতে আমি রোমানিয়া সফরে যাই। রোমানিয়ার রাজধানী বুখারেস্টে ক্রিস্টিনা আমাকে বিশেষভাবে আতিথেয়তা জানিয়েছিল। বয়সে ক্রিস্টিনা আমার চেয়ে ১০ বছরের বড়। ক্রিস্টিনা আমার জীবনে নতুন দর্শন যোগ করেছে, আমাকে নতুনভাবে সবকিছু ভাবতে শিখিয়েছে। এ কারণে ক্রিস্টিনাকে আমি কোনো দিনও ভুলতে পারব না। অবচেতন মনে সে সব সময় আমাকে শক্তি জোগায় এবং আমাকে নতুন করে প্রেরণা দেয়। ক্রিস্টিনাকে স্মরণ করে প্রথম আলোতে আমার প্রকাশিত লেখাটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। অনেকে আমাকে মেসেঞ্জারে ইনবক্স করেন এবং আমার এ লেখা সম্পর্কে তাঁদের অভিমত ব্যক্ত করেন। আসিফ ইমতিয়াজ রবির মতো একজন স্বনামধন্য গল্পকারও আমার এ লেখা পড়ার পর আমাকে অভিবাদন জানাতে ভোলেননি। এ লেখা প্রকাশিত হওয়ার কয়েক দিন পর প্রথম আলোর দূর পরবাসের দায়িত্বে থাকা ভাইয়ার সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। ভাইয়া আমাকে ই-মেইলে জানান, রোমানিয়ার ওই ঘটনা নিয়ে লেখাটি নাকি তাঁর কাছে বেশ ভালো লেগেছে। তাই তিনি আমাকে নিয়মিতভাবে প্রথম আলোতে লেখা পাঠানোর জন্য উৎসাহ দেন। এর পর থেকে আমি নিয়মিত প্রথম আলোতে লেখা পাঠাতে শুরু করি। প্রথম আলোর দূর পরবাসে প্রতি সপ্তাহে অন্তত একটা লেখা পাঠানোর জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করতাম।
করোনার বিধিনিষেধে নিজেকে মানসিকভাবে চাঙা রাখতে লেখালেখি শুরু করেছিলাম। প্রথম দিকে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে লিখতাম। বর্তমানে কেবল পূর্ব ইউরোপ নিয়ে লিখছি। বাংলাদেশের মানুষের কাছে পূর্ব ইউরোপের দেশগুলো এখনো সেভাবে পরিচিত হয়ে ওঠেনি। ইউরোপের এ অংশ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বেশ বৈচিত্র্যময়। পূর্ব ইউরোপের বিভিন্ন দেশের সংস্কৃতি ও সমাজব্যবস্থা, রাজনীতি, বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান কিংবা ইস্টার্ন অর্থোডক্স খ্রিষ্টানিটি নিয়ে আপাতত লিখছি।
গত বছরের আগস্ট মাসের মাঝামাঝি সময়ে প্রথম আলোর ডেপুটি এডিটর সাইফুর রহমান ভাইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ হয়। তাঁর সহযোগিতা ও পৃষ্ঠপোষকতায় প্রথম আলোতে সাধারণ নিউজ ও ফিচারের পাশাপাশি ভ্রমণবিষয়ক লেখাও পাঠাতে শুরু করি। এভাবে ধীরে ধীরে ফ্রিল্যান্স লেখক হিসেবে প্রথম আলোর সঙ্গে কাজ করার সৌভাগ্য লাভ করি।
অবশেষে ২৩–এ পা রাখতে চলেছে প্রিয় পত্রিকা প্রথম আলো। ছাপা পত্রিকা থেকে শুরু করে অনলাইন পাঠকসংখ্যা—সব দিক থেকে প্রথম আলো আজ বাংলাদেশের শীর্ষে। প্রথম আলোর ওয়েবসাইটটি শুধু সংবাদমাধ্যম হিসেবে নয়, বাংলা ভাষায় সব ধরনের ওয়েবসাইটের মধ্যে গোটা পৃথিবীতে প্রথম স্থান দখল করে রেখেছে। অনলাইন প্রযুক্তি আর নতুন নতুন উদ্যোগ নিয়ে ছাপা পত্রিকার গণ্ডি ছাপিয়ে প্রথম আলো এখন বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ ‘গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান’, যা সত্যি সত্যি আমাদের সবার জন্য গর্বের বিষয়।
প্রথম আলোর সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে একটা বিষয় আমার কাছে সবচেয়ে ভালো লেগেছে, আর সেটি হচ্ছে প্রথম আলো সত্যিকার অর্থে একজন লেখককে উপযুক্ত মূল্যায়ন দিতে জানে। এ কারণে স্লোভেনিয়ার মতো একটা অপরিচিত দেশে বসবাস করার পরও নিজেকে তুলে ধরতে খুব একটা বেগ পেতে হয়নি। বিভিন্ন সময়ে প্রথম আলোয় আমার লেখা প্রকাশিত হওয়ার পর পাঠকদের মধ্য থেকে অনেকে আমার সঙ্গে বিভিন্নভাবে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেন। বিভিন্নভাবে তাঁরা আমাকে উৎসাহ দেন। সত্যি গর্বে বুকটা ভরে যায়। একজন লেখকের প্রাপ্তির ক্ষেত্রটা বোধ হয় ঠিক এ জায়গায়। প্রথম আলোর মাধ্যমে তাঁরা যখন আমাকে জানান যে প্রথম আলোতে তাঁরা আমার লেখা পড়েছেন এবং আমার লেখা সত্যিকার অর্থে তাঁদের কাছে ভালো লেগেছে, তখন প্রথম আলোর কল্যাণে এভাবে বাংলাদেশের বিভিন্ন বিখ্যাত মানুষের সঙ্গে আমার সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছে।
২০০৩ সালে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রথম আলোর গ্রহণযোগ্যতা আমি ব্যক্তিগতভাবে যতটুকু দেখেছি, আজকের দিনে সে গ্রহণযোগ্যতা আরও বেড়েছে। বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষের কাছে তাই আজও প্রথম আলো এক আস্থার প্রতীক। আমি অনেককে এমনও বলতে শুনেছি যে বাংলাদেশের সাংবাদিকতা অঙ্গনে শেষ ভরসার নাম প্রথম আলো। আমার আম্মা থেকে শুরু করে আমরা যারা আজকের প্রজন্মের নাগরিক রয়েছি, আমাদের অনেকের কাছে সাংবাদিকতার আদর্শ মানে মতিউর রহমান ও মাহফুজ আনাম।দুর্ভাগ্যবশত এই দুজনের কাউকে এখনো সামনাসামনি দেখার সুযোগ পাইনি, তবে একদিন তাঁদের সঙ্গে সরাসরি সাক্ষাৎ লাভের স্বপ্ন দেখি। প্রথম আলো বাংলাদেশের ইতিহাসে অসংখ্য কালজয়ী সংবাদকর্মীর জন্ম দিয়েছে, যাঁদের কাছে আমরা সবাই ঋণী।
‘ভালোর সাথে আলোর পথে’ স্লোগানকে উপজীব্য করে আরও বহুদূর এগিয়ে যাক প্রিয় পত্রিকা প্রথম আলো। একই সঙ্গে প্রিয় পত্রিকায় নিয়মিত লেখার মাধ্যমে নিজের মধ্যকার সুপ্ত সম্ভাবনাকে আরও বিকশিত করে তুলতে চাই। পরিশেষে প্রথম আলো পরিবারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবার প্রতি রইল বিনম্র শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা। তাঁদের অক্লান্ত পরিশ্রমের ওপর পুঁজি করে আজকে প্রথম আলো বাংলাদেশের প্রত্যেক সাধারণ মানুষের মণিকোঠায় স্থান লাভ করতে সমর্থ হয়েছে।
*লেখক: শিক্ষার্থী, ফাইনাল বর্ষ, ইউনিভার্সিটি অব নোভা গোরিছা, স্লোভেনিয়া