পাইন্যা জোঁক

গ্রামের বাড়িতে সচরাচর যাওয়া হয় না। ২/৩ বছরে একবার যাওয়া হয়। বহু বছর আগের কথা, তখন সম্ভবত আমি ক্লাস এইটে পড়ি। আমরা সপরিবারে গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে গেলাম। সেখানে ভালোই সময় কাটছে ঘুরেফিরে। গ্রামের নির্মল বাতাস ও সবুজ প্রকৃতি বেশ উপভোগ করছিলাম। আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে দেখা হচ্ছে, সবাই খুব আদর করছে। এমন অকৃত্রিম ভালোবাসা মনে হয় গ্রামেই পাওয়া যায়। পার্শ্ববর্তী গ্রামে আমার এক ফুফুর বাড়িতে দাওয়াত খেতে আমরা সবাই গেলাম। আমার ফুপাতো ভাই মাহিন ছিল খুব দুষ্ট প্রকৃতির। আমার সমবয়সী হওয়ার কারণে ওর সব দুষ্টুমি আমাকে ঘিরেই। আমি মনে মনে বিরক্ত হলেও খারাপ লাগছিল না। দাওয়াত খাওয়া শেষে বিকেল বেলা বাকি সবাই চলে গেলেও সেদিন আমি ফুফুর বাড়িতে থেকে যাই।
মাহিনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমিও বেশ দুষ্টুমি করছি। আশপাশের বাড়িতে গিয়ে ফল চুরি করে খাচ্ছি। এসব করে খুব মজা পাচ্ছিলাম। সন্ধ্যা বেলায় ফুফুর বাড়িতে ফিরে মাহিনকে নিয়ে প্রতিযোগিতামূলক জাম্বুরার ভর্তা খেলাম। মাহিন আমাকে জব্দ করতে জাম্বুরা ভর্তায় কাঁচা মরিচ, শুকনো মরিচ পোড়া ও গুঁড়ো মরিচ ইচ্ছে মতো দিয়েছিল। মরিচের ঝালে আমার জিহ্বা যেন পুড়ে যাচ্ছে আর দুই কান দিয়ে ধোঁয়া বের হচ্ছে। সারা শরীর ঘেমে অস্থির অবস্থা আর দুচোখ ভরে পানি পড়ছে। আমি আর সহ্য করতে না পেরে হু-হা-হু-হা...করে চেঁচামেচি শুরু করে দিলাম। মাহিন আমার বেগতিক অবস্থা দেখে দ্রুত কিছু মিষ্টি ও এক জগ পানি এনে দিল। মিষ্টি ও পানি খাওয়ার কিছু সময় পর ধীরে ধীরে ঝাল কেটে যায়।
রাতের দিকে মাহিন আমাকে নিয়ে খেতে কোঁচা দিয়ে মাছ শিকারে বের হল। আমি তো মনে মনে বেশ উত্তেজিত ছিলাম, তবে কোন রকম দুষ্টুমি না করার শর্তে মাহিনের সঙ্গে গেলাম। খেতের আইলে আইলে হেঁটে টর্চ লাইট জ্বালিয়ে মাহিন কোঁচা দিয়ে মাছ শিকার করছে আর আমি টুকরিতে মাছ সংগ্রহ করছি। হঠাৎ করেই আমার প্রকৃতির ডাক পড়ে। যা ছিল সহ্যের বাইরে, তাই বাধ্য হয়ে খেতের আইলে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিলাম। সম্ভবত খোলা আকাশের নিচে, প্রকৃতির মাঝে এটাই ছিল আমার জীবনে প্রথম ও শেষ বার প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেওয়া।
সেই যে বসেছি আর ওঠার নাম নেই। ভীষণ রকম পেট খারাপ করেছে। প্রকৃতির ডাকে পটকার মতোই বুটবাট-পুটপাট শব্দ হচ্ছে। দুর্গন্ধ সহ্য করতে না পারে মাহিন আমার কাছ থেকে একটু দূরে সরে গেছে। এদিকে আমি পেটের ব্যথায় মাগো-বাবাগো-আল্লাগো করছি আর পাশাপাশি মাহিনকেও বকাঝকা করছি। প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেওয়া শেষে পরিষ্কার হতে পাশেই একটি ডোবায় গেলাম। সেখানে পরিষ্কার হয়ে বাড়ির পথে রওনা দিলাম।
হঠাৎ মাহিন আমার পায়ের ওপর টর্চ লাইট মেরে বলে উঠল, তোর পায়ে তো পাইন্যা জোঁক। সম্ভবত ডোবা থাইক্যা উঠছে। আমি তখন সঙ্গে সঙ্গে আবারও মাগো, বাবাগো, আল্লাগো বলে তিন চারটা লাফ দিলাম। জোঁকের আতঙ্কে আমার হাতের মুঠোয় রাখা মাছের টুকরি কোথায় উড়ে গেল, সেদিকে খেয়াল নেই। সমানে লাফাচ্ছি আর চেঁচামেচি করে যাচ্ছি। মাহিন তখন আমার কাঁধে হাত রেখে বলল, তুই এইবার থাম। অযথাই তোকে ভয় দেখালাম। এত কষ্ট করে শিকার করা মাছগুলো আবারও খেতে চলে গেছে। এবার চল, আমরাও বাড়ি ফিরে যাই। আমি তো তখন রেগেমেগে আগুন। পারলে মাহিনকে জাম্বুরা ভর্তা বানিয়ে খাই।
পাইন্যা জোঁকের ঘটনা এখানেই শেষ নয়। আমার বিয়ের পর আমেরিকাপ্রবাসী নতুন বউ নিয়ে ফুফুর বাড়িতে দাওয়াত খেতে গিয়েছিলাম। মাহিন আমার আদরের নতুন বউটাকেও মাফ দিল না। সেই একই কায়দায় ভয় দেখাতে হঠাৎ করেই বলে উঠল, ভাবি আপনের পায়ে দেখি পাইন্যা জোঁক। আমার বউ তো ভয়ে এক চিল্লিতেই মাটিতে পড়ে অজ্ঞান।