নীতি ও নৈতিকতা

যেকোনো বিষয়কে সময়ে সঠিক অনুধাবন বা মূল্যায়ন করতে না পারলে পরে প্রয়োজনে তা আর পাওয়া যায় না। ঠিক তেমনি আমরাও একে অপরকে যদি সঠিক মূল্যায়ন করে তার যথাযথ মর্যাদা না দিই তখনই সম্পর্কের অথবা সময়ের অবনতি ঘটে। এখন এই যে মূল্যায়ন না করা বা মর্যাদা না দেওয়া এ দুটির মাঝে নীতিহীনতা এবং অনৈতিকতা দুটি বিষয়ই যখন সমানভাবে কাজ করে তখনই সবার মধ্যে দ্বন্দ্ব বা সংঘাত তৈরি হয়।

সবার জন্য প্রচলিত, গ্রহণযোগ্য এবং অবশ্যই পালনীয় বিষয়গুলো বা নির্দেশনাগুলোই হলো নীতি। নৈতিকতা? নৈতিকতা আচরণ বা চরিত্রকে নির্ধারণ করে। মানুষের চারিত্রিক আদর্শ বা নৈতিক গুণাবলি হলো নৈতিকতা। অথবা আমরা বলতে পারি ক এর কিছু নীতি রয়েছে যা পালন করার মাধ্যমে তার নৈতিকতা বা চরিত্র বিকশিত হয়।

আসল কথা, মানুষের সুন্দর ও সুষ্ঠু প্রকাশ বা বিকাশটাকেই তার নৈতিকতার বিকাশ বলা যেতে পারে। যেমন ‘রহিমকে’ যদি বাজারের জন্য কিছু টাকা দেওয়া হয় নির্দিষ্ট কিছু পণ্য কিনে আনার জন্য, আর রহিম ঠিক সে পণ্যগুলোই যদি সঠিক মূল্যে কিনে আনে এবং তাতে যদি কিছু টাকা বেচে যায় আর বাকি টাকা ফেরত না দিয়ে নিজের কাছে রেখে দেয়। তাহলে তার কোন বিষয়টি থাকল আর কোনটি গেল? নাকি নীতি এবং নৈতিকতা দুটিই গেল? না দুটিই যায়নি। এ ক্ষেত্রে আমরা বলতে পারি, সে নীতি ঠিক রেখেছিল কারণ তাকে যে যে জিনিসগুলো আনতে বলা হলো সে ঠিক সে জিনিসই এনেছিল কিন্তু সে তার নৈতিকতার স্খলন ঘটিয়েছে কারণ সে উদ্বৃত্ত টাকা ফেরত না দিয়ে নিজের কাছে রেখে দিয়েছে। এর ফলে তার চরিত্রটি আমাদের কাছে অনৈতিক হয়ে উঠেছে। এটি সে অনৈতিক কাজ করেছে।

তাহলে এবার সমাজের কথায় আসা যাক, সমাজে কারা কারা নীতি হারিয়ে নৈতিক কাজ করছেন আর কারা নীতি বজায় রেখে অনৈতিক কাজ করছেন? আমরা পুরো সমাজ বা রাষ্ট্রকে যদি একনজরে দূর থেকে দেখি, তবে কখনো আবছায়ার মতো মনে হবে। আবার কখনো দোদুল্যমান মনে হবে। কারণ আমাদের সমাজব্যবস্থা আজ সম্পূর্ণই নীতি বিবর্জিত।

একজন রিকশাচালক যদি সারা দিন কায়িক পরিশ্রম করে পরিবারের সদস্যদের মুখে দুমুঠো অন্ন তুলে দেওয়ার আশায় ৩০ টাকা ভাড়ার স্থলে ৪০ টাকা চান তাহলে তিনি কি কোনো ভুল করছেন? তিনি কি সমাজের চোখে নীতিহীন কাজ করছেন? বিচারের দায়িত্ব পাঠক গ্রহণ করুন। আমি বলব নিঃসন্দেহে এখানে তিনি কোনো ভুল করছেন বলে আমরা বলতে পারি না। কারণ তিনি নীতি ঠিক রেখে সঠিক কাজটিই করছে। তাঁর নীতি হলো তিনি প্রতিদিন সঠিক নিয়মে কাজ করছেন এবং কাজটাকে মূল্য দিচ্ছেন, সংসারের দায়িত্ব পালন করছেন। এটি হলো তাঁর মূলনীতি। আর তাঁর নৈতিকতা হলো সে চুরি না করে, অসামাজিক কাজ না করে সৎ পথে টাকা উপার্জন করছেন। তিনি যদি রিকশা একদিন চালিয়ে বাকি তিন দিন পরিবারের অন্য সদস্যদের উপার্জনের আশায় বসে থাকেন, তাহলে সেটি হবে নীতিহীন কাজ। সেটি অনৈতিক বলা যায় না।

আমরা প্রায়ই শুনে থাকি মানুষ তাদের নৈতিকতা হারিয়ে ফেলছে। বিশেষত মেয়েদের ক্ষেত্রে নৈতিকতার কথাটি একটু বেশিই শোনা যায়। যদি একজন নারী পরকীয়া করে থাকে নিশ্চয়ই সেটি অনৈতিক কাজ। তাহলে সে যে পুরুষটির সঙ্গে পরকীয়ায় লিপ্ত হলো সে পুরুষও অনৈতিক কাজ করছে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে যদি একজন যৌন কর্মীকে আমরা বলি সে অনৈতিক কাজ করছে, তাহলে কি সেটি ভুল বলা হবে? নিশ্চয়ই না। তবে কর্মের মূল উৎস যখন একমাত্র জীবিকা হয়ে দাঁড়ায় বা একমাত্র আয়ের মাধ্যম হয় তখন সেটি আর অনৈতিক থাকে না।

আত্মসম্মানকে নিচে নামিয়ে বা আত্মমর্যাদার কথা বিবেচনা না করে এবং অন্যকে ছোট বা অসম্মান করে ভুল বা যেকোনো অসামাজিক কাজই অনৈতিক বলা যায়। সততার সঙ্গে যেকোনো কর্ম সম্পাদনই নৈতিক কাজ। আর নীতি হলো যে কাজগুলো গ্রহণযোগ্য, সাবলীল এবং প্রবিধানযোগ্য। তাহলে কতজন এ নীতি মানছি বা মানার প্রয়োজনবোধ করছি? আমরা কি নীতি মেনে চলি? যদি পাশের মানুষগুলোর দিকে তাকাই খুব সহজেই তার পরিচয় মেলা সম্ভব। আমরা কে কাকে কতটা অসম্মান করব? কতটা স্বার্থ আদায়ের জন্য অন্যকে ব্যবহার করব এসব নিয়ে ব্যস্ত থাকি।

অবশ্যই সমাজের প্রতিটি মানুষের প্রতি আমাদের দায়বদ্ধতা রয়েছে। অর্থাৎ একের প্রতি অন্যের সম্মান প্রদর্শনের দায়বদ্ধতা, সহানুভূতির, সহযোগিতা, সহমর্মিতা এসব কিছুই নৈতিক আচরণের বা নৈতিকতার বৈশিষ্ট্য। একজন মানুষ চুরি বা অসামাজিক কাজ করাটা যেমন অনৈতিক তেমনি কাউকে অসম্মান করাটাও অনৈতিক কাজ। যাকে আমরা মূল্যবোধ বলে থাকি।

এখন প্রশ্ন হতে পারে সে কি এ ক্ষেত্রে নীতিহীন হলো? এগুলো তার নীতিবিরোধী কাজ নয়। কারণ ওপরের বিষয়গুলো কোনো রুলস নয় বা তাকে কেউ বলে দেয়নি বা সে নিজে মনে মনে নির্ধারণ করেও নিজেকে তৈরি করেনি। আমরা সহজভাবে বলতে পারি, এগুলো রাষ্ট্র বা সমাজ কর্তৃক আরোপিত নয় বা সে নিজেও তৈরি করেনি। আপনি যদি নিজের সিদ্ধান্ত অন্যের ওপর চাপিয়ে বা অন্যের সম্মানহানি করে কোনো কাজ করেন অথবা কাউকে আঘাত করে কোনো কাজ করেন সেটি নিশ্চয়ই অনৈতিক।

পৃথিবীজুড়ে আজ যে অস্থিরতা, অশান্তি, সংঘর্ষ, অরাজকতা সবকিছুই নৈতিক এবং আত্মিক প্রশিক্ষণহীনতার কারণেই ঘটছে। তাই সবার আগে প্রয়োজন নিজের মানসিক বিকাশ। যাকে আমরা বলতে পারি ‘আত্মশুদ্ধি’ বা মূল্যবোধ। আর এই নীতি, নৈতিকতা বা মূল্যবোধ এসব কিছুই একটি সমাজ বা রাষ্ট্রের মূল চালিকা শক্তি। এসব কিছুর অভাব রাষ্ট্রের সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক মানদণ্ডকে নতজানু করে দেয়।

সর্বজনীনভাবে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য কিছু নৈতিক আচরণ রয়েছে। সেটি হলো তার বিবেক, আচরণ, ভুল ও সঠিক নির্ধারণ করার মেধা। সর্বোপরি যা অন্যর কাছে সাবলীল বা গ্রহণযোগ্য। প্রকৃতপক্ষে যে যাই বলুক, আমরা যেন মূল মানবিক মূল্যবোধ থেকে সরে না যাই। অন্যের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন নৈতিকতার একটি মূলনীতি। আমরা যেন একের প্রতি অপরের সম্মানটুকু রেখে চলি, তাহলে আমার ধারণা এতে নীতি বা নৈতিকতা দুটিই পারস্পরিকভাবে পাশাপাশি বজায় রেখে চলা সম্ভব।