নিজের চিন্তা ভাগ্য হয়ে ফিরে আসে

প্রকৃতি মানুষের দাস। এটি আধ্যাত্মিক কথা। এ কথার তাৎপর্য বোঝার জন্য আসলেই সে রকম ক্ষমতা প্রয়োজন। কিন্তু প্রকৃতিকে দাস বানানোর ক্ষমতা সব মানুষের আছে। এ জন্য আমি সেল্ফ টক বা স্ব–আলাপ মানে নিজে নিজেকে বলা কথা নিয়ে খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিষয় উল্লেখ করছি। সাবধানতা অবলম্বনের জন্য হলেও বিষয়টা সবার জানা প্রয়োজন। কিন্তু, দুর্ভাগ্যবশত অতিপ্রয়োজনীয় জ্ঞানের কথা আমরা শিখি জীবনের শেষ প্রান্তে এসে। আগে দাদা–দাদি, নানা–নানি উঠতে–বসতে শেখাতে পারতেন। কিন্তু আধুনিক জামানায় তা দেখা যায় খুব কমই। দাদি–নানিদের সেই সুযোগই নেই। তাঁদেরই শেখানো মিথগুলো বিজ্ঞান, গবেষণা, থেরাপি মানবকল্যাণে নতুন করে উপস্থাপন করছে। তাঁরা বলছেন, ড্রিম মেনিফেস্ট করো। যাঁর অর্থ নিজের চিন্তা–ভাবনাকে ইতিবাচকভাবে রং করো।

মানুষ নিজে নিজেকে যে সব কথা বলে, বিশেষ করে মনে মনে, সে কথাগুলো হলো সেল্ফ টক। অনেক সময় অনেকে সেল্ফ ক্রিটিসিজম বা স্ব–সমালোচনা করেন। যেমন রাগান্বিত হয়ে, ‘কেন মরে যাই না? বেঁচে থেকে কী হবে?’ বা ছেলেমেয়েদের ওপর রাগ করে তাদের প্রতি বিরক্ত হয়ে, ‘এমন সন্তান থাকার চেয়ে না থাকা ভালো। মরে গেলেই ভালো।’—এমন নানা রকম শব্দ, কথা ভেতরে প্রতি মুহূর্তে তৈরি হয়। আপাতদৃষ্টিতে এগুলো রাগের কথা, হয়তো সত্য হিসেবে ধরা হচ্ছে না। কিন্তু আসলে তা কার্যকর হয়ে যাচ্ছে। আমাদের কাছ থেকে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে ছড়িয়ে পড়ে এবং সেখান থেকে আবার আমাদের জীবনে সেগুলো সত্য হয়ে ফিরে আসে।

আমরা নিজেদের নিয়ে নিজেরা কী ধরনের কথা তৈরি করছি, সে ব্যাপারে সতর্ক থাকা উচিত। মন সারা দিন ৬০ থেকে ৭০ হাজার চিন্তা তৈরি করে। সেগুলোও কথা এবং মনে মনে বলা কথাগুলোই সবচেয়ে বেশি বিপজ্জনক। তা সে নিজের জন্য হোক বা অন্যের জন্য হোক। কারণ, সেগুলো নীরবে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে গিয়ে মিশে এবং সেগুলোর ভাইবস আমাদের কাছে ফিরে আসে। বলা যায়, ভাগ্য হয়ে জীবনে ফিরে আসে। এ জন্য বলা হয়, আমরাই আমাদের ভাগ্য লিখি। উল্লেখ্য, বেশির ভাগ স্ব–আলাপ থাকে নেতিবাচক। অন্যের কর্মের চিন্তন। সে কারণেই পরচর্চাকে এত নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে।

মানুষ প্রকৃতির অংশ। সূর্যের ভেতর থেকে সূর্যতাপ, আলো যে রকম একটা শক্তি হয়ে বের হচ্ছে, ঠিক তেমনি মানুষের ভেতর থেকে শক্তি নির্গত হচ্ছে। যখন আমরা কোনো চিন্তা ছাড়াই থাকি, তখন ভালো চিন্তা বা মনের আনন্দ এনার্জি বা শক্তি হিসেবেই বিচ্ছুরিত হয়। এবং তার তাপ সবার আগে নিজের মধ্যে লাগে। তবে বিনা চিন্তায় মনতো থাকে না। কারণ, মনের কাজ হচ্ছে একই সঙ্গে পর পর দুটি প্রশ্ন তৈরি করা। এটা এ রকম হলে ভালো। সঙ্গে সঙ্গে মন আবার পাল্টা প্রশ্ন করছে, যদি ভালো না হয়? এহেন চিন্তার জন্যই সুস্থ চিন্তার অনুশীলন জরুরি। যা মনের খাদ্য, আত্মার খাদ্য।

এ জন্য আমাদের সেল্ফ–টক বা নিজে নিজে কথা বলার ব্যাপারে সচেতন থাকা উচিত। আমরা কি বলছি? কি ভাবছি? বিশ্বব্রহ্মাণ্ড আমাদের আশপাশে যে যেসব জিনিসপত্র আছে, সেগুলো থেকে শুরু করে। আমাদের শব্দের ঢেউ, চিন্তা যত দূর যাবে তাদের স্পর্শ করবে। এবং একসময় তাই আমাদের জীবনে সত্য হয়ে ফিরে আসবে। তাই বলা হয়, আমাদের শব্দই আমাদের নিয়তি তৈরি করে। আমরা ছোটবেলায় শুনে এসেছি, অন্যের মন্দ নিয়ে কথা বলো না। তাহলে নিজের ওপর চলে আসবে। আসলে আমরা যখন অন্যের কথা বা যা কিছু বলি তখন তা আমাদের মন, শরীর গ্রাস করে। সেগুলোই ভাগ্য হয়ে কোনো না কোনো জীবনে ফিরে আসে।

বিশেষ করে আমরা যখন মনে মনে কথা বলি, সেই কথাগুলো আমাদের জীবনে খুব বেশি সত্য হয়ে ওঠে। আমরাই আমাদের ভাগ্য লিখি। সারা দিন যত চিন্তন আমরা তৈরি করি, তা সবার আগে আমাদের নিজেদের স্পর্শ করে। আমাদের চিন্তার গুণগত মান হচ্ছে আমাদের অনুভূতি। তারপর তা নিজের শরীরে যায়। যার জন্য করছি তার কাছে যাচ্ছে, সব শেষে তার ভাইবস পুরো পরিবেশে পড়ে। সে জন্য আমাদের চিন্তা, দেখা, ভাবনায় সতর্ক থাকা উচিত? তার সবকিছুই আমাদের প্রভাবিত করে। তা সে হোক নাটক, হোক সাহিত্য, হোক নিছক কৌতুক। আর সামনে পড়ে গেলেও সে সব থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন রাখতে হবে। তা যেন নিজের ওপর এবং নিজের প্রিয়জনের ওপর প্রভাব না ফেলে। আমাদের চিন্তা স্ব–আলাপের অংশ। এ জন্য স্পিরিচুয়ালিটি বলে আমাদের চিন্তাও আমাদের কর্ম হয়ে উঠে।

যেমন—আমরা নাটকে দেখছি সংসারে অশান্তি। মেয়ের তালাক হয়ে যাচ্ছে। এগুলো একান্ত বিনোদন। কিন্তু অনেকের কাছে তা জীবনের অপরিহার্য অংশ। দিন শেষে ঘুমানোর আগে সেগুলো না দেখলে জীবনের একটা অংশ অপূর্ণ। অনেকের চিন্তা–ভাবনায়, কাজেও তা চলে আসে এবং একটা সময় নিজের পরিবারেও তেমন দৃশ্য দেখা যায়। গণমাধ্যম আমাদের জীবনে অনেক ভূমিকা রাখছে, যা দেখানো হচ্ছে তাই মানুষের জীবনে বেশি হচ্ছে। এখন বলবেন, গণমাধ্যম ঘটনা ঘটে বলে দেখায়। ঘটনা একটা বা দুটি ঘটে। কিন্তু সে সব ভিত্তি করে নাটক–সিনেমা তৈরি হচ্ছে অসংখ্য। আমরা তাই দেখেছি। ভাবছি চেতন–অবচেতন মনে। আগে জীবনে সমস্যা কম ছিল। কারণ মানুষের চিন্তাভাবনায় এত সমস্যার কোনো প্রবেশ ছিল না। রেডিও, টেলিভিশন একটা সীমা পর্যন্ত ছিল। এখন তো সব হাতের মুঠোয়।

মানুষ ঘুমাতে যাওয়ার আগে যা গ্রহণ করছে, তা সারা রাত তার মনে নানা প্রতিক্রিয়া তৈরি করে। যা আত্মার শক্তিকে নামিয়ে ফেলে। আত্মা থাকে বিশ্রামহীন। শরীর ঘুমায়, মন ঘুমায় না। এ জন্য আট ঘণ্টা ঘুমানোর পরও মানুষ বলে ঘুম থেকে উঠতে ইচ্ছে করে না। কারণ, মনের সে পরিমাণ বিশ্রাম হয়নি। সে ক্লান্ত। তা সে আপনার চিন্তার উৎস হোক, কথোপকথন জীবন হোক, নাটক, সিনেমা, সামাজিক মাধ্যমের সমস্যা হোক, দেশের হোক। চিন্তা প্রকৃতিগতভাবে সেই ধারা অনুসারে প্রবাহিত হয়। এক সময় তা আমাদের ভাগ্য হয়ে উঠে।

এ জন্যই আজকাল দেহ–মনকে নিজের আয়ত্তে রাখার এত এত নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি তৈরি হচ্ছে। নিজের চিন্তাভাবনাকে বন্ধ করার কৌশল, মানসিক থেরাপি চালু হয়েছে মনকে শীতল রাখতে। ঘুমাতে যাওয়ার আগে আস্তে আস্তে মনকে স্থিতিশীল অবস্থায় আনতে হয়। ঘুমে মানুষের স্বপ্নের গুণগত মান হচ্ছে তার চিন্তা ভাবনার প্রতিফলন। মনে মনে সেল্ফ–টক চলতে চলতে এক সময় তা এমন পর্যায়ে যায়, অনেকে ঘুমের মধ্যেও কথা বলেন।