নীলপরির অপেক্ষায়

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

রিকশা খুঁজছি। এইমাত্র বউকে ডাক্তার দেখালাম। এখন বাসায় ফিরতে হবে। একজন রিকশাওয়ালা পেয়ে বললাম, মামা পীরেরবাগ যাবেন?
যামু। আমরা কিন্তু তিনজন।তিনজন শুনে বউ প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাল। পরক্ষণেই বিষয়টা বুঝতে পারল। সঙ্গে সঙ্গে তাঁর সারা মুখে লাজুক একটা হাসি ছড়িয়ে পড়ল।
রিকশাওয়ালা বলল, কয়ডা টাকা বাড়াইয়া দিয়েন।
আবার জিগায়। যান দিলাম। নো টেনশন।
বউ আর আমি রিকশায় উঠে বসলাম। রিকশাওয়ালা রিকশা ধরে দাঁড়িয়ে আছে।
ওকে মামা চলেন। রাত্রিবেলা একটু দেখে চালাবেন।
আমনে না কইলেন তিনজন। তা আরেকজন কই?
আমরা তো তিনজনই উঠেছি। মামা কি রাতে কম দেখেন? রাত কানা? তাইলে তো আপনার রিকশায় যাওয়াটা রিস্ক।
একটু মজা করতে ইচ্ছে হলো। জানি এটা উচিত না, কিন্তু মাঝে মাঝে মানুষকে বিভ্রান্ত করতে আমার ভালো লাগে।
মামা আমনে আমার লগে মজা করতাছেন তাই না?
কেন আপনি কি আমার দুলাভাই, যে মজা করব?
কিন্তু আমার চোখেও কোনো সমস্যা নাই। আমিতো সবই ফকফকা দেখি।

আপনি বললেই তো আর আমি মানব না। একটু পরীক্ষা–নিরীক্ষা করতে হবে। বলেন তো এখানে কয়টা আঙুল?
তিনডা। রিকশাওয়ালা খুব সিরিয়াসলি উত্তর দিল। কারণ সে এখনো বুঝতে পারছে না আমি সিরিয়াস না মজা করছি।
ভেরি গুড। মাশআল্লাহ মামা আপনার চোখতো ফাটাফাটি রকমের ভালো। একদম বিশে বিশ। তবে আমার ধারণা আপনার কালার ভিশনে প্রবলেম আছে। সম্ভবত আপনি কালারব্লাইন্ড। যার কারণে আপনি নীল রং দেখতে পান না। তাই আপনি আরেকজনকে দেখতে পাননি। কারণ উনি নীল পোশাক পড়ে আছেন। তার গায়ের কালারও নীল।
রিকশাওয়ালার চেহারা দেখে মনে হলো তার মাথায় কিছুই ঢোকেনি। কথাগুলি তার মাথার ওপর দিয়ে গেছে।
এগুলা কি কইতাছেন?
বেশি বোঝার দরকার নাই। শুধু মনে রাখবেন কালারব্লাইন্ড একটা মস্ত বড় অসুখ। আর আপনার জন্য সবচেয়ে ভয়ংকর দুঃসংবাদ এই রোগের কোনো চিকিৎসা আমার জানামতে নাই। আফসোস। আপনার জীবনটা একেবারে সাদাকালো হইয়া গেল। অবশ্য কেউ কেউ বলেন মাথায় বাড়ি মেরে আঘাত করলে হয়তো রং দেখার জন্য যে কোষগুলি আছে তা আবার জেগে উঠতে পারে। আবার উল্টো ক্ষতিও হতে পারে। আপনি চাইলে আমি আপনার মাথায় লাঠি দিয়া বাড়ি মেরে দেখতে পারি। কোনো পয়সা লাগবে না। একদম ফ্রি চিকিৎসা। দাঁড়ান একটা লাঠি পাওয়া যায় কিনা দেখি।
আমার বউ ও রিকশাওয়ালা দুজনেই হা করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমার কাছে মনে হলো রিকশাওয়ালা মামার হা-টা একটু বেশি বড় হয়ে গেছে। চারপাশে যে পরিমাণ মশা, কয়েকটি যে ঢুকবেই আমি নিশ্চিত।
মামা আপনার মুখটা বন্ধ করেন। আশপাশে সব ডেঙ্গু মশা। ভেতরে ঢুকলে খবর আছে।
এই তুই থামবি। মামা আপনি চলেন। ওর মাথায় একটু গন্ডগোল আছে। ও একটা পাগল, কিছু মনে করবেন না।
বউ ঝাড়ি মেরে উঠল। তবে মুখে রাগের কোনো চিহ্ন নেই। মুচকি মুচকি হাসছে। আমার মাথায় গন্ডগোল আছে শুনে রিকশাওয়ালা মামার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল। এতক্ষণ সে মনে করেছিল আমি হয়তো বা মজা করছি। কিন্তু বউ যখন বলে স্বামীর মাথায় গন্ডগোল আছে, তখন সেটাকে তো আর হালকাভাবে নেওয়া যায় না। মামাও হালকাভাবে নিল না। সে কোনো অবস্থাতেই যাবে না। পাগল যাত্রী নিয়ে রিকশা চালাতে সে সাহস পাচ্ছে না। অতএব রিকশা থেকে নেমে যেত হলো। বউকে ধন্যবাদ দিলাম স্বামীকে পাগল হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্য।
বউ অবশ্য মিথ্যা বলেনি। এমনিতেই আমি একটু পাগল কিসিমের। তার ওপর ডাক্তারের চেম্বার থেকে বের হওয়ার পর নিজেকে আরও পাগল পাগল মনে হচ্ছে এবং খুব পাগলামি করতে মন চাচ্ছে। কেন? ঘটনাটা খুলেই বলি।
বিয়ের আগেই বউকে বলেছিলাম, সম্ভব হলে আমি বিয়ের পরদিনই বাবা হতে চাই।
বউ বলেছিল, এত তাড়াহুড়ার কি আছে?
অবশ্যই আছে। আমরা দুজনে এখানে, আর আমার নীলপরি বেহেশতে মন খারাপ করে একাকী ঘুরছে, এটা হতে পারে না।
মানে কি, বুঝলাম না। আর নীলপরিটা কে? বউয়ের অবাক প্রশ্ন।
নীলপরি, আমার মেয়ে। বাচ্চারা দুনিয়াতে আসার আগে বেহেশতে বসবাস করে। আমার মেয়েও এখন বেহেশতে একাকী অবস্থান করছে। বাবা-মাকে ছেড়ে কত দিন একাকী থাকবে?
আমি দ্রুত আমার মেয়েকে আমার কাছে নিয়ে আসতে চাই। বুকের মাঝে জড়িয়ে ধরতে চাই।
কিন্তু সে যে মেয়ে তোকে কে বলেছে। ছেলেও তো হতে পারে।
না আমি জানি মেয়ে। আমার মেয়েকে আমি সব সময় আমার মাঝে অনুভব করি। তার সঙ্গে আমার প্রায় কথা হয়। সে সব সময় আমার স্বপ্নে আসে। এসে বলে, বাবা হারি আপ। বেহেশতের বিছানায় শুতে শুতে আমি বোরড। আমি তোমার বুকে শুতে চাই। তাড়াতাড়ি বিয়ে কর। তাইতো চাকরি-বাকরি হওয়ার আগেই বিয়ে করছি। প্লিজ হেল্প মি।
আমার কথা শুনে বউ বলেছিল, পাগল।
আমরা দুজনে ছিলাম সহপাঠী ও বন্ধু। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একই বিষয়ে পড়ালেখা করতাম। দুই পরিবারের সম্মতি নিয়ে পারিবারিকভাবেই বিয়ে করি। বিয়ের পর তিন বছর আমি নীলপরির পথ চেয়ে বসে আছি। কিন্তু কেন জানি আল্লাহ ভিসা দিচ্ছেন না। বারবার আল্লাহকে অনুনয়-বিনয় করছি আর আল্লাহ বারবার ভিসার আবেদন প্রত্যাখ্যান করছেন। প্রথম দিকে আমার বউ বিষয়টা নিয়ে মাথা ঘামাত না। কারণ বিয়ে হয়েছে মাত্র তিন বছর। কিন্তু বাচ্চার জন্য আমার পাগলামি দেখে সেও চাচ্ছিল দ্রুত আমাকে একটা বাচ্চা উপহার দিতে। যার কারণে তখন সে চরমভাবে হতাশ। তার মুখ দেখলেই বোঝা যায়, সে কতটা মানসিক কষ্টে আছে। তার মলিন মুখ দেখে নিজের কষ্টকে লুকিয়ে রাখি। বুঝতে পারি আমাদের জীবন থেকে আস্তে আস্তে আনন্দগুলো হারিয়ে যাচ্ছে, সরে যাচ্ছে দূরে। আমিতো কাজের চাপে ভুলে থাকার চেষ্টা করি। কিন্তু খালি বাসায় সে তো কষ্টের সমুদ্রে ডুবে থাকে। সবি বুঝি। কিন্তু কি করব। নিজেকে খুব অসহায় মনে হয়। আমার মেয়ে আমার কাছে আসার জন্য ব্যাগ গুছিয়ে বসে আছে, আর আমি তাকে আনতে পারছি না। সরি মা, আমাকে ক্ষমা করিস।
এভাবে আর সম্ভব নয়। বউকে বললাম ডাক্তার দেখাব। সমস্যা যারই হোক চিকিৎসা দরকার। বেছে নিলাম পিজি হাসপাতালের (বর্তমানে শেখ মুজিব বিশ্ববিদ্যালয়) গাইনি বিভাগের প্রধান ডা. শায়লা ম্যাডামকে। আগের সপ্তাহে এসেছিলাম। কিছু টেস্ট দিয়েছিলেন। বলেছিলেন রিপোর্ট দেখে বলবেন করণীয় কি। আজ দুরুদুরু বুকে এসে বউকে ডাক্তারের রুমে পাঠিয়ে আল্লাহর নাম জপছি। বউ বলেছিল ভেতরে ঢুকতে। সাহস হয়নি। অনেকক্ষণ হলো বউ ভেতরে। আমি ঘামছি। চেম্বারের ওয়েটিং রুমে অনেক মানুষ। বেশির ভাগই নারী ও তাদের অধিকাংশই গর্ভবতী। সঙ্গে তাদের গর্বিত স্বামী বা পরিবারের সদস্য। আর আমি বসে আছি শুধু এটা জানার জন্য যে আমার বউ মা হওয়ার জন্য প্রস্তুত, তার কোনো সমস্যা নেই। মনে হচ্ছে কতকাল বসে আছি। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি ডাক্তারের রুমের দরজার দিকে। আশা করছি বউ হাসি মুখে বের হবে ও বলবে Everything is ok.

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

বউ দরজা ঠেলে বের হলো। চোখ দুটি ভেজা। বউয়ের চোখের পানি দেখে বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠল। বুঝলাম খারাপ কিছু। তীব্র ব্যথা অনুভব করলাম বুকে। মনে হলো কেউ যেন হৃৎপিণ্ডটা ছিঁড়ে নিয়ে যাচ্ছে। মাথাটা পেছন দিকে ঝুঁকিয়ে সিলিংয়ের দিকে তাকালাম। কিন্তু আমি সিলিং দেখছি না। আমার দৃষ্টি সিলিং ছাড়িয়ে সপ্তম আসমানে। বিড়বিড় করে সৃষ্টিকর্তাকে বললাম, তুমি জান আমি কাঁদতে পারি না। তবে কেন আমাকে কাঁদাতে চাও। please don't do this, please. চোখ দুটি বন্ধ করলাম। বেহেশতের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে টোকা দিলাম। নীলপরি দরজা খুলে হাসি মুখে দাঁড়াল। হাতে গোছানো ছোট্ট ব্যাগ। তাকিয়ে আছে আমার দিকে। বললাম, নীলপরি, তুমি কি জান দুনিয়ায় কত কষ্ট। ধুলাবালি, কালো ধোঁয়া, ময়লা-আবর্জনা, মশা, পোকা-মাকড়, আর ভয়ংকর সব প্রাণী। রাস্তায় জ্যাম। খাবারে ফরমালিন। এগুলো তোমার সহ্য হবে না, কষ্ট হবে। তার চেয়ে ভালো, তুমি বরং ওখানেই থাকো। বাবা প্রতি রাতে এসে তোমাকে ঘুম পাড়িয়ে যাব। কথাগুলো বলতে বলতে চোখ দুটি ভিজে গেল। নীলপরি বলল, বাবা তুমি কাঁদছ কেন? তুমি কাঁদলে আমারও খুব কান্না পায়। আর তুমি কি জান, কাঁদলে তোমাকে খুব পচা লাগে।
তুমি হাত দিয়ে মুছে দেবে সেই লোভে কাঁদছি, মা।
মনে হলো কে যেন জড়িয়ে ধরল। চোখ খুললাম, দেখি বউ জড়িয়ে ধরেছে। আমিও জড়িয়ে ধরলাম। ভুলেই গেলাম চেম্বারের অনেকগুলো চোখ আমাদের দেখছে। বউ কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলে উঠল, এই গাধা কাঁদছিস কেন? তোর নীল পরিরতো ভিসা হয়ে গেছে। সে আসছে। সে এখন প্লেনে।
মানে কি? অবাক হয়ে প্রশ্ন করলাম।
আরে বলদ আমি প্রেগন্যান্ট।
তাহলে তোর চোখে পানি কেন?
তুই আমার চোখে পানি দেখলি, কিন্তু মুখে যে হাসি ছিল তা দেখলি না!
আনন্দে বউকে আবারও জড়িয়ে ধরলাম। চোখ বন্ধ করলাম। নীল পরির সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। বললাম, মা, তুমি কি জান পৃথিবীটা কত সুন্দর?
তুমি না বললে ওখানে কত ময়লা-আবর্জনা, ধুলোবালি। অভিমানের সুর নীল পরির কণ্ঠে।
তাতে কি। শরীরে যদি ময়লা লাগেই, তবে আমরা বৃষ্টিতে ভিজব। বৃষ্টির পানিতে সব ময়লা ধুয়ে যাবে।
কিন্তু মশা, পোকামাকড় আর ভয়ংকর প্রাণীর কি হবে।
আমি আছি না? তোমায় আমি বুকে আগলিয়ে রাখব।

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

আমার কথা শুনে নীলপরি মুচকি হেসে বলল, আমার পাগল বাবা। বাবা তোমাকে আমি অনেক ভালোবাসি।
আমিও তোমাকে অনেক ভালোবাসি, মা। চোখ দুটি আমার জলে ভিজে গেল।
বাবা তুমি কিন্তু আবারও কাঁদছ? তোমাকে পচা লাগছে।
তুমি চোখে পানি দেখলে, কিন্তু মুখে যে হাসি ছিল তা দেখলে না?
বাবা তুমি তো আম্মুর মতো করে কথা বললে।
তাই মা?
এই ছাড়। সবাই তাকিয়ে আছে। বিড়বিড় করে কি বলছিস? বউয়ের কথায়, বউকে ছেড়ে দিয়ে চোখ খুললাম। চেম্বারের অন্য রোগীরা আমাদের দেখে মুচকি মুচকি হাসছেন। গায়ে মাখলাম না। বুক ভরে শ্বাস নিলাম। চেম্বারের ছাদ ফুঁড়ে সপ্তম আসমানের দিকে তাকিয়ে সৃষ্টিকর্তাকে বললাম, Thank you.
বি. দ্র. মেয়ের সামনে কাঁদলে সব বাবাকেই কি পচা লাগে? নাকি শুধু আমাকেই লাগে?