নীড়ের আলোয় পৃথিবী

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

ছোট্ট জানালা মেলে পুরো আকাশটা দেখেছি কত দিন। জানালার গ্রিল বেয়ে বৃষ্টির জল আমার চোখের জলকে আলিঙ্গন করেছে অহেতুক। দুটোতেই মাখামাখি আমি মগ্ন থেকেছি অবাক মৌনতায়। লোকে বলে আমাকে, বড় শান্ত মেয়ে।

অথচ আমি কি এক কথা কত দিন ধরে বলতে চেয়েছি, শেষ রাতের আকাশের সুখ তারাটিকে। কত কথার ঢেউ মানুষের ঢলে আমি লুকিয়ে রেখেছি সন্তর্পণে। কত দিন সকাল হলেই সেসব কথার সামনে পর্দা টেনে দিয়েছি। সূর্যকে দেখেই। সূর্য বড় রাগী। আমার ভয় হয়।
কিন্তু সেদিন সন্ধ্যায় যখন তিনটা গ্রিলের ছোট্ট জানালা বন্ধ করতে গেলাম। দেখলাম পুরো আকাশ জুড়ে তুমি দাঁড়িয়ে। আমার ছোট্ট জানালায় আমি মুহূর্তেই দেখতে পেলাম যেন একটা জগৎ। যে জগৎকে আমি রংধনুর গল্প শোনাতে চেয়েছিলাম। সেই জগৎ, যে জগৎকে আমি আমার চোখের জল আর বৃষ্টির জলকে শনাক্ত করতে বলব বলে ভেবেছি আজন্ম।
ঠিক মনে আছে, তখন কী ভীষণ শিহরণ আমার সমস্ত শরীর জুড়ে।
আমার সতেরো বছরের এই দেহে বইছে ইন্দোনেশিয়ার বান্দা আচেহর মতো ৯.১ মাত্রার কম্পন! একাধিক বার আছড়ে পড়ছে মুগ্ধতার সুনামি। আছড়ে পড়ছে প্রায় এক শ ফুট উঁচু ঢেউয়ের মতো অজস্র অনুভূতি। আমি থর থর করে কাঁপছি। যেন স্থির আমি ভীষণ অস্থির কণ্ঠে তোমার শার্টের কলারটা দুই হাতের নেলপালিশে রাঙা নখে মোচড়ে নিয়ে বলছি, এই ছেলে? তুমিই সেইজন?
যার ছবি কল্পনায় এঁকেছি আমি সুখ-দুখ-ভালোবাসা আর মায়ায়?
তুমিই কি সেই, যার জন্য প্রতিদিন কত পোড়া ভাত ফেলেছি পুকুরে। কাজে অমনোযোগী আমি মায়ের থাপড় হজম করেছি বেলা-অবেলায়। গৃহ শিক্ষকের ধমক খেয়েছি প্রতি ঘণ্টায়।
এমন কথা সব প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল বারবার।
তারপর এসব ভাবতে ভাবতে আমার না বলা মৃত প্রায় দুই লাখ ২৬ হাজার প্রশ্ন আমাকে এলোমেলো করে দিচ্ছিল। আমি সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত। ইন্দোনেশিয়ায় সুনামিতে মরে যাওয়া দুই লাখ ২৬ হাজার প্রাণের শেষ কথা সব যেন আমার কণ্ঠে একই সঙ্গে ঝরবে এই দশা। হৃদয়ে সিদ্ধেশ্বরীর ঢোলের ঢাক...ধুক ধুক। মোহমুগ্ধ দুই চোখ ভেসে যাচ্ছে আবেগের প্লাবনে। তোমাকে আবিষ্কার করার তীব্রতায় দিশেহারা আমি।
ঠিক কত সময় হবে তখন? দশ-পনেরো মিনিট? সেই দশ পনেরো মিনিটই, আমার জীবনে পড়া সমস্ত প্রেমের উপন্যাসের একত্রিত অনুভূতির উপভোগকে নাথিং করে দিল!
সেই সময় টুক এসে, লাভ অ্যাট ফার্স্ট সাইট তিনটা শব্দকে আষ্টেপৃষ্ঠে পিন আপ করে দিল আমার জীবনে। আমার শাড়ির আঁচল পিন আপ করার দায়িত্ব তো আমি এই ছেলেকে দেব বলে কল্পনা করেছি সমস্ত নির্ঘুম রাত। কল্পনার সুগন্ধি সব প্রহরে পড়া প্রিয় সেই কবিতা তোমার জন্যই ছিল বুঝি:
If I could have just one wish,
I would wish to wake up everyday
to the sound of your breath on my neck,
the warmth of your lips on my cheek,
the touch of your fingers on my skin,
and the feel of your heart beating with mine...
Knowing that I could never find that feeling
with anyone other than you!
আহা! আহারে...সেই সন্ধ্যায় তোমাকে নির্নিমেষ দেখতে গিয়ে আমি ঘরে বাতি দিতে ভুলে গেছি। জানালার ওধারে থাকা তোমার শার্টের আলোয় মনে হচ্ছে এই দুনিয়ায় অন্ধকার বলতে কোনো শব্দ ছিল না আদৌ। একটা সাদা শার্ট পরা তুমি। ফুল হাত শার্টের হাতটা একটু গোঁজা। বোঝাই যাচ্ছিল, খুব ব্যস্ততায় দিন কাটে তোমার। দূর থেকে চোখের ভাষা বোঝা যাচ্ছিল না। তবে আমার অনুমান বলছিল, ও চোখে মরণ আমার! কত আর হবে তখন দশ পনেরো মিনিট?
হঠাৎ আমি সংবিৎ ফিরে পেলাম, তোমারই কণ্ঠস্বরে।
কেউ আছেন বাড়িতে?
নিরুত্তর এপাশ। আবার বললে, পানি চাচ্ছিলাম। পিপাসা পেয়েছে খুব। আছেন কেউ?
তখনই ঝুপ করে জানালার দরজা দুটো সরে গিয়ে জানান দিল তোমাকে; কেউ এতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল এখানে। তুমি বুঝলে। আমি দৌড়ে পানি আনতে গেলাম। খুব অপ্রস্তুত আমি কিছুতেই কিছু খুঁজে পাচ্ছিলাম না। চোখের সামনের গ্লাসটাও ঠিক দেখছিলাম না। তার ওপরে সান্ধ্য অন্ধকার। কোনো ভাবে একটা গ্লাস বাংলা সাবান দিয়ে ধুয়েই কলসি মুখে যায়। আশ্চর্য! আমি নির্ণয় করতে পারছি না কোন কলসিতে পুকুরের পানি উঠানো আর কোন কলসিতে টিউবওয়েলের পানি! কলসি থেকে কৌশলে পানি ঢালার ধীর প্রক্রিয়াটাও আমি ভুলে গেলাম। দ্রুতই কলসির কলার ধরে সম্পূর্ণ পানি ছোট্ট একটা গ্লাসেই ঢাললাম। পুরো রান্নাঘর পানিতে সয়লাব। গ্লাস যে ভরেছে পানিতে তা নয়। অতিরিক্ত পানি ঢালাতে গ্লাসটার অনেকাংশই খালি থেকে গেল!
বেসামাল আমি নিজেকে কিছুটা সামলে দৌড়ে যাই তোমাকে পানি দিতে। তার আগে, একবার আয়নায় নিজেকে দেখেনিই টুপ করে।
তারপর কেন জানি, তোমার সামনে যাওয়ার সাহস হয়নি আমার।
ঘরের পাশের সুলতানার হাতেই তোমাকে পানি পাঠাই। তুমি অর্ধেক পানি পান করে অখুশি হওনি। তবে হেসেছ। জিজ্ঞেস করলে, তোমাদের এলাকায় টিউবওয়েল নেই না? পানি খেলাম তবে তৃষ্ণা মিটল না।
মুহূর্তেই দাঁতে জিব কেটে আমি বুঝতে পারি। এইরে! পানিটা পুকুরেরই ছিল! আমি ঠিক তখন জেগে উঠি। আমার কণ্ঠ রোধ হয়ে আসছিল। তবু তোমাকে বলি, শুনুন!
এরপর কোনো কথায় খুঁজে পাচ্ছিলাম না। এটুকুই কি আমার সম্পূর্ণ জীবনের কথা ছিল। কোনো কথাই যে এল না আমার। তুমি খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই শুনবে বলে দাঁড়িয়ে ছিলে। তোমার স্বাভাবিকতা পর্দার আড়ালের আমাকে অস্বাভাবিক নিশ্চুপ করে দেয়। আমি কিছুই বলি না। তুমি চলে যাও।
তারপর?
তারপর যুগটা ডিজ্যুস কিংবা জয়-এর যুগ। তোমার সঙ্গে দেখা হয়।
তোমার প্রচণ্ড ব্যক্তিত্বে বিহ্বল আমি। প্রচণ্ডভাবে আকর্ষিত হই আমি। তোমার সঙ্গে কথা হয়। বন্ধুত্ব হয়। বলা হয় না কেবল সেই সুনামির কথা। যার প্রচণ্ডতায় আমি প্রতিনিয়তই টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছিলাম। যার মুগ্ধ মায়ায় তোমার পুরোটা রাতের নিশ্বাস আমি আমার করতে চাচ্ছিলাম। একান্তই আমার।
আমাকে তুমি প্রাণ খুলে প্রায় সব কথা বলতে। কি করছ, কোথায় আছ, কখন ফিরবে বাসায়। অফিসে কি প্রবলেম। পরবর্তী জবটা কোথায় নিতে চাচ্ছ। আনুষঙ্গিক সব কথা হতো। তুমি দুষ্ট ছিলে!
ওই সব কথার চোখে তুমি কাজলের মতো সৌন্দর্য এঁকে প্রায়ই বলতে, মনে আছে? তৃষ্ণা মিটে নাই কিন্তু!
আমি তোমার এই কথার কোনো উত্তরই খুঁজে পেতাম না। অথচ কত অসংখ্য উত্তর আমার ঘাটে বাঁধা। এর একটার নোঙর ছাড়লে, হয়তো তুমি একবারেই আমার। নয়তো চিরজীবনের জন্য পর। অন্য বন্দর। আমার অবাক লাগে, কাউকে খুব আপন করে চাইলে হয়তো সে সত্যিই খুব আপন হবে। নয়তো চেনাজানা সব মানুষের থেকেও খুব পর দূরত্বে থাকবে।
আমার সাহস হয় না। কত কথা বলতে তুমি। তোমার কথার ঢলে আমি বারংবার ভেসে যেতাম। জোয়ার হতো, হতো কখনো ভাটা। তুমি অনেক কথায় বলতে। বলতে, তোমার একটা রাজ্য থাকবে। তুমি সেখানকার রাজা। সঙ্গে একটা ফাজিল রানি থাকবে। প্রতিরাতে রানি তাদের একমাত্র রাজকন্যাকে ভূতের গল্প শুনাবে। রাজকন্যা দেখতে ভীষণ মিষ্টি হবে। তোমার রাজকন্যার কী নাম হবে তা ও বলতে। বলতে রাজকন্যার নাম হবে পৃথিবী! রানির গল্প শুনতে শুনতে রাজকন্যার সঙ্গে রাজাও ঘুমিয়ে পড়বে। তারপর ফাজিল রানি রাজার কানের ভেতর পানি ছিটিয়ে দুষ্ট রাজাকে জাগিয়ে তুলবে। রাজকন্যার বাবার নাম হবে আলো!
বলাই হয়নি।
তুমি যে আলো! ধ্যাত! আলো নামটা কে যে রাখল তোমার?
আমার নীড় নামটা তোমারই দেওয়া। এত আলো কোথায় রাখে সে! বলো তো?
সন্ধ্যা নামলেই লোকে নীড় খোঁজে। আলোরা বড্ড সূর্য সোহাগী। সূর্য বড় রাগী। আমার ভয় হয়।
এরপর যত দিন গড়ায় তোমার প্রতি ভয়াবহ আসক্তিতে আমি ক্রমেই তলিয়ে যাচ্ছিলাম তোমার অতলে। এভাবেই কেটে গেল সাত শ তিরিশটা দিন।
আমি আর পারছিলাম না। একদিন আমার সমস্ত দ্বিধাকে দরজায় খিল আটকে অবশেষে তোমাকে বললাম, আচ্ছা, নীড় নামটা কেন রাখলে? নীড়ে যদি কেউ ডাকে, কোনো এক সন্ধ্যায়, আলো আঁধারির সন্ধিক্ষণে তুমি ফিরবে নীড়ে?
তুমি উত্তর করলে না কিছুক্ষণ। ক্ষণিক পরে বললে, হুম। যদি সে আসে।
আমি বললাম, নীড় তো যায় না কোথাও। নীড়েই যে ফিরতে হয়। আসবে? এসে নিয়ে যেও সবার সামনে, তবেই।
তুমি বললে, আমাকে বিয়ে করবে? তোমাকে পেছনের দরজা দিয়েই ঢুকতে হবে, তোমার শ্বশুর বাড়িতে। তোমার বাবার ঘরের সামনে দরজায় দাঁড়িয়ে আমি, তোমাকে চেয়ে আনব না। সেখানে কখনো যাবও না। আমি সে পারব না। সে ঔদার্য আমার নেই। তোমাকেই আসতে হবে। আসবে পালিয়ে?
আমি পর্দা টেনে দিলাম। সূর্যের ধার আমার সহ্য হয় না। তৃষ্ণা আমার ছিল বটে। তোমারও কি পিপাসা ছিল না। সে যদি নাই পারো, তবে শিকল তো আমি দিইনি। প্রচণ্ড ব্যক্তিত্বের অধিকারী কারও প্রতি যার প্রচণ্ড ভালোবাসা থাকে তার অভিমানও থাকে প্রচণ্ড রকম। এই প্রথম তোমার হালকা ব্যক্তিত্বের ব্যাঘাতে আমি তোমাতে আবাসন নয়, তোমার থেকে নির্বাসনই উপযুক্ত মনে করলাম।
এরপর অনেকটা সময় কেটে গেল।
আজ সাইত্রিশে আমি। আমার মেয়েটা সতেরোতে পা দিল।
সন্ধ্যা নেমে আসছে।
আলো-আঁধারির সেই চিরচেনা সন্ধিক্ষণ। কিছু পাখি নীড়ে ফিরছে, কিছুটা দিগ্‌বিদিক ছোটাছুটি করছে পথ হারিয়ে। সব পাখি নীড়ে ফিরে না-এই অনুযোগ নিয়ে তাদের ক্লান্ত ডানাগুলো ঝড়ে পড়ছে অদৃশ্যে। অদৃষ্ট এসে ঝরে পড়ার মুহূর্তের সময়গুলো শুষে নিচ্ছে জীবন থেকে।
কে যেন ফুল ভলিউমে গান শুনছে।
মুছে যাওয়া দিনগুলি, আমাকে যে পিছু ডাকে...।
এভাবেই হঠাৎ বৃষ্টি নামল। জানালার গ্রিল বেয়ে বৃষ্টির জলকে চোখের জলে আলিঙ্গন করার উপলক্ষ এনে দিল। আমার মেয়েটা সে জলের মাখামাখি দেখছে মগ্ন মৌনতায়।
ঠিক আমার মতোই হয়েছে মেয়েটা।
মুহূর্তেই আমার বুকটা ধুক করে উঠল, সেই সুনামি! আমার মেয়েটা কীসের কথা ভাবছে? কার কথা ভাবছে ও? কাউকে চোখের জল আর বৃষ্টির জলকে শনাক্ত করতে দেবার কথা ভাবছে নাতো?
আমি আমার সমস্ত আবেগকে আগলে রেখে পেছন থেকে ডাকলাম আমার মেয়েকে, আমার রাজকন্যা পৃথিবীকে!