পরিজান বিবির কেচ্ছা

আমার দাদির নাম ছিল পরিজান নেছা। একজন ঘোর কৃষ্ণবর্ণের মানুষের এমন নাম হতে পারে সেটা আমি আমার দাদিকে না দেখলে বুঝতামই না। দাদির নামকরণের সার্থকতা নিয়ে অনেকবার ভেবেছি। যার ফলে একটা ব্যাখ্যা মাথায় এসেছে। দাদির বাবারা ছিলেন পাঁচ ভাই আর দুই বোন। মোট সাত ভাইবোনের মধ্যে সবচেয়ে বড় ছিলেন আমার দাদির বাবা আব্বাস আলী মণ্ডল। আর তারই বড় মেয়ে আমার দাদি। তাই স্বভাবতই সকলের আদরের ছিলেন। সেখান থেকেই হয়তোবা এমন নামকরণ। পরিজান নেছার পরে আব্বাস আলী মণ্ডল ও খাতুন নেছার ঘরে আরও দুটি মেয়ে সন্তানের জন্ম হলেও তাদের আর সেভাবে আলাদা করা গেল না। তাই ছোট দুই বোন কোহিরুন ও উকিরুন নেছার চেয়ে অনেক বেশি আদরে বড় হতে থাকলেন পরিজান নেছা।
পরিজন নেছার জন্ম পদ্মা নদীর চর এলাকায় হলেও তার বিয়ের জন্য ভালো বংশের পাত্র খোঁজা শুরু হলো। পদ্মা নদীর অপর পারে প্রামাণিক বংশে এক সুযোগ্য পাত্রের সন্ধান পাওয়া গেল। নজর আলী পণ্ডিতের পরিচিতি আশপাশের কয়েক গ্রামজুড়ে। নজর আলী পণ্ডিতই একমাত্র শিক্ষিত ব্যক্তি তখন শালদহ ও বোয়ালদহ গ্রামে। নজর আলী পণ্ডিত নিজে শিক্ষিত হওয়ার পাশাপাশি গ্রামের মানুষদের কথা মাথায় রেখে গ্রামেই একটা পাঠশালা স্থাপন করলেন। নজর আলী পণ্ডিতের দুই ছেলের বড়জনের সঙ্গে পরিজান নেছার বিয়ের সম্বন্ধ তৈরি হলো। এরপর অনেক ধুমধামের সঙ্গে বিয়েটাও হয়ে গেল। আশকার আলী আর পরিজান নেছার ঘর আলো করে এরপর জন্ম নিল একে একে পাঁচটি সন্তান। নজর আলী পণ্ডিত নিজে শিক্ষিত বলেই মারা যাওয়ার আগে নাতিনাতনিদের শিক্ষার ব্যাপারটা নিশ্চিত করতে বলে গিয়েছিলেন। সেই মোতাবেক তাঁর বড় নাতি আশরাফ আলীকে বই কিনে স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেওয়া হলো। স্কুলে তার ফলাফলও ভালো। বরাবরই প্রথম হয়। তাই তৃতীয় শ্রেণি পাস করার পর স্কুলের স্যার একদিন ডেকে বললেন, এইবার তুমি একবারে ক্লাস ফাইভের বই কেনো। কিন্তু তখনই এক রোগে আশকার আলী অকালে এই পৃথিবীর মায়া ছেড়ে চলে গেলেন। এরপর আব্বাস আলী মণ্ডল পরিজান বিবিকে সপরিবারে তার নিজের কাছে নিয়ে গেলেন। তারপর থেকে পরিজান বিবি আবার তার বাবা-মায়ের সঙ্গে জীবনযাপন শুরু করলেন।
ছোটবেলায় একটা বয়স পর্যন্ত আমার একমাত্র বাহন ছিল দাদির কোল বা শাড়ির আঁচল। কোল বাহন হতে পারে কিন্তু আঁচল কীভাবে বাহন হতে পারে সেটা নিয়ে অনেকেই বিভ্রান্তিতে পড়তে পারেন। তাই আগেই ব্যাপারটা বলে নেওয়া দরকার। আমাদের মেজো ভাইটা জন্ম নেওয়ার আগ পর্যন্ত দাদি আমাকে সারাক্ষণই কোলে করে রাখতেন। যেখানেই যেতেন আমাকে সঙ্গে করেই নিয়ে যেতেন। পরবর্তীতে মেজো দাদির কোলে জায়গা করে নেওয়ার পর দাদিকে অনুসরণ করার একমাত্র উপায় ছিল দাদির আঁচল ধরে ঘুরে বেড়ানো। দাদি যেখানেই যেতেন তার কোলে থাকত আমাদের মেজো ভাইটা আর শাড়ির আঁচল ধরে থাকতাম আমি। এটা নিয়ে অনেকেই মজা করে বলতেন আমাদের দাদি দুই কাঁধে দুইটা বন্দুক নিয়ে ঘোরে। বাস্তবেও ব্যাপারটা আসলেই এমন ছিল। দাদিকে নিয়ে পরিবারের বাইরে বা ভেতরে কোনো কথা বললে আমি সেই কথা শুনে এসে দাঁড়ি কমাসহ হুবহু নকল করে দাদিকে বলে দিতাম। এজন্য আমাকে অনেকেই আড়ালে দাদির ব্যক্তিগত গোয়েন্দা বলেও ডাকত এবং আমাকে আশপাশে দেখলেই সবাই কথা বলার ব্যাপারে সাবধানতা অবলম্বন করত।
দাদিকে আমি তেমন কোনো কাজ কখনোই করতে দেখিনি। বরং দেখেছি সারা পাড়ার কোথায় কার মেয়ের বিয়ে কার ছেলের সুন্নতে খতনা সেসব জায়গায় দাদিকে ডাকা হতো গীত গাওয়ার জন্য। তখনো প্রযুক্তি আমাদের গ্রামে তার থাবা বসাতে পারেনি সংগত কারণেই। তাই বিয়ের বা সুন্নতে খতনার সময় কেউ কেউ মাইক ভাড়া করে নিয়ে এলেও আগের আনুষ্ঠানিকতাগুলোর এভাবেই সারা হতো। গ্রামের আরও কিছু মহিলা দাদির সঙ্গে গোল হয়ে বসে দাদির কণ্ঠের সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে কোরাসে গীত পরিবেশন করতেন। গায়েহলুদের গোসলের সময় কলপাড়ে বসে, ক্ষীর খাওয়ানোর সময় তার পাশে বসে এই সব গীত পরিবেশন চলত। আর সেই সব আসরে দাদির সঙ্গে সঙ্গে আমার উপস্থিতি ছিল অবধারিত। কোনো গীতের কথা এখন আর মনে নেই। কিন্তু একটা বিষয় এখনো মনে আছে। সেটা হলো গীতের প্রত্যেকটা লাইনের শেষে বলা হতো—না রে কে।
দাদির কাছ থেকেই বোধ হয় অজানা অচেনা মানুষকে আপন করে নেওয়ার বিশেষ গুণটা আমি পেয়েছিলাম। তাই আর ভবিষ্যৎ জীবনে কখনো কোনো বাধার সম্মুখীন হতে হয়নি। একটা গল্প এখনো পরিষ্কার মনে আছে। আমি ফুপাতো ভাই আনোয়ারের সঙ্গে পাড়ার আরও কিছু দুষ্টু ছেলে মিলে আমরা বাড়ি থেকে বেশ কিছুটা দুরে খেলতে গেছি। হঠাৎ একটা লোক সাইকেল চালিয়ে এসে আমাদের জিজ্ঞেস করলেন, পরিবুর বাড়িটা কোন দিকে আমাকে বলতে পারবা। দাদির নাম শুনে আমি আর আনোয়ার লোকটার দিকে তাকিয়ে তাঁকে চেনার চেষ্টা করলাম। কিন্তু কোনোভাবেই মনে করতে পারলাম না এই লোককে এর আগে কোথাও দেখেছি কিনা। আমরা বললাম উনি আমাদের দাদি। শুনে ভদ্রলোক একেবারে ছেলেমানুষের মতো খুশি হয়ে আমাদের মাথায় হাত বুলিয়ে তাঁকে রাস্তা চিনিয়ে দিতে বললেন। আমরা খেলা ফেলে আসব না, কিন্তু দাদির ভাই তাই আবার আসতেই হচ্ছিল বলে আমরা রাস্তা দিয়ে না এসে খেতের মধ্যে দিয়েই সোজা বাড়ির দিকে হাঁটা শুরু করলাম। খেতের মধ্যে যেহেতু সাইকেল চালানো যায় না তাই ভদ্রলোক তার সাইকেলটা কাঁধে নিয়ে আমাদের অনুসরণ করে চললেন। বাড়ি এসে দাদিকে উনি সে কথা বলাতে, দাদি আমাদের অনেক বকুনি দিয়েছিলেন। কিন্তু ভদ্রলোক আমাদের সেযাত্রা বাঁচিয়ে দিয়েছিলেন। পরবর্তীতে তাঁকে আমরা দাদা বলেই ডাকতাম। দাদি একবার পাবনা বেড়াতে গিয়ে তাঁদের বাসায় ছিলেন। তখনই ওনার সঙ্গে ভাই পাতিয়ে এসেছিলেন। তারপর থেকেই উনি আমাদের পরিবারের অপরিহার্য একজন হয়ে উঠেছিলেন। আমিও কিছুটা বড় হওয়ার পর নিজের বোনের ফাঁকা জায়গাটা অসংখ্য বোন পাতিয়ে পূরণ করেছি।
দাদির ব্যক্তিত্বে সবচেয়ে লক্ষণীয় বিষয় ছিল তাঁর ভবিষ্যৎ দৃষ্টি। যেকোনো সিদ্ধান্ত একবার নিয়ে ফেললে সেখান থেকে তাকে টলানো অনেক কঠিন ব্যাপার ছিল। পদ্মা নদী যখন আমাদের বাড়িটাকে গ্রাস করে নিয়েছিল তখন সবাই আবার কিছুটা সরে গিয়ে চরের মধ্যেই বসতি স্থাপন করলেন। কিন্তু দাদি সেই বসতির পাশাপাশি শহরতলিতেও সাত কাঠা জায়গা কিনে ফেললেন। উনি তখনই বুঝেছিলেন, ভবিষ্যতে এই চরের নতুন জায়গাটাও আবার নদীগর্ভে চলে যেতে পারে। কারণ নদী প্রতিনিয়তই তার পথ পরিবর্তন করে। শহরতলির নতুন জায়গাটাতে আমাদের পাঠিয়ে দেওয়া হলো। আব্বা, মা, আমি আর মেজো। যাতে করে আমরা দুই ভাই ঠিকমতো পড়াশোনা করে মানুষের মতো মানুষ হতে পারি। পরবর্তীতে ছোট এসে আমাদের দল ভারী করে। দাদি যদি তার নিজস্ব বুদ্ধিতে এই জায়গাটুকু না কিনতেন, তাহলে আমাদের কখনোই শহরে আসা হতো না বা ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার হতে হতো না। তাই আজ আমাদের সকল অর্জনের অছিলায় দাদিকে মনে পড়ে যায়।
ছোটবেলায় আমার একবার এমন একটা ভয়ংকর অসুখ হলো যে যমে মানুষে টানাটানি শুরু হয়ে গেল। একদিকে যমদূত অন্যদিকে আমার দাদি কেউ কাউকে ছাড় দিতে নারাজ। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমার দাদিই জয়লাভ করেছিলেন বলেই আজ আমি এই লেখাটা লিখতে পারছি। তখনো অমন কঠিন অসুখের নাম শুনিনি আমি। তলপেটের দিকে লিভার বলে নাকি একটা বস্তু আছে। আমার লিভার বড় হয়ে গিয়েছিল। বাড়িতেই বড় ফুপা ও মেজো চাচা ডাক্তার। কিন্তু তারা শনাক্ত করতে পারলেন না। পরে কুষ্টিয়াতে এসে একগাদা টেস্ট করার পর বোঝা গেল আমার লিভার নামক বস্তুটি বড় হয়ে গেছে। ডাক্তারের পাশাপাশি দাদি সম্ভব সব রকমের কবিরাজি চিকিৎসাও চালিয়ে গেলেন। এমনকি তাবিজ কবচ পর্যন্তও বাদ থাকল না। একদিন খুব ভোরে একটা কাঁসার গ্লাসে একটা তরল পদার্থ নিয়ে এসে আমাকে বললেন, ভাই আমার এটা খেয়ে ফেল। আমি গ্লাসটা মুখের কাছে নিয়েই গন্ধ শুকে বুঝে ফেললাম বস্তুটি কি হতে পারে। কিন্তু দাদি বলছেন এটা নিয়েরের (শিশিরের) পানি। দাদির পীড়াপীড়িতে নাক বন্ধ রেখে বস্তুটি খেয়ে ফেললাম। বস্তুটি ছিল গরুর চুনা। কোনো এক কবিরাজ দাদিকে বলেছিলেন, সকালবেলা খালি পেটে কালো গরুর চুনা খেতে পারলে রোগটা সেরে যাবে। তাই এই ব্যবস্থা। এই রোগের উপসর্গ ছিল সারাক্ষণ তলপেটে ব্যথা করত। শরীরের পেছনের দিক সামনের দিকের তুলনায় উঁচু করে উপুড় হয়ে শুয়ে থাকলে কিছুটা উপশম হতো। আর কোনো কিছু নিয়ে ব্যস্ত থাকলেও ব্যথার কথাটা ভুলে যেতাম। তাই দাদি আমাকে কোলে নিয়ে সারা পাড়াময় ঘুরে বেড়াতেন। যাতে করে আমি ব্যথা ভুলে থাকি। এমন স্নেহের কাছে যমদূত পরাজিত না হয়ে পারেই না।
নদী ভাঙন শুরু হয়েছে। নদী একে একে সব গ্রাস করে নিচ্ছে। আবাদি জমি থেকে শুরু করে মানুষের বাড়িঘর কিছুই বাদ যাচ্ছে না। একদিন বিকেলে হাতের সব কাজ শেষ করে দাদি মেজোকে কোলে নিয়ে আমাকে বলল চল নদী দেখে আসি। আমি দাদির শাড়ির আঁচল ধরে পেছনে পেছনে চললাম। নদীর পাড়ে হিমেল বাতাস বয়ে যাচ্ছে। নদীর পাড় সামান্যই উঁচু। নদীভাঙন চলছে একেবারে উৎসব করে। মনের হচ্ছে যেন নদীর মনে অনেক অভিমান জমা হয়েছিল। তাই পাড়ের মাটিগুলো অশ্রু হয়ে খসে খসে পড়ছে। আমি একেবারে পাড়ে গিয়ে দাঁড়াচ্ছি দেখার জন্য কীভাবে পানি এই অসাধ্যসাধন করছে। দাদি বারবারই সাবধান করে দিচ্ছেন। প্রথমে নদীর পাড়ে একটা ফাটল সৃষ্টি হচ্ছে তারপর সেই ফাটল বরাবর মাটির চাইটা একেবারে দুরন্ত কিশোরের ভঙ্গিতে ডিগবাজি দিয়ে নদীতে আছড়ে পড়ছে। এ যেন এক মহা আনন্দের খেলা। একসময় নদীর সঙ্গে বাংলাদেশের মানুষের জীবন ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে ছিল। নদীই মানুষের ভাগ্য নির্ধারণ করে দিত, যেভাবে আমাদেরও ভাগ্য নির্ধারণ করে দিয়েছিল।
একদিন লতিফের ক্যানালে নৌকা বাইচ হচ্ছে। বাড়ির উঠোন থেকেই মাইকে সেই শব্দ শোনা যাচ্ছে। একই সঙ্গে তারস্বরে বেজে চলেছে বিভিন্ন ধরনের বাদ্যযন্ত্র। দাদি বললেন, চল নৌকা বাইচ দেখে আসি। আমি বললাম চলো। আমিতো আসলে মনে মনে সেটাই চাইছিলাম। লতিফের ক্যানালে যেতে হলে মাঝে আরও দুটো পাড়া পড়ে। আমরা যত দ্রুত সম্ভব হেঁটে লতিফের খালে পৌঁছে দেখি বাইচ শুরু হয়ে গেছে। ক্যানালের দুই পাড় লোকে লোকারণ্য, তিল ধারণের জায়গা নেই। ক্যানালে কত রকমের যে নৌকা ও কী সুন্দর বাহারি সাজে তারা সেজেছে। আর নৌকার কিনার ধরে বসে আছে মানুষ তাদের হাতে রঙিন ছোট ছোট বইঠা। নৌকার মাঝে একজন বা দুজন দাঁড়িয়ে তারস্বরে বিভিন্ন শ্লোক বলে মল্লারদের উৎসাহ দিয়ে যাচ্ছে। নৌকার আকারের ওপর নির্ভর করে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা হয়েছে প্রতিযোগিতাটাকে। একে একে বিভিন্ন ধাপ পেড়িয়ে ফাইনালে পুরস্কার হিসেবে দেওয়া হলো তিন ব্যান্ডের রেডিও, সাইকেল আর অন্য পুরস্কারটার কথা আজ আর মনে পড়ছে না।
গোয়ালদের পাড়ায় এসেছে পদ্মপুরাণ গানের দল। থাকবে এক সপ্তাহ। এই এক সপ্তাহজুড়ে তারা বিভিন্ন রকমের পালা পরিবেশন করবে। দাদিই আবার আমার বাহন। চলে গেলাম দাদির হাত ধরে। সবাই সাদা ধুতি আর কুর্তা পরে কী সুন্দর করেই না সেজেছেন আর তাদের প্রত্যেকের কণ্ঠেই কী জাদুমাখা গান। ওই দিন চলছিল বেহুলা লখিন্দরের পালা। একটা সাদা পর্দায় ঘেরা ঘরকে লখিন্দরের লোহার বাসর ঘর বানিয়ে অভিনয় চলছে আর তার সঙ্গে চলছে প্রত্যেকের কণ্ঠেই যার যার চরিত্র অনুযায়ী বর্ণনা। একটা লাইন এখনো আমার মনে গেঁথে আছে। ‘কোনো সাপে দংশীল লখাই রে, ও বিধি কি হইলো’। কীভাবে যে সারাটা দিন চলে যেত পালা দেখতে দেখতে। আহা দিনগুলো আরও বড় হলে ভালো হতো, আমার মনে শুধু এমন চিন্তাই খেলা করত।
ছোটবেলায় দাদির গলা জড়িয়ে ধরে কেচ্ছা (গল্প) শোনার নিয়মিত অভ্যাস ছিল একটা বয়স পর্যন্ত। তারপর যখন আমরা পুরোপুরিভাবে শহরতলিতে চলে আসলাম তখন আর অভ্যাসটা আর থাকল না। কারণ দাদি আমার আরও দুই চাচা ও দুই ফুপুর সঙ্গে চর ভবানীপুরের থেকে গেলেন। আর দাদির জীবনটাও আসলে একটা কেচ্ছায় ছিল। কম বয়সে স্বামী হারিয়ে পাঁচজন ছেলেমেয়েকে বড় করে তোলা থেকে শুরু করে নাতি নাতনিদের ভবিষ্যৎ ভাবনাও তাঁর মাথায় খেলা করত। আমাদের তিন ভাইয়ের নাম রেখেছিলেন আমাদের দাদি। আমি আমার নাম বা গায়ের রং নিয়ে অনেক কটুকথা শুনেছি শহরতলিতে আসার পর। কিন্তু গ্রামে থাকতে কেউ সেটা নিয়ে কখনোই কথা বলার সাহস করেনি শুধুমাত্র দাদির কারণে। এমনকি শহরতলির বাচ্চাকাচ্চার যখন কারণে অকারণে আমাদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করত, তখন একদিন দাদি বললেন তোরা আমার নাতি তোরা কেন মানুষের দুর্ব্যবহার সহ্য করবি। তারপরই আমাদের ব্যক্তিত্বে আমূল পরিবর্তন চলে এসেছিল।
এই জলজ্যান্ত মানুষটা গত ১০ জুন বাংলাদেশ সময় বিকেল ৪টা ১০ মিনিটে ইহলোক ত্যাগ করেছেন। এরপর থেকে আমি এক অদ্ভুত সময় পার করছি। এমন না যে তাঁর সঙ্গে এই সাত সমুদ্র তেরো নদীর পাড় থেকে প্রতিদিনই কথা হতো। কিন্তু তবুও একটা শূন্যতা সারা মনপ্রাণ জুড়ে। আমি এখনো আগের মতোই চলাফেরা করছি কিন্তু কোথায় যেন সুর কেটে গেছে। দাদি মারা যাওয়ার খবরটা আমি খুব স্বাভাবিকভাবেই নিয়েছি দেখে আমার গিন্নিও অবাক হয়েছেন। কিন্তু তাকে তো আর আমার মনের ভেতরের অবস্থাটা দেখতে পারছি না। তাঁর মৃত্যু সংবাদটা যখন পেলাম তখন আমি একটা কাজে লাকেম্বা গিয়েছি। ইমোতে ফোন দিয়ে ফুপাতো ভাই দাদির নিষ্প্রাণ মুখটা দেখাচ্ছিল। দেখে আমি ক্ষণিকের জন্য হলেও থমকে গেলাম। কিন্তু জীবন চলে যাবে তার নিজের নিয়মেই। বাসায় ফেরার উদ্দেশে গাড়িতে উঠে স্টার্ট দিতেই সিডি প্লেয়ারটা বেজে উঠল। গাড়ির স্টার্ট বন্ধ করার সময় আর আলাদা করে সিডি প্লেয়ারটা বন্ধ করা হয়নি। সিডিতে বাংলা ব্যান্ডের আনুশেহ দরাজ গলায় গেয়ে চলেছেন:
‘মরিলে কান্দিস না আমার দায়।
রে জাদু ধন মরিলে কান্দিস না আমার দায়
মরিলে কান্দিস না আমার দায়’
মো. ইয়াকুব আলী: সিডনি, অস্ট্রেলিয়া। ইমেইল: <[email protected]>