নেস নদীর রঙিন আলোতে ছুটে যেতে চাই
একমাত্র ছেলে আর স্ত্রীকে নিয়ে নৈসর্গিক সৌন্দর্যের দেশ স্কটল্যান্ডে বেড়াতে যাই গত বছরের ৮ অগাস্ট বাই রোডে! ছয় দিনের এই হলিডে ছিল প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর! যদিও সলিহুল, ইংল্যান্ড থেকে ৪০০-৫০০ মাইল গাড়ি করে গিয়েছি কিন্তু মায়াবী স্কটল্যান্ডের সৌন্দর্যের কাছে লং ড্রাইভ করার ক্লান্তি ছিল নস্যি! অশেষ সৌন্দর্যের লীলাভূমি স্কটল্যান্ড আমাকে দিয়েছিল ডাক, কে পারত আমাকে সেই মায়াবী ডাক থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে?
স্কটল্যান্ড অনেক বড় একটি দেশ, কয়েক দিন ঘুরে সবকিছু দেখা সম্ভব নয়! তাই ডিসিশন নিলাম ভেঙে ভেঙে ট্রিপ কমপ্লিট করব! প্রথম রাত কাটালাম স্কটল্যান্ডের রাজধানী এডিনবরায়! যদিও প্রথম দিন অনেক বৃষ্টি ছিল কিন্তু বাপ-ছেলেকে কি বৃষ্টি আটকাতে পারবে? ছাতা নিয়ে ছুটে গেলাম এডিনবরা ক্যাসেল দেখতে! টিপটিপ বৃষ্টি পড়ছে। আমি ছেলেকে নিয়ে বৃষ্টির মধ্যে ঘুরছি আর এডিনবরা সিটি আবিষ্কার করছি! ছেলে আমার খুবই এক্সসাইটেড আর তার প্রশ্নবাণে আমি জর্জরিত! তবু বাপ–ছেলে খুবই খুশি!
দিনের শেষের দিকে আমরা রওনা দিলাম ইনভার্নেসের উদ্দেশে! এডিনবরা থেকে সাড়ে তিন ঘণ্টার ড্রাইভ পাহাড়ি আঁকাবাঁকা পথে! সন্ধ্যার দিকে আমরা নেস নদীর পারের স্কটিশ হাইল্যান্ডসের রাজধানী ইনভার্নেস শহরে পৌঁছালাম! রাতে বাংলাদেশি রেস্টুরেন্ট খুঁজে বের করে ডিনার করতে গেলাম! পাক্কা দুই দিন পরে ভাত খেলাম, আমার মাথা চক্কর দেওয়া বন্ধ হলো! ডিনার শেষে রাতের ইনভার্নেস শহর দেখতে গেলাম নেস নদীর তীরে! আলো আর আঁধারের মাঝে রঙিন নেস নদীর সৌন্দর্য বর্ণনা করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়! নেস নদী যেন তার রঙিন আলোয় আমাকে তার অনেক কাছে ডাকছে আর আমি যেন তার সেই মায়াবী ডাকে পাগলের মতো ছুটে যেতে চাই প্রতিনিয়ত!
পরদিন অনেক রৌদ্রোজ্জ্বল ছিল! আমরা সকালে বের হয়ে প্রথমে নেসের কাছে গেলাম, তার সৌন্দর্য উপভোগ করলাম! পরে আমরা পাহাড়ি আঁকাবাঁকা পথে ফোর্ট উইলিয়ামের দিকে যাত্রা শুরু করলাম বেন নেভিসে ইউকের সর্বোচ্চ মাউন্টেনে ক্লাইম্ব করার জন্য! পথে গাড়ি থামালাম একটি ট্যুরিস্ট স্পট দেখে, ছেলে আমার পাগল হয়ে গেল কাছের পাহাড়ের ওপরে ওঠার জন্য! তা–ই করলাম, ছেলে খুশি তো বাপ খুশি! বেন নেভিস পৌঁছার পরে কেব্ল কারের টিকিট করলাম পাহাড়ের চূড়ায় ওঠার জন্য! আমাদের ভাগ্য অনেক সুপ্রসন্ন ছিল, তাই ওপরে গিয়ে খুবই সুন্দর রৌদ্রোজ্জ্বল দিন পেলাম! ওপর থেকে যে দৃশ্য দেখা যায়, তা যে এককথায় অতুলনীয়! নীল আকাশ, সাদা মেঘ আর সবুজ পাহাড়ের এমন এক সৌন্দর্য নিয়ে প্রকৃতি বসে আছে, যা না দেখলে এই জীবন হয়তো বৃথাই থেকে যেত! আমি অবাক চিত্তে মুগ্ধ হয়ে প্রকৃতির সেই সৌন্দর্য দেখতে থাকলাম আর প্রিয় মানুষটিকে মনে মনে অনুভব করতে থাকলাম! বেন নেভিস মাউন্টেনে ওঠা এটাই প্রথম! চার বছর আগে আমার অভিভাবকেরা যখন ইউকেতে বেড়াতে এসেছিলেন, তখন তাঁদের নিয়ে গিয়েছিলাম কিন্তু টেকনিক্যাল ফল্টের কারণে ওই দিন তারা কেব্ল কার অপারেট করেনি! যার ফলে মনে আফসোস ছিল যে বেন নেভিসে ওঠা আর হলো না! এবার সেই আফসোস আর থাকল না!
পরদিন সকালে নাশতা করে রোগি ফলস দেখে আমরা এবারডিনের উদ্দেশে রওনা হলাম! রোগি ফলস দেখে মনে মনে বললাম, ‘পাহাড়ি ঝরনা তুমি তো জানো না আমিও যে তার মনে ছুটে চলি!’ এবারডিন পৌঁছাতে পৌঁছাতে সন্ধ্যা হয়ে গেল! পরদিন সাগরের পাড়ে বন্ধু রুমানার ফ্যামিলির সঙ্গে সাক্ষাৎ হলো! তারা আমাদের লাঞ্চ করাল, মনে হলো, তাদের আমরা অনেক দিন থেকে চিনি, এই প্রথম মিটিং নয়! বন্ধুত্বের ভালোবাসায় রং ছিটানোর পর আমরা গেলাম ডোনটোর ক্যাসেল দেখতে। সাগরের পাড়ে সেই ক্যাসেলের সৌন্দর্যকে হার মানানো সহজ নয়! আমি আবার মুগ্ধ চিত্তে ক্যাসেলের পার থেকে সাগরের দিকে তাকিয়ে রইলাম আর মনে মনে প্রিয় মানুষটিকে অনুভব করতে থাকলাম অবিরত!
রাত শেষে সকালে আবার রওনা হলাম রিয়েলিটির ডাকে, ইংল্যান্ডের দিকে স্বপ্নের স্কটিশ ভূমি ছেড়ে! ইংল্যান্ড–স্কটল্যান্ড সীমান্তে এসে গাড়ি থামিয়ে ফিরে তাকালাম স্কটল্যান্ডের দিকে আর মনে মনে বললাম, ‘আমি আবার আসব ফিরে তোমার ওই মায়াবী টানে, আমি তো এখনো তোমার ৮০ শতাংশের বেশি সৌন্দর্য দেখতেই পারিনি! আমি আসব তাই ফিরে, আমাকে যে আসতেই হবে!’
*লেখক: রাজীব মহিউদ্দিন, সলিহুল, ইংল্যান্ড থেকে