পৃথিবী সেদিন মুক্তি চেয়েছিল

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে আজ
ঘুমিয়ে আছে যে বিভ্রান্ত মানুষেরা,
এই পৃথিবীর আকুল আহাজারি
পায় কি শুনতে ওরা?

বেঁচে থাকার তীব্র আকাঙ্ক্ষা
এখনো কি হৃদয়ে পীড়া দেয়?
নাকি অশান্তির ঘুমে বিবর্ণ শরীর
অচেতন হয়ে পড়ে রয়।

বৈশাখের রূদ্র ঝোড়ো হাওয়া
যদি না পারে ওদের জাগিয়ে যেতে,
ঐ মৃত শরীরে জ্যৈষ্ঠ মাসের
খরার তাপ পারে কি ওরা সইতে?

আষাঢ়–শ্রাবণের অঝোর বরিষন
ভাদ্র, আশ্বিন আর কার্তিকের নীল গগন,
সব যেন আজ স্থবির অন্ধকার
অনাদি কালের মতন।

অগ্রহায়ণ, পৌষ আর মাঘের শীতে
সূর্যের রাঙা রৌদ্রের কিরণ
ভেঙে কুয়াশার ঘন আচ্ছাদন
ঐ হিম দেহে করে কি উষ্ণতার সঞ্চালন?

ফাল্গুনি হাওয়া আর চৈত্রের উদাস দুপুর
আলিঙ্গনে নিবিড় হয়ে মিশে গেছে
শতাব্দীর নীল অন্ধকারে,
অস্পষ্ট কোকিলের কুহুতান দূর বনের প্রান্তরে।

নক্ষত্রগুলো পাহারাদার হয়ে নিশীথে
হয়তো বা জেগে রয় ওদের পাশে,
আকাশের নীল ব্যথার সাগরের
নিরালা ঢেউয়ের কাছে
বুঝি অভিযোগ করে নীরবে এসে।
দূষিত হয়েছে আজ পৃথিবীর নিশ্বাস,
অন্ধকার মাটির নিচে মৃত মানুষেরা
শুয়ে আছে বারো মাস।

এমনি করে মানুষের ইতিহাস
একদিন যদি লোপ পায়,
আসবে সেদিন নতুন কোনো প্রাণী
আবার এই ধরণির ধুলায়।

বহু কাল, বহু যুগ, লক্ষ–কোটি বছর পরে
হয়তো একদিন পৃথিবীর গহ্বরে,
আবিষ্কৃত হবে মৃত ডাইনোসরের মতো
এই মৃত মানুষগুলোর কঙ্কাল যত।

ওরা ছিল মানুষ নামের প্রাণী,
নিঃশেষ হয়ে গেছে কেবলই
লোভ–লালসার ক্ষুধা মেটাতে
নিজেদের মাঝে করে হানাহানি।

মৃত্যুর ও পার চায়নি দেখতে ওরা
নিমগ্ন ছিল অন্যায়–অবিচারের আবর্জনায়,
কবরের ঐ অন্ধকারে নিষ্প্রাণ দেহে
আজ সে কথা কি মনে পড়ে যায়?
একদিন বিস্ময়ে অবাক হয়ে
জানতে চাইবে নতুন পৃথিবীর নতুন প্রাণী,
মানুষের সেই যুগ তখন কেমন ছিল?
কে বলবে ওদের পৃথিবীর নষ্ট কাহিনি?
কী জন্য ওরা পার হয়েছিল বৈতরণী?
প্রশ্ন করবে প্রতিটি নক্ষত্রের কাছে
পৃথিবী সেদিন কেন মুক্তি চেয়েছিল?
মানুষেরা কি অপরাধ করেছিল?
অপরাধ ছিল ক্ষমার অযোগ্য,
ধন–সম্পদ আর ক্ষমতার লালসা
শুরু করেছিল তারা ধ্বংসযজ্ঞ।

যুদ্ধ, বিগ্রহ, দারিদ্র্য, দুর্দশা
আর অসাম্যের ক্লেশের ভারে,
পৃথিবী যেন আর উঠছিল না পেরে।
ধর্মের নামে চলছিল কাটাকাটি–মারামারি,
ঠিক তখনই পৃথিবীতে নেমে এলো মহামারি।
অবহেলায় পৃথিবীজুড়ে ছিল বিষণ্নতা,
ভালো লাগেনি তাদের মায়া–মমতা।
অনাদৃত হয়েছে প্রেম–ভালোবাসা
সুখ, শান্তি আর অগাধ বিশ্বাস,
লোভ, ক্ষমতা, অন্যায় আর দুর্নীতিতে
জড়ানো ছিল মানুষের প্রতিটি নিশ্বাস।
ধ্বংসের লীলায় ওরা মেতে উঠেছিল
তাই তো পৃথিবী সেদিন মুক্তি চেয়েছিল।

*লেখক: জাহান সৈয়দ মিনা, ওকভিল, অন্টারিও, কানাডা