পাখি রে তুই

‘পাখি রে তুই দূরে থাকলে কিছুই আমার ভালো লাগে না/ পাখি রে তুই...।’ বহুদিন ধরে শখ ছিল একটা পাখির পার্ক দেখার। কিন্তু শখের সঙ্গে সুযোগ ও সময়ের সমন্বয় করা বড়ই দুষ্কর এখানে। বন্দী কর্ম প্ল্যাটফর্ম থেকে ইচ্ছা করলেই ডানা মেলা যায় না। তারপর যদি কিছু সময় ধারদেনা করে একটা পাখির পার্কে একদম একা একা আমোদ-প্রমোদ করতে যাওয়া যায়, তাহলে সেই আমোদের মধ্যে কতটুকুই-বা আমোদিত হওয়া যায়? তারপরও কতটুকু সুখ পূর্ণ করতে পেরেছিলাম, তার বর্ণনা শেষে লিখব।

শনিবার। আজ যাব কি যাব না, এমন প্রশ্ন বারবার নিজেই নিজের কাছে করতে করতে অবশেষে পাখি দেখার লক্ষ্যে রওনা দিলাম নিঃসঙ্গভাবে। স্থান ওয়ার্ল্ড অব বার্ডস, মাঙ্কিপার্ক, হট-বে, কেপটাউন। ব্যক্তিমালিকানা একটি বার্ডস পার্ক। মালিকের এমন একটি পার্ক বানানোর স্বপ্ন ছিল শৈশব থেকেই। কিন্তু পিছুটান মন নিয়ে শৈশব-স্বপ্নে প্রবেশ না করে অন্য ব্যবসায় মনোনিবেশ করেন। কিন্তু ভালো করতে না পেরে সে ব্যবসা গুটিয়ে ফেলতে বাধ্য হলেন। অবশেষে দুই একর জমির ওপর পাখির সঙ্গেই বসবাসের সিদ্ধান্ত নিলেন।

আমি ৮৫ রেন্ড (আফ্রিকার মুদ্রা) দিয়ে একটি টিকিট কিনে খাতায় নাম ও ফোন নম্বর লিখে ভেতরে প্রবেশ করি। প্রবেশ করামাত্রই স্তব্ধ হয়ে গেলাম। পাখিপাগল মানুষ আজ পাখিপার্কের দর্শনার্থী। কত দর্শনার্থী! বাইরে থেকে বোঝার উপায় নেই যে পাখিপার্কে এত মানুষ এসেছে পাখি দেখতে।

আজ যে পার্কে এসেছি, সেটা শুরু করতে গিয়ে শুরুতেই তছনছের গল্প। পার্ক তৈরি করতে কিছু পাখি আনা হয়। একদিন কুকুরের তাণ্ডবের জন্য কিছু পাখি মারা যায়, আর যেগুলো জীবিত ছিল, সেগুলো ডানা অথবা পা ভেঙে পঙ্গু হয়ে যায়। তখন মালিকের ধারণা হলো, তার পক্ষে আর পার্ক সম্প্রসারণ বা টিকিয়ে রাখা সম্ভব নয়। হাল ছেড়ে দেওয়ার মুহূর্তে এগিয়ে এলেন এক দম্পতি। তাঁদের উৎসাহ-উদ্দীপনায় আবার এগিয়ে এলেন এই পাখিপাগল।

গাছের নিচে, ছায়াঘেরা পরিবেশে বিভিন্ন জাতের পাখির জন্য আলাদা আলাদা বসবাসযোগ্য রুম বা খাঁচা তৈরি করা হয়েছে। এখন যেমন পার্কটি পরিপাটি অবস্থায় আছে, তবে শুরুর গল্পে রয়েছে ধৈর্যের সারি সারি লক্ষ্যভ্রষ্টের তালিকা। ১৯৭৯ সালের কথা। কিছু পরিচিত পাখি নিয়ে যাত্রা শুরু। প্রবেশমূল্য ছিল ৭৫ সেন্টস। আর বাচ্চাদের জন্য মাত্র ২৫ সেন্টস। স্কুলপড়ুয়াদের জন্য রাখা হতো মাত্র ১০ সেন্টস করে। তখন বিদ্যুৎ ছিল না। পাখি দেখার জন্য প্রবেশ ফি চাইলে অনেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। তখন চারজনের বেতন দিতে হয়েছে। মালিক নিজে গাড়ি চালিয়েছেন। নিরাপত্তার বিষয়টি মাথায় রেখে প্রতি সন্ধ্যায় পাখিদের টেনে নিজ বাসায় নিয়ে রাখতেন। ভোরে আবার পার্কে এনেছেন।

সেই ১৯৭৯ সালে কষ্টার্জিত পার্কটি আজ পাখিতে ভরপুর, এ যেন সিদ্ধের সঙ্গে সিদ্ধমনোরথ। শত শত প্রজাতির ৪ হাজারের বেশি পাখির মুখরিত কলতানে পার্কটি আড়ম্বরপূর্ণ। ৪০ জন শ্রমিক দেখভাল করতে ব্যস্ত। সত্যি, এটি কেপটাউন জনগণের জন্য আধ্যাত্মিক সৃষ্টি ও ঐতিহ্যবাহী পর্যটনক্ষেত্র।

পার্কে গিয়ে বিস্মিত না হয়ে উপায় নেই। রীতিমতো হতভম্ব হয়ে গেলাম। গেট দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করামাত্রই পাখিপ্রিয় অসংখ্য মানুষের ভিড় দেখলে একদম আঁতকে উঠতে হয়। বন্ধুমহলের আগমন, পরিবারসহ সমাগম, প্রেমিক-প্রেমিকাদের উপগমন, সঙ্গীহীন পদার্পণ, শিশুদের আগুয়ান, যুবক-যুবতীদের অভ্যাগমন আর বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের উপস্থিতিতে পাখিপার্কটি যেন উত্পাত-নিবৃত্তি এক নন্দনকানন।

আজব কাণ্ড! মিশ্র পাখির বসবাস। একেক জাতের পাখি একেক জায়গায়। বড় বড় খাঁচা দিয়ে ঘেরা। পরিবেশও ছায়াঘেরা। চেনা-অচেনা, নাম জানা-অজানা হরেক রকমের পাখির সংগ্রহশালা। একটা জায়গায় ঘুঘু পাখি, পরেরটাতে টিয়া পাখি, তার পরেরটায় আছে ময়না পাখি। ময়না পাখি দেখা হলে পরেরটাতে দেখা মিলবে বানর। এভাবে অসংখ্য খাঁচার রুম, আর অসংখ্য জাতের পাখি, যা খাঁচার বাইরে থেকে স্পষ্ট দেখা যায়।

এ যে ঘুঘু, টিয়া, ময়না, বানরের কথা বলা হলো, এ সব কটির আবার এক রঙের নয়, বিভিন্ন রঙের আছে। কোনোটা সাদা, কোনোটা লাল, কোনোটা হলুদ, আবার একের মধ্যে মিশ্র রংও দেখতে পাওয়া যায়, যা সাধারণত দেখা মেলে না। এদের দেখলে শুধু বলতে ইচ্ছা করে, খাঁচা ভেঙে পাখি রে তুই আমার কাছে আয়।

সারস পাখিগুলো ঢং করে কত আহ্লাদে দাঁড়িয়ে আছে। এক পায়ে। অন্য পা নিজ পালকের ভেতর লুকিয়ে রেখেছে। সাদা ধবধবে এ পাখিগুলো দর্শনার্থীদের আকৃষ্ট করে। পাশের রুমে আছে উটপাখি, তাদের সঙ্গে মিতালি করে খেলাধুলায় মগ্ন হয়ে আছে রাজহাঁসগুলো। বড় বড় উটপাখি। আর হাঁসগুলোর রং যেমন চেনা-অচেনা, তেমন দেখা বা না দেখা জাতের।

বানরগুলো দেখলে তাদের দিকে দর্শনার্থীদের চোখ ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে। আমরা গ্রামগঞ্জে সাধারণত যে ধরনের বানর দেখি, সেগুলো অবাক করেনি আমার। অবাক করেছে সেই বানরগুলো, যে বানরগুলো খুব ছোট ছোট এবং বহু বৈচিত্র্যময়। একেকটির সাইজ হবে ঠিক কাঠবিড়ালির সমান। বিভিন্ন রঙের। এক ডাল থেকে অন্য ডালে লাফিয়ে লাফিয়ে স্বাচ্ছন্দ্যে খেলাধুলা করছে। অদ্ভুত লাগছে তাদের চেহারা ও আচরণ। অনেকে সবুজ ঘাসের ওপর বসে গেছেন বানরের আদর করতে।

ভাবছি একা একা। এ যেন এক অদ্ভুত জায়গায় এসেছি। এত ছোট্ট বানর! একেকটার সাইজ মাত্র ১০ থেকে ১৫ সেন্টিমিটার। দেখলে হাসি লাগে। ইচ্ছামতো খেলায় ব্যস্ত। এ ডাল থেকে ও ডাল। এক হাত দিয়ে ডাল ধরে ঝুলে আছে। হলুদ, লাল, কালো, সবুজ, সাদা, মিশ্র রঙের বানর দেখা যায়। এদের ধরে শার্টের পকেটে রেখে দেওয়া যায়।
টিয়া পাখি আছে ডালে ডালে। অসংখ্য টিয়া পাখি। লাল টিয়া, হলুদ টিয়া, সবুজ টিয়া, কালো টিয়া, আরও অনেক রঙের টিয়া আছে। সীমিত জায়গায় কোনোটি উড়ছে, কোনোটি ডাকছে, কোনোটি দর্শনার্থীদের দিকে তাকিয়ে আছে।

রাজহাঁস, প্যাঁচা, চাতক পাখিও দেখা গেল। শজারু, কাঠবিড়ালি, পেঙ্গুইন ইত্যাদি দিয়ে সাজানো পার্কটি।

ময়ূর যখন পাখা ছড়িয়ে দিল, ঠিক তখন পাশে থাকা উটপাখিগুলো গলা উঁচু করে খাঁকারি দিচ্ছে। দেখা যেতে পারে দক্ষিণ আফ্রিকার জাতীয় পাখি নীল ক্রেন। সেক্রেটারি বার্ড আর হুইসেলিং হাঁসের সঙ্গে খেলায় মত্ত হয় নীল ক্রেন। ফ্লেমিংগো, অস্ট্রিচস যখন গলা ফাটিয়ে দর্শনার্থীদের স্বাগত জানাচ্ছে, ঠিক তখন হেলমেট গিনিফোল মানুষের ভিড় দেখতে ব্যস্ত।

কোয়েলের দল যেমন চক্রবন্দী হয়ে ঘুরপাক খাচ্ছে, ঠিক তখন লেবু ঘুঘুরা গলার মালা ফুলিয়ে অগ্রসর হয় ডালে ডালে।

এখান থেকে দু পা সামনে এগিয়ে গেলে হরেক রকমের কবুতরের বাকবাকুমের সঙ্গে কোকিলের কহু কুহু কুহুতানে স্যান্ডগ্রাউসের যেন ঘুমের খুবই ব্যাঘাত হচ্ছে।

কোয়েল, প্যাঁচা, মধুচক্র, কেল্পগল, বুলবুলি—এ রকম অসংখ্য পাখির চেহারা দেখলে ও ডাক শুনলে মনের অস্থিরতা বন্ধ হয়ে যায়। তাই তো বিশ্বে অন্যতম পাখি বিশেষজ্ঞ মার্টল রিড বলেছেন, পাখি হলো আনন্দ-অবতার। কেপটাউনের ওয়ার্ল্ড অব বার্ডস ও মাঙ্কি পার্কে এলে জানা যায় পাখিদের কোনো স্বার্থ থাকে না, ওরা নিষ্ঠুর হতে জানে না।

আকাশে ওড়া প্রতিটি পাখির চিরায়ত অধিকার। বাক্যটির মর্মার্থ সত্য স্বীকার করতেই হয়। তবু এই বাক্যে একটু কেন যেন আমার বাঁক মারতে ইচ্ছে করছে। পরিপূর্ণ পরিকল্পনাতে সৃষ্ট ও আয়োজনে পার্কটিতে আসা প্রত্যেক দর্শনার্থীর মন জয় করাই প্রতিটি পাখির চিরায়ত অধিকার।

লাল ঠোঁটে গলার নিচপাটে গাঢ় হলুদ রঙের পালক, আর ওপরের দিকে নীল রঙের অঙ্গরূহ দিয়ে কাকাতুয়াগুলো যেভাবে সেজেছে, তাতে ওদের কাছ থেকে বাড়তি অমূল্য তৃপ্ত বা জীবনোত্ফুল্ল সঞ্চয় গ্রহণ করে থাকেন দর্শনার্থীরা। সাইড লাইনে দেখলাম, একজোড়া ছেলেমেয়ে। কাকাতুয়া দেখতে দেখতে তাদের দেখে ফেললাম। ঠিক যেন ‘চাঁদ দেখতে গিয়ে আমি তোমায় দেখে ফেলেছি’।

এই এক জোড়া ছেলেমেয়ে এমনভাবে কাকাতুয়া পাখিদের উপভোগ করছে, যেন তারা শুকতারা হাতে পেয়েছে। মেয়েটির মাথার চুলগুলো দেখতে খেজুরগাছের ফুল বা মুচি; অর্থাৎ পুষ্পমঞ্জরির মতো। আর ছেলেটার মাথার চুল ছিল পাখির বাসার মতো, অর্থাৎ ঠিক কলম্বিয়ার জাতীয় দলের সাবেক ফুটবলার কার্লোস ভালদেরামার, কদমফুল মার্কা। কাকাতুয়া দেখতে দেখতে ওদের দিকেও অনেকক্ষণ তাকিয়ে ছিলাম, ওরা যেন টের না পায়, অথবা কে কী ভাববে, সে কারণে চুরি করেও চেহারা দেখছিলাম, তাকাচ্ছিলাম বারবার।

একা একা ঘুরতে কি ভালো লাগে? হ্যাঁ লাগে, অন্য কোথাও ভালো না লাগলেও পাখিপার্কে একা ঘুরতেও ভালো লাগে। বানর আর পাখিদের কারবার দেখলে যেখানে জগৎ ভুলে যেতে হয়, সেখানে সঙ্গী না হলে দোষ কি? একা হলেও পাখিপার্কে এলে মন ভরে যায়, আনন্দের কমতি থাকে না বিন্দুমাত্র। এত এত পাখি দেখে যখন ফিরছিলাম, গেট দিয়ে বের হচ্ছিলাম, ঠিক তখন পেছন থেকে কে যেন ‘ব্রাদার’ বলে ডাক দিল।

ব্রাদার ডাক শুনে ঘাড় ফিরিয়ে দেখি, গাছের ডালে বসে আছে ময়না পাখি। তার কাজ এটাই, দর্শনার্থীরা ফিরে যাওয়ার সময় তাদের আবার এসো বলে বিদায় জানানো। অবশেষে বিদায় নিলাম। যেতে যেতে শুনছি ‘পাখি রে তুই দূরে থাকলে কিছুই আমার ভালো লাগে না, পাখিরে তুই...’।


*লেখক: মাহফুজার রহমান, কেপটাউন, দক্ষিণ আফ্রিকা