পাতানো স্বপ্ন

প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত
প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত

‘সু’ বলেই ডাকতাম মেয়েটিকে। সুহাসিনী থেকেই সু। রাজ্যের আকণ্ঠ ভালো লাগায় ঠাসা এই নাম। এই নামটি যেন আমার হৃদয়ে গেঁথে গিয়েছিল সযতনে!

আট-দশটা সাদামাটা প্রেমের গল্পের মতো আমাদের সম্পর্কের শুরুটাও হয়েছিল বন্ধুত্ব দিয়ে। তারপর বন্ধুত্বের মাঠ পেরিয়ে ভালোবাসার আশ্রয়ে নিজেদের পারস্পরিক সমর্পণ।
তুমুল বৃষ্টি মাথায় নিয়ে একতোড়া বকুল আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলেছিল—এই ফুলগুলোতে তুমি কি দেখ?
কি অর্থ হতে পারে এই বাক্যটার? কোনটার কথা বলতে চেয়েছিল।
ওই বকুল তোড়া, ওই বৃষ্টিস্নাত মিষ্টি হাসিটা নাকি আমার হাতে তার নিজস্ব সত্তাকে সমর্পণ করার ইচ্ছেটা? কোনটার কথা বলতে চেয়েছিল।
আমি বুঝেও না বোঝার ভান করি। তার বুভুক্ষু চোখের আয়নায় এক নিরাসক্ত মানুষের ছবি আঁকার চেষ্টা করি। আমি যতই উদাসীনতার ভান করেছিলাম ততই ধরা পড়ে যাচ্ছিলাম।
এই মেয়েটার চোখজোড়া এত সুন্দর কেন? প্রপোজ করার মুহূর্তেই বোধ হয় একটা মেয়ের চোখগুলো সুন্দরতম হয়ে ওঠে। নিষ্পাপ এই চোখজোড়ার মাঝে কী যেন আছে। একগুচ্ছ সুখ আর অফুরন্ত মায়া। যা অনায়াসে যে কাউকে নিষ্পেষিত করতে পারে।
আমার অবদমিত চোখের ভাষায় সেই স্পষ্টই পড়ে ফেলেছিল—তাকে পাওয়ার জন্য লালপট্টি বেঁধে বুনো ষাঁড়ের সামনে দাঁড়িয়ে যাওয়ার মতো সাহসী হয়ে ওঠার গল্প।

প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত
প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত

দুই.

এরপর থেকে একত্রে কত তপ্ত দুপুর আছড়ে ফেলেছি বিকেলের কোল জুড়ে। একই হেডফোনের দুই স্পিকার দুজনের কানে লাগিয়ে গান শুনতে শুনতে বিকেলের গায়ে অজস্রবার নামিয়েছি কত সন্ধ্যা। কথার বাক্স খুলে কত বউ পালানো জ্যোৎস্না রাত শেষ করেছি তার কোনো ইয়ত্তা নেই।
ভালোবাসা জিনিসটা কখনো একা আসে না। সঙ্গে নিয়ে আসে অনেক আবেগ, অনুভূতি আর স্বপ্ন নিয়ে।
হাতভর্তি নীল চুড়ির রিনিঝিনি শব্দ, খোঁপায় গোঁজানো লাল টুকটুকে একগুচ্ছ কৃষ্ণচূড়া আর লাল পাড়ের সাদা শাড়ির মিশেলে অসম্ভব সুন্দর লাগত সুকে।
এ রকম বেশে তাকে দেখলেই আমি অদ্ভুত সব স্বপ্ন দেখতে থাকি। আমি কল্পনায় কিলবিল করতে থাকে অনেক দৃশ্য—এখন থেকে বছর তিনেক পর আমাদের ছোট ঘর হবে। এই কিউট মেয়েটি লাইটের রিফ্লেকশন পড়া লাল শাড়িতে বউ হয়ে আমার পাশে গুটিসুটি মেরে বসে থাকা মেয়েটির আধবোজা চোখ, মুখের ওপর ঘোমটার ছোঁয়া, ঠোঁটের কোনায় ল্যাপটানো হাসি।
সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠছি না বলে তার মিষ্টি কণ্ঠের রাগী রাগী ঝাড়ি। ভুলভাল বাজার এনেছি বলে কোমরে হাত দিয়ে বিরক্তি প্রকাশ। প্রত্যেকটা দৃশ্য আমি চোখ বুঝলেই স্পষ্ট দেখতে পেতাম।
আগে কোনো দিন স্বপ্ন দেখিনি। অথচ এখন আমি স্বপ্ন বুনতে থাকি প্রতিনিয়ত। নিরেট ভালোবাসায় ঠাসা একটা ঘর বাঁধার স্বপ্ন। সুহাসিনীই আমাকে স্বপ্ন দেখাতে শেখায়।
সুকে আমি প্রচুর উপহার দিতাম। আনিসুল হকের গল্প। হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাস। বিভিন্ন রকমের ফিল্ম। কিউট বিড়াল ছানা। আরও কত কী! সে উপহার পেয়ে প্রচণ্ড উচ্ছ্বসিত হতো। উচ্ছ্বসিত সুহাসিনীকে দেখার লোভ সামলাতে না পেরেই এটা ওটা উপহার দিতাম।

তিন.

সুহাসিনীর একটা পুরোনো অভ্যাস ছিল সবকিছুই অর্ধেক রেখে ছেড়ে দেওয়ার অভ্যাস। গল্প, উপন্যাস, ফিল্ম, শখ। সবকিছু মাঝপথেই ছেড়ে দিত। এমনকি তার পোষা প্রিয় বিড়ালটাও!
কিন্তু স্বপ্নেও ভাবিনি একদিন আমাকেও সে ছেড়ে চলে যাবে।
সে দশ লাইন পড়া গল্পটার মতো, সাত-আট পৃষ্ঠা পড়া উপন্যাসের মতো, নায়ক নায়িকার শেষ রসায়নের দৃশ্যটা না দেখা মুভির মতো কিংবা তার আদুরে খুব প্রিয় বিড়াল ছানার মতো!
মাঝেমধ্যে সে মজা করার চলে বলত। ইশারা করত সে হারিয়ে যাবে। আমার সময়টা কোথায় ছিল তার ইশারা দেখার কিংবা বোঝার? আমি তো ব্যস্ত ছিলাম নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার ধান্দায়! আমাকে যে নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে। সুকে পাওয়ার জন্য যে নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে।
নিজে ভালো থাকতে কত বাহানা দেখিয়ে নাটক করে সে চলে গেছে। যার কোনো প্রয়োজন ছিল না। নিখুঁত অভিনয় করেছিল। যে কেউ হার মেনে যাবে তার এত সুন্দর অভিনয় দেখে। কোনো দরকার ছিল না কিন্তু! স্বাভাবিকভাবেই চলে যেতে পারত।
অবাক লাগে, একটি বারের জন্যও সে আমার কথা ভেবে দেখেনি। একবারও কি মনে পড়েনি, বসন্তের শুকনো পাতার ওপরে নগ্ন পায়ে হাঁটতে হাঁটতে চোখে চোখ তাক করে ভালোবাসি বলার কথা। কচি ঘাসের ওপর পাশাপাশি বসে গোধূলি ক্ষণ দেখার কথা। আঙুলের ফাঁকে আঙুল রেখে হাজারো জোনাকিদের সাক্ষী রেখে শতাব্দীকাল একসঙ্গে থাকার সেই প্রমিজের কথা।
কি দরকারটা ছিল আমার জীবনে আসার? আমি তো ভালোই ছিলাম আমার একরাশ একলা খেয়ালি মন নিয়ে। মানুষ হিসেবে একা থাকার আনন্দের চেয়ে মিশে যাওয়ার ইচ্ছেতেই বেঁচে থাকার লোভে পড়ে গিয়েছিলাম মাত্র।
ভুল প্রমাণ করে দিল সে। চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে, উড়াল মেরেছি ভুল সময়ে, ভুল মানুষের কাছে, ভুল বারান্দায়।
আসলে চেহারা দিয়ে মানুষ চেনার চেষ্টা করা বোকামি। চেহারাটা মানুষের একটা মুখোশ মাত্র। মন হচ্ছে মানুষকে চেনার শুদ্ধতম পন্থা।
সু চলে যাওয়ার পর থেকে ভালো থাকতে চেষ্টা করছি। যদিও জোর করে ভালো থাকা যায় না। জোর করে ভালো থাকার অভিনয় করে যাচ্ছি!
বৃষ্টির প্রতিটি বিন্দু ব্যথা হয়ে কষ্টের বৃত্তে বিস্তৃত অনুভূতিতে বিঁধে যাচ্ছে বিরামহীন। পূর্ণ যৌবনা চাঁদের গা থেকে উপচে পড়া জ্যোৎস্না এখন আর ভালো লাগে না। বিষাক্ত লাগে!
আয়োজন করে জ্যোৎস্না ও বৃষ্টি বিলাস কীভাবে করতে হয় তা শিখিয়ে গেছেন হুমায়ূন আহমেদই। কিন্তু কীভাবে আয়োজন করে কাঁদতে তাতো শিখিয়ে যাননি!
কীভাবে ভালোবাসতে হয় এটা অনেকে শেখায়।
কিন্তু আফসোস, সেই ভালোবাসা কীভাবে ভুলতে হয় এটা কেউ শেখায় না!

লেখক সৌদি আরবের জেদ্দাপ্রবাসী। ফেসবুক: <www.facebook.com/shonali.shopno.33>