
আশ্চর্য সৌন্দর্যে আর বৈচিত্র্যে অথৈ নীলের অসীম সমুদ্র প্রতিবারই আমার হৃদয়ের আঙিনায় প্রশান্তির আঁচড় কাটে। দূর অজানায় দৃষ্টির সীমানা পেরিয়েও আমার দুচোখের দৃষ্টি চৈতন্য হারায় সমুদ্রের বুকে। এত বিশালতা, এত গভীরতা, উচ্ছলতা নিয়েও কি প্রাণবন্ত ও নির্মল। কখনো কখনো উত্তাল সৃষ্টি শৈল্পিক আদলে গড়া।
প্রকৃতির সঙ্গে আমার প্রেমটা ছোটবেলা থেকেই। মুখে যতই বিশ্ব নাগরিকতার কথা বলি না কেন, ভেতরে ভেতরে আমি খুবই আঞ্চলিক। এই প্রবাসজীবন আমাকে স্বস্তি, প্রাচুর্য, ধুলোবালিমুক্ত জীবন দিয়েছে বটে। দুদণ্ড সুখ দিতে পারেনি। দিনের ক্লান্তি শেষে মাতৃভূমিতে ফেলে আসা প্রিয় মানুষগুলোকে ভেবে শূন্যতায় বুক ভেঙে যায়। নীড়হারা পাখির মতো ছটফট করি, দূর আকাশের কানে কানে বলি, যে ছিল দৃষ্টির সীমানায়, যে ছিল হৃদয়ের আঙিনায়, সে হারালো কোথায় কোন দূর অজানায়। সেই চেনা মুখগুলো কতদিন দেখিনি!
আমার দেশের মুক্ত আকাশ, পেছনে ফেলা আসা স্মৃতি, কাদামাটির মেঠো পথ আমায় তাড়িয়ে বেড়ায় প্রতি মুহূর্ত। কিছুটা প্রশান্তি আর পরিবারের সঙ্গে নিভৃতে সময় কাটাতেই কিছুদিন আগে কুইন্সল্যান্ডের গোল্ড কোস্টে গিয়েছিলাম। সমুদ্র তীরবর্তী অসাধারণ বৈচিত্র্যময় সৌন্দর্যকন্যা এই পর্যটন নগরী। আক্ষরিক অর্থে নামের সার্থকতা আছে। আমাদের প্রিয় কক্সবাজার থেকে অপেক্ষাকৃত শান্ত। যারা হেঁটে সৈকত আর সমুদ্র বালুচর দেখতে আগ্রহী, তাদের জন্য আরও আকর্ষণীয় এই গোল্ড কোস্ট। এখানে অনেকগুলো বিচ আছে, তার মধ্যে সারফার প্যারাডাইস, মেইন বিচ, প্লাম বিচ, রেইন বিচ, কিরা বিচ, মিয়ামি বিচ, গ্রিন মাউন্ত বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
সাগরের সুনীল জলরাশি আর পরিকল্পিত বালুকাময় সমুদ্রসৈকত এই পর্যটন নগরীকে দিয়েছে অপার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। উত্তাল সাগরের নোনাজল যখন আছড়ে পড়ে, ঝিরিঝিরি বাতাসে তৈরি হয় সফেদ ফেনা। যা রৌদ্রময় আলোর ঝলকানিতে মুক্তোর দানার মতোই চিকচিক করে। সে এক মাতাল করা দৃশ্য!

২০১৮ সালের কমনওয়েলথ গেমস এই গোল্ড কোস্টে অনুষ্ঠিত হবে। ২০১৩ সালের ৪ এপ্রিল এর লোগো উন্মোচন করা হয়েছে। একই সময় শুরু হয়েছে প্রতিযোগিতাটির ক্ষণ গণনাও। কমনওয়েলথ গেমস মন্ত্রী জ্যান স্টাকি জানিয়েছেন, ‘এই লোগোটি পর্যটন শহর গোল্ড কোস্টের সমুদ্র তীরবর্তী অসাধারণ স্থান কতৃর্ক অনুপ্রাণিত হয়েই তৈরি করা হয়েছে। এর আকর্ষণীয় রং মূলত সমুদ্র তীরকেই প্রতিনিধিত্ব করছে। এ ছাড়া এখানে উৎসবেরও একটি আমেজ ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।’ লোগোটির বাইরে কমলা, হলুদ, সবুজ ও নীল রঙের রশ্মি রয়েছে। এই রংগুলোর জন্যই তিনজন ক্রীড়াবিদের জলছবিটি স্পষ্টভাবে মাঝে ফুটে উঠেছে। লোগোর পাশাপাশি চার মিটার লম্বা একটি কাউন্টডাউন ঘড়িও গোল্ড কোস্টের মূল সেন্টারে উন্মুক্ত করা হয়েছে। ঘড়িটির আকার অনেকটা সার্ফবোর্ডের আদলের। ২০১৮ সালের ৪ এপ্রিল গোল্ড কোস্ট গেমসের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান হবে।
যা হোক, বাসা থেকে গোল্ড কোস্টে যাওয়ার সময় বারবার ঘুরেফিরে মাথায় ভাবনা এসেছে ৭০ কিলোমিটার সমুদ্র সৈকতের মাঝে সাঁতার, সার্ফিং, রঙিন নৌকায় চড়ে ঘুরে বেড়াব পরিবারের সঙ্গে। এটা ভেবেই শিহরিত হয়েছি ভ্রমণের পুরো সময়টুকু।
নৈসর্গিক সৌন্দর্যের জন্য বিখ্যাত এই সৈকতটি দেখলে মনে হবে সৌন্দর্য দেবী তার সবটুকু রূপ অকৃপণভাবে ঢেলে দিয়েছে বালির আঁচলে। এখানে এসে বেশির ভাগ পর্যটকই সূর্যস্নান বা সমুদ্রস্নানে নিজেকে বিলীন করে দেয় নীলাভাব

প্রকৃতির মাঝে। খোলা জিপ, স্পিডবোটে করে ঘুরে আসা যায় এখানকার হারবারে। সমুদ্রের বালির বিছানায় দাঁড়িয়ে শামুক–ঝিনুকের সঙ্গে কখন যে লুকোচুরি খেলায় মেতে উঠেছিলাম, টের পাইনি।
সাগরের বিশাল মায়াবি গোধূলি ও সূর্যাস্তে রাতের নিস্তব্ধতায় সৈকতের পাদদেশেই গড়ে ওঠা অত্যাধুনিক শীতাতপনিয়ন্ত্রিত মার্কেট, আন্তর্জাতিকমানের রেস্তোরাঁর খাবার দাবার, কোনোটায় বার, পার্টির জমজমাট ব্যস্ত আয়োজন। রাতের সৈকত আর তার চাকচিক্যময় চারপাশের পরিবেশ প্রতিটি পর্যটকের মুগ্ধতা কেড়ে নেয়। আগত পর্যটকদের অনেকেই অবিশ্বাস্য সুন্দর সন্ধ্যায় নাচগানের ছন্দে মেতে ওঠেন ওয়ার্ল্ড ক্লাস নাইট ক্লাবে। জুপিটার ক্যাসিনোতে নিজের ভাগ্যটিও যাচাই করে নেন কেউ কেউ। নানা আলোয় আলোকসজ্জিত ভবনগুলো চোখ ধাঁধানো সৌন্দর্যে ভরপুর। আলো–আঁধারের মাঝে এ যেন জীবনের অন্য এক জগৎ। রঙিন অধ্যায়, দম ফেলার ফুসরত নেই!
অস্ট্রেলিয়ার সবচেয়ে জনপ্রিয় বিনোদন স্থান এই গোল্ড কোস্ট। অস্ট্রেলিয়ার পূর্ব উপকূলে দক্ষিণ পূর্ব কুইন্সল্যান্ড প্রদেশের উপকূলীয় শহর। রাজধানী ব্রিসবেন শহরের ৯৪ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত এই পর্যটন নগরী । এটা কুইন্সল্যান্ডের দ্বিতীয় জনবহুল ও অস্ট্রেলিয়ার ষষ্ঠ জনবহুল শহর।
প্রতিবছর সমগ্র বিশ্ব থেকে চার মিলিয়নেরও বেশি পর্যটক আসেন গোল কোস্টে। অনেকেই এটিকে অস্ট্রেলিয়ার আনন্দ রাজধানী নামেও জানেন। গোল্ড কোস্ট শুধু বিনোদন রাজধানীই নয়, এটিকে সবচেয়ে বড় থিম পার্ক রাজধানীও বলা হয়। এখানকার ড্রিমওয়ার্ল্ড, সিওয়ার্ল্ড, মুভিওয়ার্ল্ড, ম্যাজিক মাউন্টেনের শ্বাসরুদ্ধকর, সর্বোচ্চ গতির ও উত্তেজনাপূর্ণ অত্যাধুনিক সব রাইড সব বয়সের মানুষের মাঝে এক মনোমুগ্ধকর স্বর্গীয় অনুভূতি এনে দেয়। বন্য প্রাণী ক্যাঙারু ও কোয়ালা, সঙ্গে ডলফিন আর হিংস্র হাঙর তো আছেই। চাইলেই যেকোনো সাহসী পর্যটক টিকিট কেটে পাল্লা দিয়ে সাঁতার কাটতে পারে স্বচ্ছ নীল সমুদ্রের পানিতে।
হ্যাপি রহমান
সিডনি, অস্ট্রেলিয়া