পাঞ্জাবি বনাম কুকুর

সেদিন ছিল আমার বড়ই আনন্দের দিন। আনন্দের আতিশয্যে আমার চোখে জল চলে এল। কিন্তু আনন্দের এই রকম আতিশয্য যে হঠাৎ করেই অতি শয্যায় রূপ নেবে, তা প্রথমে বুঝতে পারিনি।

ঘটনা খুলেই বলি। আমার স্ত্রী শিলা বিবাহবার্ষিকী উপলক্ষে একটি পাঞ্জাবি কিনে আমাকে সারপ্রাইজ দিয়েছে। উপহার পেয়ে আমি তো মহাখুশি। শিলা পাঞ্জাবিটা আমার হাতে দিয়ে বলল, ‘পরে দেখতো, কেমন লাগছে?’

আমি বরাবরই একজন ডিউটিফুল ও বিউটিফুল পত্নিনিষ্ঠ ভদ্রলোক। ঘরে এ ব্যাপারে খুব একটা সুনাম না থাকলেও, পাড়ায় আমার এই গুণের যথেষ্ট সমাদর আছে। আমি গায়ে থাকা স্যান্ডো গেঞ্জির ওপর পাঞ্জাবিটা পরতে গেলাম। কিন্তু একি! পাঞ্জাবি তো কোনোমতেই ঢুকছে না। বলা বাহুল্য, আমিই পাঞ্জাবির ভেতরে ঢুকতে পারছি না। বহু কষ্টে যদিও–বা পাঞ্জাবিটা শরীরে গলাতে পারলাম, কিন্তু ভুঁড়ির কাছে দিয়ে কোনোমতেই আর নিচে নামছে না। শিলা আমার পাঞ্জাবি নিয়ে এ রকম কসরত দেখে যারপরনাই বিরক্ত। একটু রেগে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘তোমার সাইজ কত ছিল?’
আমি তখন হাঁপাতে হাঁপাতে বললাম, ‘এই তো ৫ ফুট ৪ ইঞ্চি।’

ও আমার এই উত্তর শুনে বলল, ‘ঢং কোরো না তো। পাঞ্জাবির সাইজ বলো।’
আমি একটু শুকনো মুখে বললাম, ‘আমি ৪২ সাইজ পরি।’

ও তৎক্ষণাৎ আমার হাত থেকে পাঞ্জাবি ছিনিয়ে নিয়ে বলল, ‘এটাই তো ৪২ সাইজ। তাহলে ফিট করছে না কেন?’

আমি করুণ মুখ করে ওর দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘আসলে ৪২ তো বুকের মাপ। পেটের নয়। তোমার ভালো ভালো রান্না খেয়ে আমার ওজন গাণিতিক হারে আর ভুঁড়ি জ্যামিতিক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। তাই এই দশা।’

এই শুনে শিলা আরও খেপে গেল। বলল, ‘এই পাঞ্জাবিই তোমাকে পরতে হবে। এতে যদি তোমার ভুঁড়ির জ্যামিতি কমাতে হয়, তবে কমাবে।’ সারা জীবন পরীক্ষার মার্কসের ডিজিট থেকে শুরু করে মাসের বেতনের ডিজিট বাড়াতে বাড়াতে আমি ক্লান্ত। এখন নাকি আমাকে উল্টো ভুঁড়ির ডিজিট কমানোর জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করতে হবে।

আমি বললাম, ‘মুনিঋষিরা বলে গেছেন, বয়সের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের আয়তন বৃদ্ধি পায়। যেহেতু উচ্চতা বৃদ্ধির কোনো সম্ভাবনা নেই, সেহেতু জ্যামিতিক নিয়ম অনুযায়ী পাশে বেড়েই চলেছে। মানে ভুঁড়ির দিকটাতেই। সবই প্রাকৃতিক ব্যাপার। অনেকটা তোমার চুলে দেওয়া ওই হারবাল তেলের মতো।’ আমার স্ত্রীর প্রাকৃতিক বা হারবাল জিনিসের ওপর অগাধ বিশ্বাস। তাই এই চালটা চেলে দিলাম। সংসারজীবন অনেকটা দাবা খেলার মতো। একটু বুদ্ধি করে চাল দিতে হয়।

কিন্তু সেই চালে কাজ হলো না। শিলা হুঁশিয়ারি জারি করে বলল, ‘আগামীকাল থেকে বাসার সামনের পার্কে বেড়াবে। যাতে তোমার ভুঁড়ি কমে আর পাঞ্জাবিটা গায়ে হয়।’ পাঞ্জাবি উপহার হিসেবে পেয়ে একটু আগে যতটা আনন্দ হচ্ছিল, এখন ততটাই রাগ হচ্ছে।

কী আর করা! ভুঁড়ির ডিজিট কমিয়ে ডিজিটাল ভালোবাসার প্রমাণ করতে হবে আমায়।
পরদিন থেকে সকালে আমার কাঁচা ঘুম ভেঙে উঠতে হয়। তারপর পার্কের উদ্দেশে রওনা দিই। পাঞ্জাবি পরার কসরত এখন শরীর কসরতে রূপ নেয়। অত কসরত আমার ধাতে সয় না। তাই আমি পার্কের বেঞ্চিতে বসে ঝিমুতে থাকি। এ ক্ষেত্রে আমার একটা নিজস্ব যুক্তি আছে। আমার যুক্তি হলো, গাড়ি পার্কিং–এর জায়গায় গাড়িগুলো যদি বিশ্রাম নিতে পারে, তাহলে মানুষের পার্কে বসে আমারও ঝিমানোর অধিকার আছে। অনেকেই পার্কের বেঞ্চের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় আমার দিকে ড্যাব ড্যাব করে চেয়ে থাকে। তা থাকুক। আমার কিচ্ছু আসে যায় না। এ আমার সাংবিধানিক অধিকার। এই অধিকার কেড়ে নেওয়ার অধিকার কারোর নেই।

পার্কে কয়েক সপ্তাহ যাওয়ার পর আমাকে আবার সেই পাঞ্জাবি পরার কসরত করতে হলো। এবারও সেই একই ব্যাপার। কিছুতেই আমি পাঞ্জাবির ভেতর ঢুকতে পারছি না। এতেই বোধ হয় শিলার সন্দেহ হলো।

এক দিন আমি পার্কের বেঞ্চিতে হেলান দিয়ে ঝিমুচ্ছি। হঠাৎ আমার কাঁধে কে যেন হাত দিয়ে চাপ দিতে লাগল। আমি আরও আরামে হাতটিকে জড়িয়ে ধরলাম। ঝটকা মেরে হাত সরিয়ে নিল। আমি চোখ মেলে তাকিয়ে দেখি আমার স্ত্রী শিলা। মুখ ঝামটা মেরে বলল, ‘রোজ পার্কে আসো কি ঘুমানোর জন্য? হ্যাঁ?’

আমি বললাম, ‘তুমি বলেছ যে পার্কে বেড়াতে। তাই আমি বাসা থেকে বেরিয়ে বেড়াতে বেড়াতে পার্কে এসে একটু বিশ্রাম নিচ্ছি।’

শিলা মুখ ভেংচে বলল, ‘উঃ, বিশ্রাম নিচ্ছি! তা পার্ক কি তোমার বিশ্রাম নেওয়ার জায়গা?’

আমি তখন গাড়ি পার্কিং–এর যুক্তিটি দিলাম। শিলা এ রকম অকাট্য যুক্তি শুনে একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। ও! বাবা! ভ্যাবাচ্যাকা খাবে না? এ যুক্তি কি যে সে যুক্তি? একেবারে সাংবিধানিক যুক্তি। এর ওপর আর কোনো যুক্তি চলে না।
এবার সে অগ্নিমূর্তি ধারণ করে বলল, ‘এই মুহূর্ত থেকে পার্কে দৌড়াবে। যাও দৌড়ও।’
অগত্যা পার্কের বেঞ্চ ছেড়ে দৌড়ানোর প্রস্তুতি নিতে হলো আমার। পাঞ্জাবি পরার জন্য আমার মতো বাঙালির যে কষ্ট করতে হচ্ছে, সেই কষ্ট একজন পাঞ্জাবি ভদ্রলোকেরও করতে হয় না।

আমি অল্প অল্প করে আস্তে আস্তে ছুটছি। আমার পাশে এক ভদ্রলোক তাঁর কুকুর নিয়ে ছুটছেন। কুকুরটি দড়িতে বাঁধা। দড়ির এক প্রান্ত কুকুরের গলায় আর এক প্রান্ত লোকটি হাতে ধরে রেখেছেন। দড়ি বাঁধা কুকুরটি সামনে সামনে ছুটছে আর ভদ্রলোক ছুটছেন কুকুরের পেছন পেছন। আমার সব সময়ই কুকুরে আতঙ্ক আছে। কুকুর আতঙ্ক কোনো রোগ কি না জানি না। তবে জলাতঙ্ক একটি রোগ জানি। পাগলা কুকুর কামড়লে এই রোগ হয়। মানুষ তখন জল দেখলেই ভয় পায়। আমি বোধ হয় আরও এক ডিগ্রি বেশি সাবধানি মানুষ। তাই কুকুর আমাকে কামড়ানোর আগেই কুকুর দেখেই আমার আতঙ্ক হয়। আমার হাঁটু কাঁপতে থাকে।

আতঙ্ক একটি প্রাকৃতিক ব্যাপার। প্রাকৃতিক বললাম এই কারণে যে প্রকৃতির অমোঘ নিয়মেই আমার এই আতঙ্ক পাশের ভদ্রলোকের হাতে ধরা কুকুরের মধ্যে সংক্রমিত হয়ে গেল। কুকুরটি কেমন করে যেন তাঁর মালিকের হাত থেকে ছুটে গিয়ে আমার পেছন পেছন ছুটতে লাগল। অমনি আমার কুকুর আতঙ্ক মাথা চাড়া দিয়ে উঠল। যার কারণে আমি আরও জোরে ছুটতে লাগলাম। আমি যত জোরে ছুটছি, আমার পেছনে কুকুরও তত জোরে ছুটছে। শুনতে পাচ্ছি কে যেন চিৎকার দিয়ে ডাকছে, ‘ডিউক, ডিউক...স্টপ ডিউক!’

ইতিমধ্যে পার্কের অনেকেই ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছেন। তাঁরাও চেষ্টা করছেন কুকুরের হাত কিংবা দাঁত থেকে আমাকে বাঁচাতে। তাঁরাও ছুটছেন। ফলে দেখা গেল, আমার পেছনে ছুটছে কুকুর, কুকুরের পেছনে ছুটছেন কুকুরের মালিক, তাঁর পেছনে ছুটছে আমার স্ত্রী এবং সবশেষে আমার স্ত্রীর পেছনে ছুটছে গোটা পার্কের উৎসাহী জনতা। এ এক অভাবনীয় দেখবার দৃশ্য!
ধীরে ধীরে আমার দম ফুরিয়ে আসছে। আমার এই বিশাল বপু নিয়ে এত জোরে এত দূরত্ব দৌড়ানো অসম্ভব। আমার দ্রুত নিশ্বাস পড়ছে, বুক ধড়ফড় করছে ও পেট দ্রুত ওঠানামা করছে। দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে যা হয়, আমার তখন সেই অবস্থা। শুধু আমার পিঠের দিকে দেয়াল নেই, আছে কুকুর। মনে মনে একটু সাহস সঞ্চয় করে আমি হঠাৎই একটা হার্ডব্রেক করে বসলাম। কুকুরসহ কুকুরের মালিক হতভম্ব হয়ে গেল। নিজের মনে বললাম, ‘পথে এসো বাছাধন!’
তারপর ঘুরে দাঁড়িয়ে পজিশন নিলাম। ক্রিস্টিয়ানো রোনাল্ডো যে রকম করে পেনাল্টি শট নেয়, ঠিক সে রকম করে শরীরের সব শক্তি দিয়ে কুকুর বরাবর একটি পেনাল্টি শট দিলাম। কিন্তু হায় কপাল! কুকুরটি আমাকে ততক্ষণে ডজ দিয়ে দিয়েছে। ফলে শট গিয়ে লাগল পাশের লাইট পোস্টের গায়ে। আমার গায়ে জোর কম তা আমার অতি বড় শত্রুও বলতে পারবে না। সুতরাং সর্বশক্তি প্রয়োগ করা লাথিটি যখন কুকুরের গায়ে না লেগে লাইট পোস্টে লাগল, তখন আমি ব্যথায় পা চেপে বসে পড়লাম।
কুকুরটি তখন বিশ্বজয়ের আনন্দে ওর মালিকের পায়ের কাছে গিয়ে কুই কুই করছে। আর মালিক ভদ্রলোকটি কুকুরের গলার কাছে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে আমার দিকে তাকিয়ে হেসে হেসে বললেন, ‘ভাই, লাগেনি তো?’
শিলা ততক্ষণে এসে পড়েছে। কুকুরের মালিকের দিকে তাকিয়ে তাঁর সেই পুরনো রণমূর্তি ধারণ করে বলল, ‘ইয়ার্কি হচ্ছে? কুকুর সামলিয়ে রাখতে পারেন না তো পার্কে কুকুর নিয়ে আসেন কেন?’
এত ব্যথার মধ্যেও আমার চোখে খুশিতে জল চলে এল। এত দিন এই রণমূর্তি শুধু আমিই দেখেছি। আর এখন দেখছেন কুকুরের মালিক ভদ্রলোকটি। বুঝুক মজা!
পার্কের সবাই ধরাধরি করে আমায় পাড়ার ডাক্তারের চেম্বারে নিয়ে গেল। ডাক্তার এক্স-রে করে বললেন, ‘পায়ে একটা ফ্র্যাকচার হয়েছে। প্লাস্টার করে দিচ্ছি। বেশ কিছুদিন বেড রেস্টে থাকতে হবে।
শুনে আমার আবার চোখ জলে ভরে গেল। কী যে আনন্দ হচ্ছে আমার! মৃদুস্বরে গুন গুন করে গাইতে লাগলাম, ‘আহা! কী আনন্দ আকাশে বাতাসে... ” সকালের কাঁচা ঘুম ভেঙে আমাকে আর তো দৌড়াতে হবে না।
শিলা অবশ্য পাঞ্জাবি বদলিয়ে একটি ৫০ সাইজের আলখাল্লা নিয়ে এসেছে। আর কোনো চিন্তা নেই ডিজিট কমানোর। ডিজিটে কি এসে যায়! এ কি ডিজিটাল ভালোবাসা, যে ডিজিট মেপে চলতে হবে! অ্যা!
জয় কুকুরের জয়!