নিমন্ত্রণ রইল সবার

১.
‘হোয়াট দ্য ফা....’
ফারহানের মুখ দিয়ে ইংরেজি চার অক্ষরের দুষ্টু শব্দটা বেরিয়েই আসছিল, ওমনি তার স্ত্রী নিতু হা রে রে রে করে ছুটে এল।
‘মুখ সামলে! বাচ্চারা আছে!’

ফারহান শেষ মুহূর্তে নিজেকে সামলে নিল। যদিও তার এখন ইচ্ছা করছে টিভিটা তুলে একটা আছাড় দিতে। আড়াই হাজার ডলার দিয়ে কেনা পঁচাশি ইঞ্চির বিগ স্ক্রিন টিভির বয়স ছয় মাসও হয়নি। একে খালি হাতে ধরতে গেলেও মন খচখচ করে, যদি ময়লা লেগে যায়! অথচ এখন মনে হচ্ছে, বেসবল ব্যাট দিয়ে পঁচিশটা বাড়ি দিতে পারলে মন একটু শান্ত হতো।

ঘটনা হচ্ছে, আজকে এনএফএলে ডালাস কাউবয়েজের সাথে ফিলাডেলফিয়া ইগলসের খেলা। ক্রিকেটে অনেকটা ভারত-পাকিস্তান বা অতি সম্প্রতি বাংলাদেশ-শ্রীলঙ্কা লড়াইয়ের মতন। দারুণ জমজমাট এই খেলার মজা নিতে তার বাড়িতে পার্টির আয়োজন করা হয়েছে। বন্ধুবান্ধব মিলে হৈ–হুল্লোড় করতে করতে খেলা দেখা হবে।

ডালাস আজকে ফিলাডেলফিয়াকে উড়িয়ে দেবে। তাহলেই না মজা! এ উপলক্ষে পিৎজা, চিকেন উইংস, বিফ রিবস স্ন্যাকসের ব্যবস্থা করা হয়েছে। আছে বিয়ারেরও সুব্যবস্থা। একসময় বাঙালি দাওয়াতগুলোয় মদের ব্যবস্থা থাকত না। ধীরে ধীরে পরিবর্তন এসেছে। এখন কিছু পারিবারিক আয়োজনে অনিয়মিত হলেও সমবয়সী বন্ধুবান্ধবদের পার্টিতে মদের উপস্থিতি থাকেই। বিশেষ করে আয়োজকের নিজের যদি মদ্যপানের অভ্যাস থাকে। আর যার অভ্যাস নেই, সে খায় না। তার বাড়িতেও মদ ঢোকে না। কোনো জোরজবরদস্তি নেই।

আমন্ত্রিত অতিথিরা আসতে শুরু করেছেন। খেলা শুরুর মাত্র কুড়ি মিনিট বাকি, এমন সময় টিভি ‘ফ্রিজ’ হয়ে গেছে। দেশি ভাষায় বললে ‘হ্যাং’ করেছে। মানে একটা দৃশ্যে আটকে আছে। না চ্যানেল বদলাচ্ছে, না রিমোট কাজ করছে, না কোনো রেসপন্স করছে।

ফারহান-নিতুর বাঙালি বন্ধুবান্ধবেরা যার যার স্বামী ও স্ত্রী নিয়ে এসেছেন। খেলা নিয়ে ছেলেদের আগ্রহই বেশি। হইচইয়ের পাশাপাশি প্রচুর গালিগালাজ হবে, তাই টিভি খুলে নিয়ে ওপরের গেম রুমে ফিট করা হয়েছে। মেয়েরা নিচতলার ড্রয়িংরুমে বসে তাদের নিজেদের মতো গল্পগুজব করবে। মাঝেমধ্যে খেলার স্কোর জানতে পারলেই হলো। আর না জানতে পারলেও কিছু যায় আসে না। বেশির ভাগ বাঙালি মেয়েই এনএফএল নিয়ে খুব একটা আগ্রহী নয়। ওদের আড্ডার বিষয় সম্পূর্ণ ভিন্ন এবং চটকদার।
‘তানিয়া আপু কাজটা কী করেছে দেখলে?’

‘আমি আগেই জানতাম ওর বাইরে কোথাও চক্কর চলছে।’
‘ওমা, কীভাবে?’

‘ওর ক্যারেক্টারেই সমস্যা ছিল। দেখো না, ফেসবুকে কেমন খুল্লামখুল্লা ছবি আপলোড করত!..... পরে সাঁতার কাটছিল ভালো কথা, ফেসবুকে দেখায় বেড়াবি ক্যান?’

‘আজাইরা লোকজনের কী সব ফালতু ফালতু কমেন্ট! নাইস লুকিং! অনেক সুন্দর! আসিফ ভাই এসব দেখত না? একটা মেয়েই বা এসব সহ্য করে কীভাবে?
‘ওর ভালো লাগত বলেই ওরা কমেন্ট করার সাহস পেত!

‘ঠিকই বলি। মহিলার প্রথম থেকেই চরিত্রে দোষ ছিল। আমি বরং অবাক হয়েছি এত দেরিতে ভাগল কেন! আরও বহু আগেই এই কাজ করার কথা ছিল তার।’
‘আসিফ ভাইয়ের এখন অবস্থা কী?’

‘অবস্থা আবার কী? দুই বাচ্চা ফেলে তার বৌ ভেগেছে। এখন বাসায় বসে কিছুদিন মদ খাবে আর পুরোনো বৌয়ের কষ্টে কান্নাকাটি করবে।’

একই আলোচনা ওপরেও চলছে। তবে একটু ভিন্নভাবে।
‘তানিয়া ভাবির অ্যাফেয়ার ছিল, এটাই তো জানতাম না।’
‘যা–ই বলো না কেন, মহিলা হট ছিল! দাওয়াতে খুব মিস করব তাকে!’
‘আমি তো বাঙালি দাওয়াতে আসতামই ভাবির সাথে কিছুক্ষণ আলাপের জন্য। হি হি হি।’

‘আমরা বাঙালি পুরুষেরা কি মরে গেছিলাম যে আমাদের ফেলে একটা মেক্সিকানের হাত ধরে পালালেন?’

‘মেক্সিকান না, পুয়ের্তোরিকান।’
‘ঐ একই। সব লাতিনোই এক।’
‘না, সিরিয়াসলি! সমস্যাটা কোথায় ছিল কেউ জানো?’

‘কী আর সমস্যা? আসিফ ভাই সময় দিতেন না, অফিস, কাজ, ব্যবসা নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন। ওই সময় গঞ্জালেস ভাই ছক্কা মেরে দিয়েছেন!’

মূল ঘটনা হচ্ছে ওদের বন্ধুবান্ধবদের মধ্যেই সিনিয়র একজন, আসিফ ভাই, যিনি দশ বছর ধরে সুখে সংসার করছিলেন, যার দুটো স্কুলপড়ুয়া সন্তান আছে, তাঁর স্ত্রী, যিনি একই সাথে সুন্দরী ও স্মার্ট এবং এই বন্ধুবৃত্তের অতি জনপ্রিয় মুখ, দুদিন আগে অফিসের এক সহকর্মীর কাছে চলে গেছেন। ঘটনা এতটাই অকস্মাৎ ঘটেছে যে খোদ আসিফ ভাই পর্যন্ত কিছু বুঝতে পারেননি। হঠাৎ করে বাড়িতে এসে দেখেন স্ত্রীর জামাকাপড়, ব্যাগ, স্যুটকেস, গাড়ি কিছুই নেই। কেবল একটি চিঠি রেখে গেছেন।

সেখানে লেখা, আসিফের সঙ্গে সংসার করা তাঁর পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। কিছুদিনের মধ্যেই আসিফ ভাই তালাকের নোটিশ পেয়ে যাবেন। ইচ্ছা করলে বাচ্চাদেরও তিনি রাখতে পারেন।

স্ত্রীর পালিয়ে যাওয়ায়, নাকি এই খবর শুনে বাঙালি সমাজের প্রতিক্রিয়ায়, আসিফ ভাই ঠিক কোন কারণে বেশি শোকাহত হলেন বোঝা গেল না। তিনি নিজেকে গৃহবন্দী করে ফেলেছেন। বাইরের কারোর সাথে কথা বলতে বিন্দুমাত্র আগ্রহ দেখাচ্ছেন না।

তবে সংবাদ চাপা থাকল না। দাবানলের বেগে চারপাশে ছড়িয়ে পড়ল। এখনো যেমন এই পার্টিতেই সেই আগুনে হাওয়া লাগছে।

২.
‘আরে সুমি! তুমি দেখি আজ আমারও আগে!’
তৌসিফ বাড়িতে ঢুকতে ঢুকতে বলল। সুমি হচ্ছে এমন মেয়ে যে যেকোনো দাওয়াতে সবার শেষে আসে। মাঝেমধ্যে এতটাই দেরিতে আসে, যে অতিথিসেবক নিজেই বিরক্ত হয়ে যান। যেমন একবার এক রেস্টুরেন্টে এক বাচ্চার জন্মদিনের অনুষ্ঠান ছিল। এসব রেস্টুরেন্ট যেমন প্লেট ধরে চার্জ করে, তেমনি ঘড়ি ধরে টাকাও কাটে। তাই নিমন্ত্রণকর্তা নিমন্ত্রণের সময় বারবার উল্লেখ করেছিলেন যে দুপুর বারোটা থেকে তিনটা, এই তিন ঘণ্টার জন্যই রেস্টুরেন্ট ভাড়া করা হয়েছে। সবাই যেন এই সময়ের মধ্যেই এসে পড়েন। সেই দাওয়াতে যখন সুমি প্রবেশ করে, তখন ঘড়িতে দুইটা পঞ্চান্ন বাজে। অতিথিকে তো আর খালিমুখে বিদায় করা যায় না। অতঃপর ওর জন্য ওভারটাইমের বিল পরিশোধ করতে হয়েছে।

সুমির কেন এত দেরি হয়, সেটাও রহস্য। মেয়েরা সাজগোজে বেশি সময় নেয় বলে জনশ্রুতি আছে। সুমির সে বালাই নেই। খুবই হালকা সাজের ওপরই সে থাকে। ওর স্বামীও গোবেচারা ধরনের ভালো মানুষ। ভীষণ অন্তর্মুখী স্বভাবের। কারও সঙ্গে বিশেষ কথাবার্তা বলেন না ভদ্রলোক। প্রফেসর মানুষ। একজন বিজ্ঞানগবেষক। নিজের কাজ, গবেষণা ইত্যাদি নিয়েই মগ্ন থাকেন। এই যে আজকে খেলা দেখতে এসেছেন, ওপর তলায় পুরুষদের হই–হট্টগোলের ভিড়েও এক কোণে একটি টুলের ওপর বসে আছেন। টিভি চলুক না চলুক, তাঁর যেন কিছুই যায় আসে না।

সুমি ঠিক বিপরীত। হাসি, ঠাট্টা, হুল্লোড়ে পুরো আসর মাতিয়ে রাখতে পারে। যেকোনো পার্টিতে তাই সুমির কদর আলাদা।

তাই আজ তৌসিফ সুমিকে আগে আসতে দেখে এতটা অবাক হয়েছে। কারণ, এমনটা কখনোই ঘটে না।

সুমি হেসে উত্তর দিল, ‘আমার নামে শুধু শুধু বদনাম হয় বলে সেটা ঘোচাতে এসেছি!’
‘আজকে তুমি সবার দেরিতে এলে!’ সামিরা ভাবি গলা উঁচিয়ে তৌসিফকে বললেন।

তৌসিফ হেসে বলল, ‘সবই ঝুমুর ম্যাডামের কৃপা! আমি তো ভয় পাচ্ছিলাম, আজ সারা রাতেও ওর মেকআপ শেষ হবে না!’

তৌসিফের স্ত্রী ঝুমুর সঙ্গে সঙ্গে তির্যক স্বরে বলল, ‘হয়েছে! নিজে গোসল করতে গিয়ে আর বেরুবার নাম নিচ্ছিলে না, আর এখন দোষ অন্যের ঘাড়ে ঢালার চেষ্টা করছ!’
মেয়েদের মধ্যে দুই–একজন বলে উঠল, ‘ঠিক ঠিক! সব সময় আমাদের বদনাম! অথচ নিজেরা সাজগোজ করতে গেলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাগিয়ে দেয়! শেভ করে, লোশন লাগায়, চুলে জেল দেয় কত কিছু!’

‘আর গোসল! গোসলে ঢুকলে তো কথা–ই নেই! আচ্ছা, বিবাহিত পুরুষ একা একা বাথরুমে এত সময় নেয় কেন? ঘটনা কী? হি হি হি।’
তৌসিফ বুঝল নারী জাতির সঙ্গে তর্কে জড়িয়ে লাভ নেই। হার মেনে বলল, পোলাপান কই?

উত্তর দিল মেহরিন, ওপরে, গেম রুমে।
তৌসিফ সিঁড়ি বেয়ে ওপরে চলে গেল। ওর স্ত্রী ঝুমুর মেয়েদের আড্ডায় যোগ দিল।
‘তানিয়া ভাবির ঘটনা কেউ জানো? আল্লাহ! আমি এখনো বিশ্বাস করতে পারছি না!’

৩.
‘কী ব্যাপার? সবাই এত সিরিয়াস কেন?’
‘... টিভি কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে।’
‘কী হয়েছে?’
‘ফ্রিজ হয়ে আছে।’
‘রিস্টার্ট দিয়েছ?’
‘কাজ হচ্ছে না।’
‘আবার দেখি।’

তৌসিফ প্লাগ খুলে ফেলে। দশ সেকেন্ড অপেক্ষা করে তারপরে আবার প্লাগ ইন করবে।

‘বাড়ির এসি কততে নামিয়ে রেখেছ? ঠান্ডায় যে জমে গেলাম! মনে হচ্ছে যেন ফ্রিজের ভেতর বসে আছি!’

‘ঠিক তো! আমি আরও ভাবছিলাম কেবল আমারই বুঝি ঠান্ডা লাগছে!’ মুহিত তৌসিফের কথায় সায় দিল।

ফারহান ভুরু কুঁচকে বলল, ‘বুঝতে পারছি না। মিটার তো পঁয়ষট্টি ডিগ্রি ফারেনহাইটে সেট করা আছে। আসলেই তো, এতটা ঠান্ডা লাগার কোনো কারণ নেই।’
‘মনে হচ্ছে হিটার ছাড়তে হবে।’
‘এই সিজনে হিটার?’
‘জমে যাচ্ছি যে!’

‘দেখি কী করা যায়। আপাতত টিভি ঠিক হোক।’
টিভি চালু করা হয়। সমস্যা কাটেনি। একই দৃশ্যে এসে স্থির হয়ে থাকে টিভি।
‘মনে হয় আজ তোমার বাড়িতে ইলেক্ট্রনিক ডিভাইসের ধর্মঘট চলছে। কোনোটাই ঠিকমতো কাজ করছে না।’

ফারহান মুখ খারাপ করে গালি দেয়। ‘আমি এই কোম্পানিওয়ালাদের স্যু করব!’
রাতিব ভাই বললেন, ‘সেটা পরে দেখা যাবে। আপাতত বিকল্প কোনো উপায় খুঁজতে হবে। অন্য টিভিতে দেখা যাবে?’

বড় শোবার ঘরে একটা টিভি আছে। পঁয়তাল্লিশ ইঞ্চির ছোট স্ক্রিন। জায়ান্ট স্ক্রিনের আয়োজন ও প্রত্যাশা নিয়ে ওই টিভিতে দেখতে হলে মন ভেঙে যাওয়ার কথা। কিন্তু তবু নাই মামার চেয়ে কানা মামা ভালো।

ফারহান বললেন, ‘আমি দেখে আসছি। তাহলে সবাইকে বড় শোবার ঘরে যেতে হবে।’
বিয়ারের দ্বিতীয় বোতল খুলতে খুলতে তুহিন বলল, ‘কোনো সমস্যা নেই। যা করার দ্রুত করো। আর দুই মিনিট আছে হাতে।’

ফারহান চলে গেল। মুহিত ফোনে আপডেট জানতে নিজের মুঠোফোন বের করল। আশ্চর্য! ওর ফোনও হ্যাং হয়ে আছে! টিভিও হ্যাং, মুঠোফোনও হ্যাং! এসিও বিচিত্র আচরণ করছে। কাকতালীয়?

৪.
কলবেল বাজছে। শব্দ শুনে নিতু একটু অবাক হলো। যাদের দাওয়াত দেওয়ার, তারা তো সবাই চলেই এসেছে। এখন আবার কে বেল বাজাচ্ছে? সলিসিটার নয় তো? পেস্ট সার্ভিস, লন সার্ভিস, সোলার ইলেক্ট্রিসিটি সার্ভিস ফেরি করার ধান্দা করছে। সময়–অসময়ে এসে কলবেল বাজিয়ে বলে, ‘আমার নাম অমুক, আমি তমুক কোম্পানির পক্ষ থেকে এসেছি। আচ্ছা, আপনি অমুক সার্ভিসের জন্য কাদের সেবা নিয়ে থাকেন?’

অসহ্য! এবার ‘নো সলিসাইটিং’ স্টিকার দরজায় ঝোলাতেই হবে।
দরজা খুলেই নিতু পাথরের মতন জমে গেল।

সুমি দাঁড়িয়ে আছে। পেছনে ওর স্বামী। বরাবরের মতোই সুমির চেহারা হাসিতে উজ্জ্বল, স্বামীর চেহারা চিন্তামগ্ন।

নিতু তোতলানো স্বরে বলল, ‘ত্তু...ত্তু...’
সুমি উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলল, ‘হাই! দ্যাখ, আজ একদম সময়মতো চলে আসছি! নো কমপ্লেইন!’

নিতু এখনো নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না। বেল শুনে সে যখন উঠে আসছিল, সুমি ওর পাশেই বসা ছিল। সুমিকে সরতে বলেই ও উঠে এসে দরজা খুলেছে। একই সঙ্গে একই ব্যক্তির পক্ষে এভাবে দুই জায়গায় থাকা কীভাবে সম্ভব?

সে আবারও কিছু একটা বলতে চাইল, কিন্তু তোতলানোর কারণে কথা বেরুচ্ছে না।
সুমি বলল, ‘কী হলো? আমাকে কি বাসায় ঢুকতে দেবে না?’

নিতু আর নিজেকে সামলাতে পারল না। ওর মাথা চক্কর দিয়ে উঠল। সুমি তেড়ে এসে না ধরলে বুঝি মেঝেতেই গড়িয়ে পড়ত।
‘কী হয়েছে? নিতু!’

দরজায় আর্তনাদ শুনে লিভিং রুম থেকে অন্য মেয়েরাও ছুটে এল। নিতুকে অজ্ঞান হতে দেখে যতটা না অবাক হলো, তার চেয়ে ঢের বেশি বিস্মিত হলো সুমিকে দরজায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে। এ কী করে সম্ভব! সুমি তো ওদের মধ্যেই......এ কী! সুমি কোথায় গেল?

আগেভাগে যে সুমি এসেছিল, যে ওদের সাথে বসে গল্প, হাসি, ঠাট্টা, তামাশা করছিল, সে হঠাৎ কোথায় হারিয়ে গেল? যেন জাদুর কোনো কৌশল, একজন এক স্থানে গায়েব হলে পরে অন্য স্থান থেকে সে বেরিয়ে আসে।

‘হাঁ করে সবাই দেখছো কী? এদিকে এসে ওকে ধরো! আমি যে পারছি না!’
নিতুকে সামলানো যাচ্ছে না। ওর নিজের কোনো শক্তি নেই। গা ছেড়ে দিয়েছে। সুমির হাত পিছলে মেঝেতে পড়ে যাবে। কিন্তু কেউই এদিকে এগিয়ে আসছে না। সবাই ভীত। সবাই আতঙ্কিত।

ওপরে একযোগে ছেলেদের হুল্লোড়ধ্বনি শোনা গেল। টেলিভিশন যেমন হঠাৎ হ্যাং করেছিল, আবার আপনাআপনি ঠিকও হয়ে গেছে। খেলা তখন শুরু হয়েছে কেবল। মুঠোফোনও কাজ করছে। বাড়ির তাপমাত্রাও স্বাভাবিকে ফিরে এসেছে।

বিস্ময়ের ঘোর কাটতেই নিতুকে ধরে সবাই নিচের বেডরুমের বিছানায় শুইয়ে দিল। সবার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে আছে। কেউ কোনো শব্দ উচ্চারণ করতে পারছে না। সুমি কিছুই বুঝতে পারছে না। ওর ধারণা, নিতুর এই অবস্থা দেখে সবাই এমন করছে।

সে রাতে তাদের সবার জন্য বিস্ময় আরও বাকি ছিল। খেতে গিয়ে দেখে চিকেন উইংসের একটিতেও হাড় নেই। অথচ ওগুলো কেনাই হয়েছিল হাড়সহ। যখন ভাজা হচ্ছিল, তখনও হাড় ছিল। গরম গরম অবস্থায় ফয়েল পেপার দিয়ে মুড়ে ওভেনে রাখার সময়ও হাড় ছিল। অথচ এখন নেই!

গ্রিলে বিফ রিবস স্মোক করা হচ্ছিল। বের করে দেখে সব মাংস পড়ে আছে, ভেতরের হাড়গুলো গায়েব!

কেউ কিছু বলছে না। খেলায় ডালাস ভালো করছে, তবু কারও মন সেদিকে নেই। সবার মন, মানসিকতা ও ব্যক্তিগত বিশ্বাস একটা বিরাট ধাক্কা খেয়েছে। ফিজিকসের প্রতিষ্ঠিত সূত্র এখানে ভুল সমীকরণ দেখাচ্ছে। সেটা কেউই হজম করতে পারছে না।

৫.
ঘটনার পেছনের ঘটনা—
কয়েক মাস আগে, ফারহান তখন বাংলাদেশে বেড়াতে গেছে। সাথে স্ত্রী নিতু। ফারহানের বাবা মারা যাওয়ায় ওর মা সিলেটে ওদের পৈতৃক ভিটায় ওর ছোট মামার পরিবার নিয়ে থাকেন। মামা এর আগে পরিবার নিয়ে গ্রামেই থাকতেন। মামার সংসারে ছয় ছেলেমেয়ে। বিশাল পরিবার। ফারহানদের বাড়িটা পুরোনো দিনের এবং বেশ বড় বলেই এত সদস্যে কোনো সমস্যা হয় না।

দুই সপ্তাহের ছুটিতে দেশে যাওয়া। সারা দিন বাইরে বাইরে ঘুরেই কেটে যায়। ওদের আগমন উপলক্ষে নিতুর ভাইবোনও উঠে এসেছে এ বাড়িতে।

বাড়িতে থাকলে তাই সবাই মিলে অনেক রাত পর্যন্ত আড্ডা হয়। শীতের সময় বলে তখন প্রতিদিনই বিয়ের দাওয়াতে যেতে হচ্ছে। সিলেট প্রবাসী অধ্যুষিত অঞ্চল। সবাই এই শীতের সময়ই বিয়ে করতে যায়। কমিউনিটি সেন্টার ভাড়া পাওয়া গেলে ওই দিন অনুযায়ী তিন কবুল বলে ফেলে। এরই মধ্যে একদিন দেখা গেল, নিতুর একটি সোনার নেকলেস খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। সে আলমারিতে তুলে রেখেছিল, এখন নেই। নিতু খুবই গোছানো স্বভাবের মেয়ে, ওর জিনিসপত্র কখনোই স্থানচ্যুত হয় না। সে যদি বলে, সে আলমারির ওই বিশেষ ড্রয়ারে রেখেছিল, তাহলে সেটা–ই সত্য। এর মানে একটাই, কেউ হারটি সরিয়েছে।

বিরাট বেইজ্জতি। বাড়িতে সবাই আপন আত্মীয়স্বজন। কাজের লোকগুলোও অনেক পুরোনো এবং বিশ্বস্ত। বুয়া, ড্রাইভার কাকা, দারোয়ান ভাই—এরা সবাই ফারহানকে জন্মাতে দেখেছে। সাধারণ বাজার থেকে শুরু করে গ্যাস, ইলেক্ট্রিসিটি বিল এমনকি অনেক সময় মায়ের ব্যাংকের লেনদেনও এদের মাধ্যমেই হয়। এদের কাউকে সন্দেহ করার প্রশ্নই ওঠে না। বাকি থাকে মামা ও তাঁর পরিবার ওবং নিতুর ভাইবোন। অসম্ভব!
ফারহান ঘটনা চেপে যেতে বলে। বলে যে ও রকমই নতুন এক সেট সে বানিয়ে দেবে।

কিন্তু কোনো মেয়ে কি গয়নার শোক কখনো ভুলতে পারে? তা ছাড়া গয়নার দাম তো কেবল টাকার অঙ্কে হিসাব হয় না, কত স্মৃতি জড়িয়ে থাকে! যে নেকলেস হারিয়েছে, সেটা ওর নানুর থেকে মা হয়ে তাঁর হাতে পৌঁছেছে। ফ্যামিলি লিগ্যাসি! নিতু হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে। এতেই বাড়ির সবার মধ্যে জানাজানি হয়ে যায়। পুরো পরিবেশ থমথমে হয়ে ওঠে। কেউ কাউকে অবিশ্বাস করতে পারছে না, আবার ঠিক বিশ্বাসও করতে পারছে না।

ফারহানের মা তখন তাঁর ছোট মামাকে বলেন, ‘ভাইজান, আপনি দেখেন না কিছু করতে পারেন কি না।’

নিতু জানে না ফারহানের মামা কী করতে পারেন। ফারহান বলল, ‘আহ মা, এসব বাদ দাও তো! যত সব ফালতু কুসংস্কার!’

নিতু জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে স্বামীর দিকে তাকায়। ফারহান জবাবে বলে, ‘নাথিং। সব বুলশিট!’
মা তখন পুত্রবধূকে বলেন, ‘ভাইজানের সঙ্গে কিছু কামেল জ্বিন থাকেন। ওনারা যদি কিছু সাহায্য করতে পারেন!’

নিতু সঙ্গে সঙ্গে বলল, ‘অবশ্যই! যেভাবেই হোক, যদি খুঁজে পাওয়া যায়!’
ফারহান বেশ বিরক্ত হয়ে স্ত্রীর দিকে তাকাল। নিতু অনুনয়–বিনয় করতে সে বিরক্ত হয়ে বাড়ির ছাদে উঠে এল। এসব ননসেন্সের মধ্যে সে নেই। তার নিকোটিন প্রয়োজন। স্নায়ু ঠান্ডা করতে হবে।

মামা নামাজের ঘরে একা ঢুকে দরজা–জানালা বন্ধ করে দিলেন।

যখন বেরিয়ে এলেন, ততক্ষণে ফারহানও নেমে এসেছে। মামার মুখ অস্বাভাবিক গম্ভীর। ফারহানের মা সালেহা আক্তার বললেন, ‘কিছু জানতে পারলে?’
মামা ওপর–নিচ মাথা নাড়েন।

নিতু অধৈর্য স্বরে বলল, ‘জেনেছেন কিছু? ওরা বলেছে কোথায় আছে?’
মামা নিতুর ভাই আবিদের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর স্বরে বললেন, ‘তোমার বোনের নেকলেসটা দিয়ে দাও।’

যেন বাড়িতে বজ্রপাত হলো। সবাই চমকে উঠল। আবিদ কিছু বলার আগেই নিতু বিস্ফোরিত স্বরে বলল, ‘এসব কী বলছেন! আমার ভাইকে চোর বলছেন?’

মামা আমতা আমতা করে বললেন, ‘আমি চোর বলছি না। ওনারা বলেছেন, ও গয়না সরিয়েছে।’

আবিদ বিস্মিত স্বরে বলল, ‘আর আপনি এসে আমাকে চোর বলে দিলেন? বাহ! ভাগ্য ভালো, শুধু চোরই বললেন, আরও বড় কিছু বলেননি!’

তারপর নিজের বোনের দিকে ফিরে বলল, ‘এটাই বাকি ছিল আপু! তোমার জন্য এ বাড়িতে এসেছিলাম, এখন চোর হয়ে গেলাম!’
নিতু ঝাঁজালো স্বরে বলল, ‘তুই থাম! আমি বলছি।’

বলেই সে ফারহানের দিকে অগ্নিদৃষ্টিতে তাকাল। কিছু বলার আগেই ফারহান চিৎকার করে উঠল, ‘যথেষ্ট হয়েছে! আমি আগেই বলেছি, এই সব বুলশিট না করতে!’
নিতু কণ্ঠে বিষ ঢেলে বলল, ‘ভালো, বুলশিট যা হওয়ার, এখন তা হয়ে গেছে। তোমার পরিবারের কোনো অধিকার নেই আমার পরিবারকে এভাবে অপমান করার! আমি এর বিচার চাই!’

মামা আবারও আমতা আমতা করে বললেন, ‘আমি অপমান করতে বলিনি। আমি শুধু তা–ই বললাম.....’

ফারহান মামাকে ধমকে উঠল, ‘থামেন মামা! যথেষ্ট হয়েছে! এসব বুজরুকি বাদ দিয়ে নিজের ব্রেনের চিকিৎসা করান। আপনার মানসিক সমস্যা আছে, আর লোকজন আপনাকে পীর–ফকির বানিয়ে দিয়েছে।’

মামা খুবই আহত দৃষ্টিতে তাকালেন ফারহানের দিকে।
মা ধমক দিলেন, ‘খবরদার! ভাইজানকে নিয়ে এমন কথা বলার সাহস তুই পাস কোত্থেকে?’

লেগে গেল তুমুল ঝগড়া! কেউই কাউকে ছাড়তে রাজি নয়। ফল হলো ভয়াবহ। নিতুর ভাইবোন সেদিনই ওই বাড়ি ছেড়ে নিজেদের বাড়িতে গিয়ে উঠল। নিতুও চলে গেল ওদের সাথে। ছোট মামা পরিবারসহ নিজ গ্রামের উদ্দেশে রওনা হয়ে গিয়েছিলেন, ফারহানকেই বহু কষ্টে তাঁদের হাতে–পায়ে ধরে থেকে যেতে রাজি করাতে হয়। বোনের দিকে তাকিয়ে ভাই নিজের ভাগ্নের এই অপরাধ ক্ষমা করেন। যদিও সম্পর্ক আর স্বাভাবিক হয় না। ফারহান মামার দৃষ্টি এড়িয়ে চলে। চোখে চোখ মেলায় না।

নিজের বাড়িতে নিতুর জন্য অবশ্য একটি ধাক্কা অপেক্ষা করছিল। আবিদের ব্যাগের মধ্যে সত্যিই সেই গয়না পাওয়া যায়। নিতুর চেয়েও বিস্মিত আবিদ সঙ্গে সঙ্গে বলে, নিশ্চয়ই ওই ভণ্ড বুড়া নিজের কারসাজি লুকাতে এই কাজ করেছে। নিশ্চয়ই ঐ বুড়া নিজে বা ওর পরিবারের কেউ হারটি চুরি করেছিল। যখন লোকজানাজানি হয়ে যায়, তখন ওকে ফাঁসাতেই এই নাটক সে করেছে।

নিতু নিজের ভাইয়ের কথা বিশ্বাস করে। বিশ্বাস করবে না–ই বা কেন? আট বছরের ছোট ভাইকে সে পুত্রস্নেহে বড় করেছে। এই ভাই কোনো অপরাধ করতে পারে, এটা সে মরে গেলেও বিশ্বাস করবে না।

ফারহানকে ঘটনা জানানো হয়। বলা হয় মামার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে।
ফারহান কোনো প্রতিক্রিয়াই দেখায়নি। সে নিজের শালাকে বিশ্বাস করতে পারে না, আবার মামাকেও অবিশ্বাস করতে পারে না। এ কথা বৌকে বললে ঘরে কেয়ামত নেমে আসবে। এসব নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে বরং হার যে পাওয়া গেছে, এটা নিয়েই সে খুশি হতে বলে।

কিন্তু নিতু এত সহজে মেনে নিলে তো কোনো সমস্যাই ছিল না। ওর বাপের গুষ্ঠিকে হেয় করার উদ্দেশ্যে ওর শ্বশুর গুষ্ঠির এই ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রের উচিত জবাব না দেওয়া পর্যন্ত ওর শান্তি নেই।

ভাগ্য ভালো, তত দিনে তাদের ফেরার সময় হয়ে গেছে।
বাংলাদেশ সফরটি খুবই তিক্ততার সঙ্গে শেষ হয়।

এয়ারপোর্টে যখন সবার থেকে বিদায় নিচ্ছিল, তখন একফাঁকে মামা তাকে সরিয়ে নিয়ে নিচু স্বরে বলেন, ‘আমি জানি তোমার মনে আমাকে নিয়ে সন্দেহ আছে। আমি জানি তুমি ভাবো, আমি অসুস্থ, আমি পাগল, যা বলি সবই আমার কল্পনা। তবে শিগগিরই তুমি এমন এক কাণ্ড দেখবে যে বিশ্বাস করবে আমি মিথ্যা বলিনি।’

ফারহান তখন কিছুই বোঝেনি। মামার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। মামাও চোখের ভাষায় বলেন ধৈর্য ধরতে। সময় এলেই তিনি বোঝাবেন।

‘বুঝলে মঞ্জুর, প্রথম তিন মাস ধরে আমি কিছুই বুঝিনি এবং এরপরই নিজের বাড়ির নিমন্ত্রণে সুমির ঘটনা ঘটল।’

‘মামাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন?’
ফারহান ভাই বললেন, ‘হুম।’
‘উনি কী বললেন?’

একটা নিশ্বাস ফেলে ফারহান ভাই বলেন, ‘কিছুই না। রহস্যময় হাসি হাসেন।’
পরিশিষ্ট: বিষয়টা আরও খতিয়ে দেখতে বাড়িতে ফিট করা সিসিটিভি ফুটেজ পরীক্ষা করতে চেয়েছিল। কিন্তু বলা–ই বাহুল্য, প্রথম সুমি আসার ঠিক আগের মুহূর্তে এসি, টিভি, মুঠোফোন, ফ্রিজ হওয়ার পাশাপাশি ক্যামেরাগুলোও ফ্রিজ হয়ে গিয়েছিল।