পরবাসে বেদনা ও বিষণ্নতার বাসন্তী ঈদ
ঈদ মানে আনন্দ, ঈদ মানে খুশি। বছরে দুটি ঈদ। ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহা। আমরা যাঁরা ইসলামধর্মে বিশ্বাসী, আমাদের কাছে ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় উৎসব হিসেবে পরিগণিত হয়। তাই ঈদকে ঘিরে আমাদের মধ্যে আনন্দ কিংবা উদ্দীপনার কোনো সীমা থাকে না।
তবে এবারের ঈদকে ঘিরে আমার মধ্যে তেমন একটা উত্তেজনা ছিল না বললেই চলে। প্রথমত প্রবাসজীবনে ঈদের আনন্দ, তাই অনেকটা বিবর্ণ ও ফ্যাকাশে। সত্যি কথা বলতে গেলে, প্রবাসজীবন হচ্ছে এমন এক জীবন, যে জীবনে প্রাপ্তির ক্ষেত্র খুবই সীমিত। নিদারুণ ব্যথা ও বেদনাকে বুকে চাপা দিয়ে প্রবাসীরা দিনরাত তাঁদের প্রিয়জনের মুখে হাসি ফোটাতে নিরলস পরিশ্রম করে যান। আমাদের দেশের অর্থনীতি মোটাদাগে প্রবাসী আয়ের ওপর ভিত্তি করে দাঁড়িয়ে আছে।
বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া থেকে শুরু করে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে ঈদ উপলক্ষে রাষ্ট্রীয়ভাবে ছুটি থাকে। তুরস্ক, বসনিয়া অ্যান্ড হার্জেগোভিনা, মেসেডোনিয়া, আলবেনিয়া, কসভো ছাড়া ইউরোপের অন্য কোনো দেশে ঈদ উপলক্ষে কোনো ধরনের ছুটি থাকে না। তাই ইউরোপের বেশির ভাগ দেশে ঈদের দিন অতিবাহিত হয় অত্যন্ত সাদামাটাভাবে আট–দশটা দিনের মতো। কর্মব্যস্ত মানুষের অনেকে এদিনও কাজে যোগ দেন। আমরা যাঁরা শিক্ষার্থী, ক্লাস কিংবা পরীক্ষায় অংশ নিতে হয় আমাদের। ঈদের নামাজ পড়ার সৌভাগ্য অনেকের হয় না।
আর ইউরোপের অন্যান্য দেশের তুলনায় স্লোভেনিয়ার অবস্থা একেবারে ভিন্ন। মধ্য ইউরোপের এ দেশে বাংলাদেশিদের পদাচারণ সেভাবে দেখা যায় না। যুক্তরাজ্য, ইতালি, স্পেন, ফ্রান্স, অস্ট্রিয়া, জার্মানি, পর্তুগাল কিংবা গ্রিসে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক বাংলাদেশিদের বসবাস রয়েছে। এসব দেশে বসবাসরত বাংলাদেশিরা বিভিন্ন কমিউনিটি কিংবা সংগঠনের মাধ্যমে পরস্পরের সঙ্গে সংযুক্ত। স্লোভেনিয়াতে বাংলাদেশিদের কোনো সুসংগঠিত কমিউনিটি নেই, তাই এখানে যেসব বাংলাদেশি রয়েছেন তাঁদের মধ্যে আন্তঃসম্পর্কের ক্ষেত্রটি এখনো প্রসারিত নয়। গত বছরগুলোতে ঈদের দিন অনেকটা একাকিত্বের মধ্য দিয়ে কেটেছে।
জীবনে অনেক খারাপ সময় এসেছে, তবে এখনকার মতো দুঃসময় এর আগে কখনো আসেনি। ইউরোপে এখন বসন্তকাল। ইউরোপে বসন্ত যেন সত্যিই অসাধারণ, ব্যাকরণের কোনো উপমা দিয়ে তার সৌন্দর্য বলে বোঝানো যাবে না। কয়েক দিন আগেও রাস্তার ধারে নির্জীব আর প্রাণহীন যেসব গাছ পড়ে ছিল, এপ্রিল আসতে না আসতে একেবারে অবিশ্বাস্যভাবে গাছগুলো ভরে উঠেছে সবুজ কচিপাতায়।
কেউ বিশ্বাস করবে না, কয়েক দিন আগেই প্রকৃতির প্রাণের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া ছিল দুষ্কর; এপ্রিলে প্রকৃতি যেন একেবারে নতুন প্রাণ ফিরে পেয়েছে। চারদিকে পাখির কলতান, মৌমাছি যেন ছুটে চলেছে আপনগতিতে ফুল থেকে পুষ্পরস সংগ্রহ করতে। রোদেলা ভোরের বাতাস সত্যি মৃদুমন্দ, এক চিলতে বসন্তের রোদ যেন পৃথিবীর সবচেয়ে দুর্লভ হিরার টুকরোর থেকেও দামি। প্রকৃতিতে বসন্তের আগমনের সঙ্গে সঙ্গে আমার জীবনেও বসন্ত নেমে আসে। অন্তত ২০১৮ সাল থেকে এমনটি হয়ে আসছে। ইউরোপের মাটিতে পা রাখার পর আমার যত অর্জন, তার বেশির ভাগ এসেছে এই একটি ঋতুতে।
২০১৮ সালে আমি প্রথমবারের মতো ইউরোপ ভ্রমণে বের হই। আলবেনিয়া, রোমানিয়া ও বুলগেরিয়া—তিনটি দেশে ভ্রমণের মধ্য দিয়ে আমার ইউরোপ ট্যুর শুরু হয়েছিল। আলবেনিয়া ও বুলগেরিয়া বলকান উপদ্বীপের অন্তর্গত, রোমানিয়ার কিছুটা অংশও বলকান পেনিনসুলার মধ্যে পড়েছে। এখন পর্যন্ত যে কয়েকটি দেশের মাটিতে পা রাখার সুযোগ হয়েছে তার মধ্যে রোমানিয়ার অভিজ্ঞতা ছিল অন্য রকম। রোমানিয়ার কথা মনে পড়লে আমার স্মৃতিপটে মাইকেল মধুসূদন দত্তের বিখ্যাত কবিতা কপোতাক্ষ নদের দুটি চরণের কথা মনে পড়ে—
‘বহুদেশ দেখিয়াছি বহু নদ-দলে,
কিন্তু এ স্নেহের তৃষ্ণা মিটে কার জলে,’
আমার চোখে রোমানিয়া হলো অনিন্দ্য সুন্দরের এক প্রতিশব্দ। কেউ যদি আমাকে আমার নিজ মাতৃভূমির পর অন্য একটি দেশকে নির্বাচন করতে বলে, তাহলে আমি চোখ বন্ধ করে নির্দ্বিধায় রোমানিয়াকে বেছে নেব। বুখারেস্ট সফরে আমার সঙ্গে ক্রিস্টিনা নামক এক তরুণীর পরিচয় হয়েছিল। পেশায় মোটরবাইক রেসার। বয়সে ক্রিস্টিনা আমার চেয়ে ১০ বছরের বড়, তবে আমার জীবনে ক্রিস্টিনার ভূমিকা স্মরণ করার মতো। ক্রিস্টিনা আমার জীবনে নতুন দর্শন দান করেছে। আমি অবচেতন মনে সব সময় ক্রিস্টিনাকে স্বপ্নে দেখি। ক্রিস্টিনা আমার জীবনের হৈমন্তী, ক্ষণিকের জন্য তিনি আমার জীবনে এসেছিলেন। তবে তাঁর রেশ আমার মধ্যে সারা জীবন থাকবে।
বসন্তের কোনো এক দিনে ক্রিস্টিনার সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয়েছিল। শুধু রোমানিয়া ও বুলগেরিয়া নয়; ওই বছরের বসন্তে প্রাগ, মিউনিখ ও ভেনিস—তিনটি স্থান ঘুরে দেখার সুযোগ পেয়েছিলাম। মিউনিখ থেকে ফেরার পথে নিকোলে ক্যাসেরোভা নামক এক চেক তরুণীর সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল। মিউনিখের সেন্ট্রাল বাস স্টেশনে আমাদের প্রথম দেখা, বর্তমানে সে লুক্সেমবার্গে বসবাস করে। ইউনিভার্সিটি অব লুক্সেমবার্গ থেকে সে আইন বিষয়ে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করছে। আমার জীবনে নিকোলের অবদান স্মরণ করার মতো, বিভিন্ন দুঃসময়ে নিকোলে আমার পাশে থেকেছে। আমাকে অনুপ্রেরণা দিয়েছে। ২০১৯ সালে ইরাসমাস এক্সচেঞ্জ স্টাডি প্রোগ্রামের আওতায় এক সেমিস্টারের জন্য তুরস্কের কুতাহইয়া ডুমলুপিনার ইউনিভার্সিটিতে অধ্যয়নের সুযোগ আছে। সব মিলিয়ে প্রায় পাঁচ মাসের মতো তুরস্কে থাকার সৌভাগ্য হয়েছিল। তুরস্কের অভিজ্ঞতাও স্মরণে রাখার মতো। তুর্কিরা জাতি হিসেবে খুবই অতিথিপরায়ণ। ইস্তাম্বুল ও ট্রাবজোন—তুরস্কের এ দুই শহর ভ্রমণের মধ্য দিয়ে মনের মধ্যে এক অনাবিল প্রশান্তি জাগ্রত হয়েছিল। বিশেষ করে ট্রাবজোন ভ্রমণকালে ট্রাবজোন যাওয়ার পথে সামসুন থেকে শুরু করে অরদু, গিরেসুন ও রিজে পর্যন্ত পুরো অংশে এক অসাধারণ রূপে কৃষ্ণসাগর আমাদের সবার সামনে ধরা দেয়।
তুরস্কের অন্যান্য অংশের তুলনায় কৃষ্ণসাগরের তীরবর্তী অঞ্চলগুলো বেশি সবুজ। ইস্তাম্বুল ও ট্রাবজোন ভ্রমণ থেকে শুরু করে তুরস্কে থাকাকালে বেশির ভাগ সময় কেটেছে বসন্তের মধ্য দিয়ে। ২০১৯ সালের শেষের দিকে বিশ্বজুড়ে মহামারি করোনাভাইরাসের তাণ্ডব শুরু হয়। ২০২০ ও ২০২১–এর বেশির ভাগ সময় কেটেছে দুর্যোগের মধ্য দিয়ে। তবু বসন্ত আমাকে নিরাশ করেনি কখনো। ২০২০ সালে বসন্তের কোনো এক দিনে প্রথম লেখক হিসেবে নিজের আত্মপ্রকাশ ঘটে। বিধিনিষেধের সময় মানসিক অবসাদকে ভুলে থাকতে একটু একটু করে নিজের মনের ভাব লেখনীর মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলতে চেষ্টা করি। সেই থেকে লেখক হিসেবে যাত্রা শুরু। প্রথম আলো, ডেইলি স্টার, বিডিনিউজ টুয়েন্টিফোরের মতো গণমাধ্যমগুলোতে আমার লেখা প্রকাশিত হতে থাকে। লেখক হিসেবে প্রথম অর্জন আসে পরের বছর, অর্থাৎ ২০২১–এর বসন্তে। করোনাভাইরাসের বিস্তারের কারণে প্রায় এক বছরের বেশি সময় আমাদের ইউনিভার্সিটি বন্ধ ছিল। প্রায় পুরো সময়ে আমাদের শিক্ষা কার্যক্রম অনলাইন প্ল্যাটফর্মে পরিচালিত হয়। তাই গত বছরের দুই ঈদ পরিবারের সঙ্গে কাটানোর সৌভাগ্য হয়েছিল। গত বসন্তও কেটেছে পরিবারের সঙ্গে। ইউরোপের বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ে বছরে দুটি সেমিস্টার। একটি শরতকালের সেমিস্টার, যেটি শুরু হয় সেপ্টেম্বর কিংবা অক্টোবরে। অন্যটি হচ্ছে বসন্তকালের সেমিস্টার, যেটি শুরু হয় ফেব্রুয়ারি মাসে। শরতকালের সেমিস্টারের তুলনায় বসন্তকালের সেমিস্টারে আমার একাডেমিক ফল সব সময় ভালো থাকে।
ইংরেজিতে একটি প্রবচন রয়েছে—History repeats itself. অর্থাৎ ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটে। গত বছরগুলোর মতো এবার তাই বসন্তকে ঘিরে আমার মধ্যে আশার আলো সঞ্চার হয়েছিল। পারিপার্শ্বিকতাও সেদিকে ইঙ্গিত করছিল। কয়েক মাস ধরে চরম হতাশার মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে বিভিন্ন কারণে একাধিকবার বাগ্বিতণ্ডায় জড়িয়েছি। এবারের শরতকালের সেমিস্টারে আমার একাডেমিক ফলাফল ছিল একেবারে ভয়াবহ। এক সময় হাল ছেড়ে দিয়েছিলাম, ফিজিকসের ওপর থেকে পুরোপুরি আগ্রহ হারিয়ে গিয়েছিল। আমার জীবনে প্রেম এসেছে ঠিকই, কিন্তু কখনো সফলতার মুখ দেখেনি। এখন পর্যন্ত অনেক মেয়েকে সরাসরি ভালো লাগার কথা জানিয়েছি, কিন্তু সবার কাছ থেকে নেতিবাচক উত্তর এসেছে। ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে বাদু নামের একটি ডেটিং অ্যাপের কল্যাণে আমার সঙ্গে আলেনার পরিচয়।
আলেনার জন্ম রাশিয়ার রাজধানী মস্কোতে। বর্তমানে সে স্লোভাকিয়ার রাজধানী ব্রাতিস্লাভাতে বসবাস করছে। বয়সে আমার চেয়ে আলেনা ছয় বছরের ছোট। রাশিয়াকে ঘিরে পশ্চিমা দুনিয়ার মানুষের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের নেতিবাচক ধারণার প্রচলন রয়েছে। অনেক সময় পশ্চিমের গণমাধ্যমগুলো রাশিয়াকেন্দ্রিক প্রপাগান্ডার জন্ম দেয়। বাস্তবে রাশিয়ানরা জাতি হিসেবে অনেক স্মার্ট ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন। পুতিন একজন স্বৈরাচারী শাসক, বিরোধী মতকে তিনি সহ্য করতে পারেন না। এ বিষয়ে কোনো দ্বিমত নেই, তবে জিওপলিটিক্যাল ইস্যুতে তিনি খুবই কূটবুদ্ধিসম্পন্ন। যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো ইউক্রেনে আগ্রাসনের জেরে রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে, কিন্তু পুতিন বিচক্ষণতার সঙ্গে সে নিষেধাজ্ঞার প্রভাব অল্প সময়ে কাটিয়ে উঠেছেন। মার্কিন ডলারের বিপরীতে রাশিয়ান রুবলকে শক্তিশালী করতে সমর্থ হয়েছেন। ইউরোপের দেশগুলো জ্বালানি থেকে শুরু করে বিভিন্ন ক্ষেত্রে রাশিয়ার ওপর নির্ভরশীল। তাই রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা যত দীর্ঘমেয়াদি হবে ইউরোপের দেশগুলোকে তত বেশি অস্বস্তিকর অবস্থার মধ্য দিয়ে যেতে হবে। ইউরোপের রাজনীতিবিদেরা এখন বিষয়টি হারে হারে টের পাচ্ছেন।
তুরস্ক, গ্রেট ব্রিটেন, জার্মানি থেকে শুরু করে অনেক সাম্রাজ্যবাদী শক্তি রাশিয়া দখলের চেষ্টা করেছে। কিন্তু সবাইকে শেষ পর্যন্ত ব্যর্থতার ছাপ নিয়ে রাশিয়া ত্যাগ করতে হয়েছে। রোনাল্ড রিগানের চতুরতার কাছে গর্বাচেভ পরাজিত হয়েছেন, সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে গেছে। কিন্তু এত অল্প সময়ে রাশিয়া আবার অপ্রতিরোধ্য শক্তি হিসেবে ফিরে আসবে, সেটা হয়তো কারও কল্পনায় ছিল না। রাশিয়াকে তাই তাচ্ছিল্য দৃষ্টিতে দেখার কোনো সুযোগ নেই।
রাশিয়ানরা গণিত ও কম্পিউটার প্রোগ্রামিংয়ে খুবই দক্ষ। আলেনার বয়স ১৯ হলেও জ্ঞান-গরিমা ও বিচক্ষণতায় সে ৩০ বছরের একজন মানুষকে অনায়াসে চ্যালেঞ্জ জানাতে পারে।
ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে আলেনার সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল। এরপর আমরা একে অন্যের কাছাকাছি আসতে শুরু করি। ২৬ মার্চে মহান স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে ভিয়েনাস্থ বাংলাদেশ দূতাবাস আয়োজিত প্রোগ্রামে আমার সঙ্গে আলেনাও এসেছিল। আলেনাকে সঙ্গে নিয়ে শ্রণব্রুন প্যালেসে ঘুরতে গিয়েছিলাম। এবারের ঈদে একসঙ্গে বসনিয়া ভ্রমণের পরিকল্পনা সাজিয়েছিলাম। প্রেম-ভালোবাসা কিংবা বয়ফ্রেন্ড-গার্লফ্রেন্ড অথবা স্বামী-স্ত্রীর মতো সম্পর্কগুলো অত্যন্ত পবিত্র। প্রেমে পড়লে মানুষের ব্যক্তিত্বের পুনর্জাগরণ ঘটে, মানুষ নিজেকে নতুন করে গড়তে শেখে। মানুষের মধ্যে আশ্চর্য রকমের পরিবর্তন আসে। যেমন আপনার মা–বাবা আপনাকে শত চেষ্টা করেও সিগারেট কিংবা অ্যালকোহলের নেশা থেকে মুক্ত করতে পারবে না, কিন্তু আপনার গার্লফ্রেন্ড চোখের পলকে সেটা পারবে। আবার কোনো কাজে আপনার মনোযোগ নেই, আপনার গার্লফ্রেন্ডের মোটিভেশনে চোখের পলকে আপনি দেখবেন ওই কাজে আপনার আগ্রহ ফিরে এসেছে। আলেনার সাহচর্যে নতুন উদ্যমে আবার পড়াশোনা শুরু করি। যার ফলাফলও এসেছে এরই মধ্যে। এখন আর ফিজিকসকে ভয় করি না। কয়েকটি সাবজেক্টে এরই মধ্যে পরীক্ষা দিয়ে পাস করতে সক্ষম হয়েছি।
আলেনার জন্য নিজেকে বেশ পরিবর্তন করেছি, তবে কয়েক দিন আগে আলেনা আমাকে হতাশ করেছে। বেশ কিছু কারণে আলেনা এ মুহূর্তে নতুন করে সম্পর্কে জড়ানোর সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসেছে। এ বছরের অক্টোবরে তার ইউনিভার্সিটি শুরু করার কথা ছিল, স্লোভেনিয়াতে অবস্থিত ইউনিভার্সিটি অব প্রিমোরস্কা থেকে সে অফার লেটার পেয়েছে এবং এই ইউনিভার্সিটিতে ভর্তির জন্য সে প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছিল। এ সিদ্ধান্ত থেকে হঠাৎ করে সে সরে এসেছে। আপাতত সে সবার থেকে আলাদা হয়ে তাঁর এক বান্ধবীকে নিয়ে বিশ্ব ভ্রমণের পথে পা বাড়ানোর জন্য মনস্থির করেছে। আগামী এক বছর সে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশ ঘুরে দেখতে চায়, এসব দেশের মাটি ও মানুষকে কাছ থেকে জানতে চায়।
আলেনার এ সিদ্ধান্তের কারণে আমি মানসিকভাবে আবারও ভেঙে পড়েছি। গত দুই রাত বিছানায় শুয়ে একা একা কেঁদেছি। আমার জীবনে আশার প্রদীপ হয়ে যার আবির্ভাব, আচমকা সে প্রদীপ নিভে যাবে, এটা মানতে পারিনি। এবারের ঈদে তাই একসঙ্গে বসনিয়া যাওয়া হলো না। যখন মন খারাপ থাকে, ক্রিস্টোফার নোলানের ব্যাটম্যান সিনেমা দেখার চেষ্টা করি। ব্যাটম্যান বিগিন্স, ডার্ক নাইট এবং দ্য ডার্ক নাইট রাইজেস—সিনেমা তিনটি আমার মনে সব সময় আলাদা অনুভূতির সৃষ্টি করে। ব্যাটম্যান আমার প্রিয় সুপারহিরো। যখন চরম হতাশায় ডুবে থাকি, তখন এ তিন সিনেমা থেকে অনুপ্রেরণা ও মোটিভেশন খোঁজার চেষ্টা করি। কোনো ধরনের সুপার পাওয়ার না থাকলেও ব্যাটম্যান কেবল তাঁর অদম্য অধ্যবসায় আর উদ্ভাবনী ক্ষমতার জোরে একজন সুপারহিরো। ক্রিস্টোফার নোলানের প্রতিটি সিনেমা অসাধারণ। ০নায়ক হিসেবে ক্রিশ্চিয়ান বেল এবং ডেনিয়েল ডে লুইস আমার সবচেয়ে প্রিয়। মেথড অ্যাক্টিংকে এ দুজন অন্য এক স্তরে উন্নীত করেছেন। আমি নিজের জন্মদিন কখনো উদ্যাপন করি না, কিন্তু এ দুই মহাতারকার জন্মদিন ঠিকই উদ্যাপন করা হয়। তাঁদের আমি এতটা ভালোবাসি।
গত কয়েক দিনে ব্যাটম্যান বিগিন্স, ডার্ক নাইট ও দ্য ডার্ক নাইট রাইজেস—সিনেমা তিনটি বেশ কয়েকবার দেখেছি হতাশা কাটিয়ে ওঠার জন্য। এখনো হতাশাকে পুরোপুরি কাটিয়ে উঠতে পারিনি। চেহারায় তাই এর ছাপ স্পষ্ট। ঈদকে ঘিরে তাই কোনো প্রত্যাশা ছিল না।
খ্রিষ্টানিটির পর স্লোভেনিয়াতে সবচেয়ে বেশি মানুষের ধর্ম ইসলাম। স্লোভেনিয়াতে বসবাসরত মুসলিম সম্প্রদায়ের বেশির ভাগ বসনিয়ান কিংবা আলবেনিয়ান বংশোদ্ভূত। যুগোস্লাভিয়া শাসনামলে বসনিয়া অ্যান্ড হার্জেগোভিনা, কসভো ও মেসেডোনিয়া থেকে অনেক মানুষ স্লোভেনিয়াতে পাড়ি জমিয়েছেন। তাঁদের অনেকে এ দেশটিতে স্থায়ী হয়েছেন। বলকানের অধিবাসীদের নিয়ে আমার মধ্যে নেতিবাচক ধারণা রয়েছে। এটা ঠিক যে বলকানের অধিবাসীরা বেশ অতিথিপরায়ণ এবং আমাদের মতো তাঁরা আবেগপ্রবণ। তবে তাঁদের মানসিকতার সঙ্গে আমাদের উপমহাদেশের সাধারণ মানুষের মানসিকতার মিল খুঁজে পাওয়া যায়, যেটা অনেক সময় বেশ বিরক্তিকর।
ভোর পাঁচটার দিকে মসজিদে ছুটে গেলাম। ইউরোপের দেশগুলোতে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সঙ্গে মিল রেখে ঈদ উদ্যাপন করা হয়। যদিও এটা সরকারের স্বীকৃত কোনো মসজিদ নয়, স্থানীয় মুসলিম অধিবাসীরা ফ্ল্যাট কিনে সেটাকে মসজিদ হিসেবে ব্যবহার করছেন। ফজরের নামাজ জামাতে আদায় করলাম। নামাজ শেষে ইমাম সাহেব সুরা তিলাওয়াত করলেন। এরপর বসনিয়ান ভাষায় সুরা ইয়াসিনের তরজমা সবাইকে পড়ে শোনালেন। আনুমানিক সাড়ে ছয়টার দিকে ঈদের জামাত শুরু হলো।
করোনা মহামারির কারণে দীর্ঘ দুই বছর ঈদুল ফিতরের নামাজ জামাতে আদায় করা সম্ভব হয়নি। তাই এবারের ঈদুল ফিতরের নামাজকে ঘিরে মুসল্লিদের মধ্যে আলাদা এক উদ্দীপনা লক্ষ করলাম। নামাজ শেষে ইমাম সাহেব বসনিয়ার ভাষায় খুতবা প্রদান করলেন। বসনিয়া অ্যান্ড হার্জেগোভিনা, আলবেনিয়া, কসভো, মেসেডোনিয়া, বুলগেরিয়া এসব দেশে ইসলামের আবির্ভাব ঘটেছে ওসমানী সাম্রাজ্যের হাত ধরে। তাই এসব দেশের মুসলমানরা শরিয়াতের পরিভাষাকে ইঙ্গিত করতে আরবির পরিবর্তে তুর্কি শব্দ ব্যবহার করেন। যেমন অপরের প্রতি ঈদের শুভেচ্ছা জানাতে আমরা ‘ঈদ মোবারক’ শব্দটি ব্যবহার করি। কিন্তু এসব দেশের মানুষ ঈদের শুভেচ্ছা জানাতে ‘ঈদ মোবারক’–এর পরিবর্তে ‘বায়রাম শেরিফ মোবারেক ওলসুন’ ব্যবহার করতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। তুরস্কের ভাষায় ঈদকে বায়রাম বলা হয়।
ঈদ উপলক্ষে ছোটদের ঈদ সালামি দেওয়াটা মনে হয় পৃথিবীর অনেক মুসলিম দেশে চালু আছে। বলকান দেশগুলোতে এ ধরনের সংস্কৃতিকে বলা হয় ‘বায়রাম বাংকা’, যার বাংলা অনুবাদ হচ্ছে ঈদ ব্যাংক। ছোটরা ঈদের দিন দল বেঁধে আশপাশের মুরব্বিদের সঙ্গে দেখা করতে গেলে তাঁরা নগদ অর্থের পাশাপাশি চকলেটসহ তাদের বিভিন্ন ধরনের উপহার দেন। বিনিময়ে শিশুরা বড়দের ডান হাতে চুমু দেয়। এ ছাড়া মসজিদ কমিটির পক্ষ থেকেও শিশুদের মধ্যে উপহারসামগ্রী বিতরণ করা হয়। এবার ঈদে সালামি পেয়েছি, নামাজ শেষে যখন বাইরে বের হই, একজন বয়স্ক মুসল্লি এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে কোলাকুলি করেন এবং আমার হাতে ২০ ইউরোর একটি নোট গুঁজে দেন। এ বয়সে সালামি নিতে বেশ লজ্জা লাগছিল, তাঁকে নোটটি ফেরত দিতে চেয়েছিলাম, কিন্তু তিনি সেটা ফেরত নেননি। এ ভদ্রলোককে আমি চিনি না, কোনো দিন এর আগে তাঁকে দেখিওনি। তারপরও তিনি আমাকে কৃতজ্ঞতার বাঁধনে আবদ্ধ করেছেন।
বাকলাভা ও চেভাপি ছাড়া দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপে ঈদকে কল্পনা করা যায় না। ঈদ উপলক্ষে মসজিদের পক্ষ থেকে মুসল্লিদের জন্য বাকলাভা পরিবেশন করা হয়েছিল। মধ্যপ্রাচ্যের এই ডেজার্ট আইটেমটি অটোম্যানদের হাত ধরে দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোতে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে। আর চেভাপি হচ্ছে একধরনের কাবাব আইটেম। নামাজ শেষে অন্য মুসল্লিদের সঙ্গে কোলাকুলি করলাম। বাসায় ফেরার পথে মুহাম্মার নামের এক ভদ্রলোকের সঙ্গে পরিচয় হলো। মুহাম্মারের আদি নিবাস বসনিয়ার বিহাচ শহরে। মুহাম্মার আমাকে নিয়ে কাছের একটি কফিবারে গেলেন। আমরা একসঙ্গে কফি পান করলাম, সেই সঙ্গে স্মৃতি হিসেবে ছবিও তুললাম।
মুহাম্মারের সঙ্গে আরও কয়েকজন মুসল্লি ছিল। কফির বিল দিতে গিয়ে দেখি আগেই মুহাম্মার সেটি পরিশোধ করে দিয়েছেন। লেখালেখির সুবাদে আমার সঙ্গে মোস্তাফিজুর রহমান নামের এক পুলিশ কর্মকর্তার পরিচয় হয়েছিল। শেষবার যখন বাংলাদেশে গিয়েছিলাম, তখন তিনি মিরপুরে তাঁর বাসায় আমাকে দাওয়াত দিয়েছিলেন। তাঁর আতিথেয়তা কোনোভাবে ভোলার নয়। আমাকে তিনি অত্যন্ত স্নেহ করেন, সব সময় তিনি আমার খোঁজ রাখেন এবং আমাকে অনুপ্রেরণা দেন। জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী মিশনে অংশ নিতে তিনি বসনিয়াতে এসেছিলেন, যুগোস্লাভিয়ার প্রতিটি দেশ তাঁর নখদর্পণে। মুহাম্মারকে তাঁর ছবি দেখালাম এবং তাঁর কথা বললাম। জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী মিশনে বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনী বসনিয়া ও কসভোতে বেশ কিছু গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের জন্ম দিয়েছিল। এই দুই দেশের সাধারণ মানুষ তাই এসব ইতিহাসের বদৌলতে আমাদের দেশকে সম্মানের সঙ্গে দেখেন। মুহাম্মারের কথায়ও এ বিষয় আরও একবার ফুটে উঠল।
বাংলা ভাষায় একটি প্রবাদ রয়েছে, দাঁত থাকতে মানুষ তাঁর দাঁতের মর্ম বোঝে না। বাস্তবজীবনে এ প্রবাদ বাক্যটিকে সবচেয়ে কাছ থেকে অনুধাবন করার সুযোগ পেয়েছি প্রবাসজীবনে পা রাখার পর। জীবন থেকে অনেক অনুভূতি কিংবা অনেক অভিজ্ঞতা আজ হারিয়ে গেছে। বছর ঘুরে তাই ঈদ আমাদের দুয়ারে কড়া নাড়লেও ব্যক্তিগতভাবে আমার জীবনে ঈদ খুব একটি আনন্দের কিংবা উদ্দীপনার বার্তা নিয়ে আবির্ভূত হয় না।
ঈদ উপলক্ষে এখন আর কেউ নতুন জামা কিনে দেয় না। দেশে থাকতে বাবার হাত ধরে ঈদের নামাজ পড়তে যেতাম। এখন সেসব অতীত। ঈদ উপলক্ষে মা আজও জর্দা, ফিরনি, লাচ্ছা সেমাই থেকে শুরু করে পোলাও, মুরগির রোস্ট, ঝাল গরুর মাংসসহ বিভিন্ন পদের রান্না করেন। কিন্তু তার ছেলে এসব খাবার আর চেখে দেখার সুযোগ পায় না। ঈদের দিন মা খাবারের টেবিলে বসে তাঁর কল্পনায় আজও আমাকে খুঁজে বেড়ান, তাই যখন তাঁর সঙ্গে কথা হয়, তাঁর মধ্যে একধরনের বেদনা খুঁজে পাই, যদিও সেটিকে তিনি সেভাবে প্রকাশ করেন না। ছোট বোন ও নানি থেকে শুরু করে বন্ধুবান্ধব ও আত্মীয়স্বজনের কথা এদিন ভীষণভাবে মনে পড়ে। অতীতের ওই সব দিন আর ফিরে আসবে না, শুধু স্মৃতি হিসেবে থেকে যাবে আমার মস্তিষ্কে। দূর প্রবাসে ঈদের আনন্দ প্রস্ফুটিত হয় না ঠিকই, তারপরও চেষ্টা করি একেবারে আশাহত না হতে।
লেখক: রাকিব হাসান রাফি, শিক্ষার্থী, ইউনিভার্সিটি অব নোভা গোরিছা, স্লোভেনিয়া