পিংপং পইং
১.
প্রিং করে লাফিয়ে খাঁচার কাছে চলে এলাম। তুলার বলের মতো প্রাণীগুলো কী চমৎকার দেখতে! পুরু পশমে চোখ ঢেকে গেছে তাদের। বহু কষ্টে ছোট ছোট হাতে পশম সরিয়ে ঘাস খেতে ব্যস্ত। আমিও ব্যস্তসমস্ত হয়ে সাদা-কালো-বাদামিতে ছোপানো গিনিপিগদের মন্ত্রমুগ্ধের মতো দেখছি।
‘এদিকে একটু শুনে যাও তো।’
চমকে তাকালাম। ডানে-বাঁয়ে ভিড় নেই তেমন। তাহলে কে বলল কথাটা? নাহ্, ভুল শুনেছি।
‘কী, কানে খাটো নাকি? নাকি না শোনার ভান করছ?’
এবার ভ্রান্তিতে পড়ে গেলাম। হচ্ছেটা কী? এদিকে নধর সাইজের একটা গিনিপিগ খাঁচা আঁকড়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে। কৌতূহলী হয়ে সেদিকে এগোলাম।
‘হ্যাঁ, আমিই ডাকছি। দুটো কচি ঘাস ছিঁড়ে এনে দিতে পারো? এদের দেওয়া অখাদ্য খেয়ে অরুচি ধরে গেছে। পশুখাদ্য না ছাই। ধুর...’
কথা ফুরোনোর আগেই দেখি বাচ্চা একটা ছেলে এক মুঠ তাজা ঘাস এনে খাঁচার ফোকর গলে ঢুকিয়ে দিয়েছে।
‘দেখলে কী রকম চটপটে ছেলে। তোমার মতো আলসের ডিপো নয়’ বলেই সে ঘাস চিবোতে ডুবে গেল।
বিস্ফারিত চোখে বলেই ফেললাম, ‘তুমি কথা বলছ কীভাবে? আমিই-বা বুঝছি কী করে?’
লেজহীন ছয় ইঞ্চি প্রাণীটি ভীষণ অনিচ্ছায় জবাব ছুড়ল, ‘সবার সঙ্গে বলি না। তোমাকে দেখে মনে হলো হয়তো বুঝতে পারবে। তাই বলেছি। এখন দেখছি তুমি বোকার হদ্দ। যাও, যাও, সক্কাল সক্কাল আর সময় নষ্ট কোরো না।’
ভালো রকমের ভ্যাবাচেকা খেয়ে সরে পড়লাম সেখান থেকে। কোথাও গরমিল হচ্ছে। খুব ভোরে উঠেছি। ঘুম কম হলে লোকে ভুলভাল শোনে। তেমন কিছু একটা হবেও-বা। দূরে বাপ-ছেলে হেলেদুলে এগিয়ে গিয়েছে অনেকটা। কথা বলা গিনিপিগ আর তার ঘাসকাহিনি মাথা থেকে ঝেড়ে দুজনের দলটাকে ধরতে পা চালালাম।
মিউনিখ ছাড়িয়ে সামান্য দূরেই এই বিশাল পইং পার্ক। আর পইং নামটাও এক্কেবারে জুতসই। নানান বয়সী শিশুরা পিংপং বলের মতো লাফিয়ে-ঝাঁপিয়ে একেবারে কাঁপিয়ে রেখেছে পুরো পার্ক। মা-বাবার হাত ধরে তারা সবাই পশুপাখি দেখতে এসেছে। মাঠের পর মাঠ সবুজের মাঝে ছেড়ে রাখা প্রাণীগুলোর স্বাধীনভাবে ঘুরে বেড়াতে দেখে তাক লেগে যাচ্ছে তাদের। তবে নামে ওয়াইল্ড পার্ক হলেও কোনো বুনো প্রাণী নজরে আসছে না। আর তরতরিয়ে যে এগোব, তিড়িংবিড়িং শিশুর পাল ঠেলে হাঁটাচলাই মুশকিল।
২.
দুটো আধুলি ফেলে অটোমেট মেশিনের বোতাম এন্তার টেপাটিপি করেও কাজ হলো না। টপ করে পয়সা গিলে নিয়ে নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল সেটা। হরিণের খাবার না কিনেই ফিরে এলাম। ছয় বছরের তাফসু মিয়া কিছুটা হতাশ হলেও পর মুহূর্তেই হরিণের বাগিয়ে দেওয়া গলায় হাত বুলাতে মজে গেল। তার জন্যই আজকের আসা।
চিত্তিরবিত্তির রঙের হরিণগুলো কোন ফাঁকে বড়দের মনও রাঙিয়ে ফেলেছে। তেপান্তর সাইজের সুবিশাল মাঠের এখানে-সেখানে জটলা করে ঘুরছে ছোট ছোট দল। দলের ছানাদের কেউ কেউ আবার বেড়াতে আসা শিশুদের কাছ থেকে খাবার খাচ্ছে চেটেপুটে। হাতে সুড়সুড়ি লেগে শিশুরা খিলখিল হেসে উঠছে। হরিণশাবক আর মানবশিশুতে জমেছে জম্পেশ।
‘টুইট...!’ শিস দিয়ে কেউ যেন পিছু ডাকল হঠাৎ।
‘কী, খিদে পেয়েছে?’ তাফসু মিয়াকে শুধালাম। সে মাথা নেড়ে আপত্তি জানিয়ে বয়সে বুড়ো এক হরিণের কান ধরে ঝুলতে লাগল।
‘কী হলো, সিটি দিয়ে ডাকলাম। সাড়া দিচ্ছ না যে। আমার কান দুটো খুলে নিচ্ছে তো তোমার পাজি ছেলেটা। এভাবে মলে দিচ্ছে, বাবা গো। ওকে সরাও বলছি, উফ্’।
এখন আমার চোয়াল ঝুলে পড়ার পালা। রাগী চেহারার পালের গোদা টাইপ হরিণটা কথা বলছে নাকি? হতভম্ব ভঙ্গিতেই ছেলেকে ছুটিয়ে আনলাম।
‘বাঁচালে মা, বুড়ো বয়সে কান গেলে কী বিপদ, তাই না। তুমি বরং ওকে আমার শিং ধরে দাঁড়াতে বলো। দারুণ একটা ছবি হবে।’
‘নাহ্ মানে...’। কী যেন একটা বলতে মুখ খুলে আবার বেমালুম ভুলে গেলাম। ওদিকে আপনা থেকেই আঙুলের টোকায় পটাপট ছবি উঠে গেল মুঠোফোনে।
‘মা, তুমি আমার সঙ্গেও একটা ছবি তোলো। বহুদিন এমন কাউকে পাই না। আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ কত সহজ। অথচ কেউ পাত্তা দেয় না। বিশ্বাসই করে না ব্যাপারটা।’
প্রবল বেগে গাল চুলকাব, না এখান থেকে পালিয়ে যাব, স্থির করতে না পেরে ছেলের বাবাকে আলপটকা বলে বসলাম, ‘ওনার সঙ্গে একটা ছবি তুলে দেওয়া যায়? মুরব্বি যখন বলছেন এত করে।’
কথাগুলো মজা করে বলা ভেবে সানন্দে সে ক্লিক ক্লিক ছবি তুলে নিল।
বুড়ো হরিণ বাবাজিকে বিদায় জানিয়ে কেটে পড়লাম ঝটপট। বুড়োটা আবার বলে কিনা ফেরার পথে তার সঙ্গে আড্ডা মেরে যেতে। দুই কদম সামনের অটোমেটটা নাকি কাজ করে ঠিকঠাক। সঙ্গে করে যেন কিছু খাবার কিনে আনি।
আমার তো খেয়ে কাজ নেই। তা ছাড়া সব কেমন তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। অথচ কাউকে বলতেও পারছি না। নির্ঘাত পাগল ঠাউরে বসবে তাহলে।
৩.
মোটা মোটা কাঠ জুড়ে দিয়ে মাচা বানানো হয়েছে। তাতেই উঠে ছেলে-বুড়ো উৎসুক কী যেন দেখছে। হাতের গেরো থেকে ছেলেটাও ফসকে গিয়ে তাদের দলে ভিড়ল। ছেলেমানুষি কৌতূহল দমাতে না পেরে আমিও পিছু নিলাম। লোকের ভারে মচমচিয়ে দুলে উঠল মাচা। কিন্তু কই, তারকাঁটায় ঘেরা জায়গাটায় ঘন গাছের সারি ছাড়া কিছুই যে দেখছি না। যাকে দেখতে হাঁচড়েপাঁচড়ে মাচায় ওঠা, সে দিব্যি ডালপালার আড়ালে গা ঢাকা দিয়ে রইল। হতাশ হয়ে নেমে পড়তে হলো।
পাশ কাটিয়ে চলেই যাচ্ছি, অমনি ছেলেটা তারস্বরে চ্যাঁচাতে লাগল, ‘ওই যে, ওই যে। মা, দেখো কত্ত বড় কুকুর।’ তার দৃষ্টি অনুসরণ করে ওয়েরউলফ সাইজের ইয়া বড় এক শিয়াল দেখতে পেলাম দূরে। আরামসে রোদ পোহাচ্ছে শুয়ে।
‘না বাবা, ওটা শিয়ালমামা। দেখো না ওর লেজটা কত্ত ফুলো ফুলো। কুকুর তো দেখতে আরেক রকম।’
ছেলেকে বুঝ দিয়ে কুলিয়ে ওঠার আগেই গমগমে স্বর ভেসে এল, ‘মা-ছেলে মিলে খুব জ্বালাচ্ছ দেখছি। শান্তিতে বইটাও পড়তে দেবে না।’
সজোরে মলাট বন্ধের শব্দে ইতিউতি চাইলাম। আর আচমকাই লোমশ শিয়ালটা অত বড় শরীর দুলিয়ে ঠিক সামনে এসে হাজির।
বেড়ার ওপাশ থেকে তিরিক্ষি মেজাজে সে অভিযোগ ঠুকে দিল, ‘শিয়াল মানেই মামা, আর তার ফুলো ফুলো লেজ? ব্যস, আর বলার মতো আর কিছু পেলে না। এই শিক্ষা দাও ছেলেপেলেকে? কেন, “শিয়ালপণ্ডিত” বললে কী হয় শুনি?’
কড়া কথাগুলো শুনে একেবারে মিইয়ে গেলাম। এভাবে তো ভাবিনি।
‘দিনরাত বই নিয়ে পড়ে থাকি, জানো সে কথা? আর তুমি কটা পড়েছ এ মাসে বলো তো দেখি?’
এ মাসে কী, এ বছরেই তো বইটই ওসব ছুঁইনি। পড়ার ভেতর পড়ি কেবল খটমট রিসার্চ পেপার। মিনমিন করে সে কথাই বলতে গিয়ে চোখ আটকে গেল পণ্ডিতমশাইয়ের বিশাল থাবায়। এক তাড়া সবুজ পাতা জুড়ে দিয়ে গাছের বাকলের মলাটে বন্দী করা হয়েছে। বাহ্, বইয়ের কি নমুনা। অজান্তেই একটা শিয়াল মার্কা খ্যাক খ্যাক হাসি হেসে ফেললাম। ‘ওহ, এই তোমার বই? এগুলোই চিবোয় সারা দিন শুয়ে-বসে?’
দশাসই শিয়ালটা এবার আহত গলায় বলল, ‘গাছের পাতায় ইতিহাস লেখা থাকে জানো? বরফযুগ থেকে পাথুরে যুগ, কত কাহিনি। এই পৃথিবীর সব রহস্য লেখা পাতায় পাতায় আর তার শিরায়, উপশিরায়। তোমাদের কাগুজে বইয়ে যেমনটা লেখা থাকে। ইদানীং নিজেরাও সেগুলো আর পড়ো না। আর কাউকে পড়তে দেখলেও জ্বলুনি। আর বিরক্ত না করে কেটে পড়ো তো মানে মানে।’
আমাদের আর এক রত্তি পাত্তা দিল না শিয়ালপণ্ডিত। ভালো একটা খোঁড়ল খুঁজে নিয়ে তাতে কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে পড়ল। তারপর খুব মনোযোগ দিয়ে পাতা ওলটাতে লাগল।
৪.
রেইনট্রির মতো আকাশছোঁয়া গাছে ছেয়ে আছে পইং পার্ক। তাদের ফুল-ফল-শিকড়-বাকড়ের বিবরণ খুব যত্ন করে লেখা আছে কাঠের ফলকে। তার মানে, পইং একই সঙ্গে একটা বোটানিকাল গার্ডেনও বটে। আর গাছগাছালি মানেই পাখপাখালির আশ্রম। কিচিরমিচির কোলাহলে চারপাশটা ভীষণ রকমের জীবন্ত। সবুজের ফাঁকে ঝিরিঝিরি দখিনা হাওয়া উড়ে–ঘুরে মন মাতিয়ে রাখছে। এ সুযোগে পা দুটো জিরিয়ে নিই খানিকটা। আর দেরি না করে পথের ধারের বেঞ্চিটা দখল করে নিলাম।
তারকাঁটার ওধারে বনবিড়ালের পরিবার গাদাগাদি করে ঘুমাচ্ছে। দিনেদুপুরের এ অবধি আর কোনো প্রাণীকে অমন ঘুমাতে দেখিনি। বাবা-মা-ছানাপোনা সব একসঙ্গে মোয়া বেঁধেছে। ঘড়ঘড় নাক ডাকার শব্দও মিলছে। তবে ঝোলানো সাইনবোর্ডটা কেমন সন্দেহ হলো। তাতে বড় বড় হরফ লেখা, ‘বনমোরগ’। অথচ উঁকিঝুঁকি মেরেও বনমোরগের ঝুঁটি মিলল না। বনবিড়ালের দল আবার মোরগ-পোলাও দিয়ে লাঞ্চ সেরে ভাতঘুমটা দেয়নি তো?
যাকগে, প্রাণিজগতের খাদ্যচক্র নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে সঙ্গের থলে থেকে চিপস-বিস্কুট-কফি বের করে ছোটখাটো পিকনিকের আয়োজনে লেগে গেলাম।
‘মাফ করবেন, একটু আস্তে কথা বলা যায় কি? আমার মিসেস ঘুমাচ্ছে কিনা। বেচারার মাইগ্রেনের সমস্যা। ঘুমটা হলে ভালো হতো।’ কথাগুলো খুব সহবতের সঙ্গে বললেন বিড়াল পরিবারের বিনয়ী কর্তাবাবু।
কচরমচর শব্দে বিস্কুট কামড়ানোতে আলাব্বু দিতে হলো। এত করে যখন বলছেন ভদ্রলোক। নিঃশব্দে কোল্ড কফি গিলে নিয়ে দ্রুত পাততাড়ি গোটালাম। মিস্টার ম্যাঁও ততক্ষণে বাকিদের পাশে ফিরে গিয়ে নাক ডাকা জুড়ে দিয়েছেন। এদের সবার ভরপেট এক দিকে গড়িয়ে পড়েছে। মাইগ্রেন না কচু। পেটের ভেতর বনমোরগগুলো ঘচঘচ করেছে নির্ঘাত।
৫.
পাশাপাশি তিন হুতোম সাইজের প্যাঁচা বসে ধ্যান করছে। ভাবলাম, ডাকাডাকি করে কাজ কী। হয়তো তাদেরও মাইগ্রেনের সমস্যা আছে। পাশ কাটিয়ে চলে যাই বরং। তা-ই যাচ্ছিলাম। অমনি রোঁ ফুলিয়ে মধ্যের জন চোস্ত জার্মানে খেঁকিয়ে উঠল, ‘হাল্ট! থামো!’ ধমক শুনে রোম খাড়িয়ে গেল প্রায়। বুজে রাখা চোখ দুটো আস্তে আস্তে আয়েশ করে খুলল রাশভারী প্যাঁচাটা। আবার কি বিপদে পড়তে যাচ্ছি ভেবে কাঁচুমাচু দাঁড়ালাম।
‘এই, একটা কথার জবাব দিয়ে যাও দেখিনি। ফ্রাউ ম্যার্কেল গদি ছাড়লে এই জার্মান দেশটার কী গতি হবে বলে তোমার মনে হয়।’
আমি বাপু রাজনীতির ডানেও নেই, বামেও নেই। তার ওপরে প্রবাসী বাঙাল। তাই খুব সাবধানে বললাম, ‘কী আবার হবে, ম্যার্কেল গেলেও তোমাদের দেশ যে সার্কেলে চলছিল, সে সার্কেলেই চলবে।’ তারপর ‘আচ্ছা চলি, তাড়া আছে’ বলে সটকে পড়লাম।
পেছন থেকে বলতে শুনলাম, ‘দেখলে মধ্যমপন্থী সুবিধাবাদীটা কেমন পালিয়ে গেল। যাচ্চেলে...’
যাহ্, ছেলেটাও এই ফাঁকে পালিয়ে কদ্দূর এগিয়ে গেছে। তাকে ধরতে ইগলের ডেরা অবধি হাজির হলাম এক দৌড়ে।
পাজিটাকে বাগে পুরে হাঁ করে হাঁপাচ্ছি। কানে এল, ‘আরি বাপস্, তুমি তো দেখি ভালোই দৌড়াতে পারো। এদের হেড অফিসে গিয়ে একছুটে আমার হয়ে একটা আরজি জানিয়ে আসবে?’
পাশ ফিরে দেখি হলুদ ঠোঁটের রাজকীয় চেহারার ইগলটা আমাকেই বলছে কথাগুলো। কপালের ঘাম মুছে শুধালাম, ‘কী আরজি, ঝেড়ে কাশো।’
‘কাশাকাশির আবার কী আছে। দেখতেই তো পাচ্ছ, প্যাঁচাদের খাঁচায় ওরা তিন-তিনজন। চিলের বাসায় দুজন। প্লাস নতুন ফোঁটা ছানা। আমার সঙ্গে তো কাউকে দিল না এখনো। কেমন বিচার বলো তো?’ কেশর ফুলিয়ে বেচারা খাঁচার এমাথা–ওমাথা গজগজ করতে লাগল।
আহা, এমন রাজপুত্র চেহারার ইগলের একটা গতি তো করতেই হয়। ফিরতি পথে হেড অফিসে একটা কমপ্লেন লেটার ঠুকে দিয়ে যাব বলে কথা দিলাম। ইগল রাজকন্যার এসে পৌঁছানো এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র।
৬.
‘রোদে কেমন ঘামছ। ইশ্, নিচে এসে ছায়ায় বসে কথা বলো না।’ বাদামি ভালুকটার ধরন-ধারণ সুবিধের ঠেকছে না।
‘তোমার ছানাটাও দেখছি কচি একেবারে। ওকেও আনো। খুব গল্প হবে।’
মায়েদের রাডারে দুষ্ট লোকেরা ঠিক ধরা পড়ে যায়। পেটমোটা ভালুকটার মতলব বুঝে গেলাম। কায়দা করে ভুলিয়ে–ভালিয়ে কাছে নিয়ে ঘাড় মটকে দেবে পটাং। তারপর মা-ছেলে ভালুক পরিবারের ভূরিভোজ হয়ে যাব। তারপর পড়ন্ত বিকেলে গাছের গুঁড়িতে হেলান দিয়ে ঘাউক ঢেকুর তুলবে এরা।
পাজি ভালুকটাকে ভেংচি কেটে পলকা বাঁশের সাঁকো থেকে নেমে পড়লাম। লোকের ভারে সাঁকো উল্টে গেলে ভূরিভোজ, গণভোজ—কোনোটাই ঠেকানো যাবে না আজকে।
এক আকাশ কড়া রোদ্দুরে নরম কাশফুল হয়ে ভাসছে বোহিমিয়ান মেঘ। এক–আধটা সফেদ সারস ডানা মেলে মেঘ ছুঁয়ে আসতে চাইছে যেন। আর সবুজ মাঠে দলছুট একপাল ঘোড়ার এলোমেলো ছোটাছুটি। প্যাঁচানো সিঁড়ি বেয়ে উঠে যাওয়া ছোট্ট ওয়াচ টাওয়ারে চড়ে টুকরো ছবিগুলো দেখছি আর মুহুর্মুহু হারিয়ে যাচ্ছি যেন। আদি-অন্ত দিগন্ত তো হারিয়ে যাওয়ার জন্যই।
ওয়াচ টাওয়ার থেকে নেমে এসে আস্তাবলের ওদিকেই এগোলাম। টাট্টুঘোড়াও আছে দেখছি। পনিটেইল দুলিয়ে দুলকি চালে চড়ে বেড়াচ্ছে তারা। খানিক দূরেই রামছাগলের খামার। তবে টাট্টুদের তুলনায় তাদের পাত্তা কম। খানিকটা মায়ায় পড়ে মাঝারি সাইজের বাদামি ছাগলটার দিকে এগিয়ে গেলাম।
আর সঙ্গে সঙ্গেই অভিযোগ, ‘বামন ঘোড়ার ঝাউবন মার্কা লেজ দেখতে লোকে হামলে পড়ছে। আর এই দেখো, কত্ত বড় দাড়ি রেখেছি। সারাক্ষণ আঁচড়ে রাখি আর কী তার বাহার। কিন্তু কেউ তো আসছেই না দেখতে। তোমরা মানুষেরা সব বর্ণবাদী...’
বর্ণবাদের অপবাদ মাথায় নিতে চাইলাম না। তার বদলে হাত বাড়িয়ে রামছাগলের মাথায় আলতো চাপড়ে দিলাম। দেখাদেখি আরও কজন এগিয়ে এল। বাচ্চাকাচ্চারা ছাগলের মস্ত শিং ধরে ছবি তোলার বায়না ধরল। দেখতে দেখতে ভিড় জমে গেল তার চারপাশে। বরং টাট্টুঘোড়ার দলটা এখন সরু চোখে তাকাচ্ছে এদিকে।
৭.
যাহোক, চতুর চেহারার রাকুন আর বেজায় রাগী বাইসন দেখে ভোঁদড়ের আস্তানায় এলাম। খুশি হওয়ার বদলে সে দাঁত খিঁচিয়ে উঠল, ‘দেখছ না মাছ ধরছি। লাঞ্চের পরে এসো। তখন বাৎচিত হবেখন’। বলেই সুড়ুৎ করে জলে ঝাঁপিয়ে গোল্ডফিশের ঝাঁক তাড়া করতে লেগে গেল সে। আমরা একটুও না নড়ে দাঁত কেলিয়ে তার কাজকারবার দেখতে লাগলাম।
হঠাৎ নিঃশব্দে ঘাড়ের কাছে এসে দাঁড়াল কে যেন। ঘুরে তাকাতেই পেখম মেলে চোখ ধাঁধিয়ে দিল ময়ূরকণ্ঠী ময়ূরটা। এত কাছে থেকে ময়ূর দেখছি এই প্রথম। নীল-সবুজের পরতে পরতে বনেদি আভিজাত্য। পেখম গুটিয়ে ময়ূরটা এবার এক পা–দুপা করে ধীরলয়ে এগোতে লাগল। মন্ত্রমুগ্ধ আমরাও তার পিছু নিলাম চুপচাপ। এখন সে হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা সেজে আমাদের কোনো খাদটাদে ফেলে না দিলে হয়।
না, তার বদলে সে আমাদের খোলা মাঠে নিয়ে এল। খেলার সরঞ্জামের অভাব নেই সেখানে। কাঠের রেলগাড়ি থেকে শুরু করে বাঁশের কুঁড়েঘর—কী নেই। একপাল শিশু–কিশোর দৌড়ঝাঁপে গরম করে রেখেছে পুরো এলাকা। আর তারই মাঝে অলস হেঁটে বেড়াচ্ছে অগুনতি ময়ূর। মূল আকর্ষণ যে তারাই, তা কি আর বলে দিতে হয়। এক একজন পেখম মেলছে আর ছেলে-বুড়ো আনন্দে হইহই করে উঠছে।
‘নিয়ম করা আছে। সিরিয়াল ধরে আমরা কলিগরা পাঁচ মিনিট পরপর পেখম মেলি। বিজনেস স্ট্র্যাটেজি, বুঝলে। নইলে এই করোনাকালে দর্শক ধরে রাখা মুশকিল। তার ওপরে আজকে আবার বৃষ্টির ফোরকাস্ট আছে’ বলেই চিন্তিত মুখে ঘোলাটে হয়ে আসা আকাশের দিকে চাইল সঙ্গের ময়ূরটা।
বৃষ্টি আসে আসুক। পইং পার্ক আর তার বাসিন্দাদের আমাদের খুব ভালো লেগে গেছে। রোদের শেষ ঝিলিকটা মেঘের আড়ালে লুকানোর আগপর্যন্ত আমরা রয়ে গেলাম সেখানে। পিংপং বলের মতোই গড়িয়ে বেড়াতে লাগলাম ইচ্ছেমতো। তারপর টিপটিপ বৃষ্টির হাত ধরে ফিরে চললাম বাড়ির পথে।
বুড়ো দাদু হরিণটা বিদায় জানাতে এগিয়ে এল। ‘ছাওপাও নিয়ে আবার এসো কিন্তু’। জবাবে ফিক করে হেসে বললাম, ‘তদ্দিন জ্যান্ত থেকো কিন্তু’। বুড়োটা মাথা দুলিয়ে হাসছে। নাহ্, এমন জাদুর জগতে আসতে যে আবার হবেই।
*লেখক: ড: রিম সাবরিনা জাহান সরকার, পোস্ট-ডক্টরাল গবেষক, ইনস্টিটিউট অব প্যাথোলজি, স্কুল অব মেডিসিন, টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটি মিউনিখ, জার্মানি।