নিজের একটি কামরা চাই

সিঙ্গেল মাদার হিসেবে সন্তানদের বড় করেছেন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী ফারজাহান রহমান। শুধু নিজেকে নয়, প্রতিষ্ঠিত করেছেন সন্তানদেরও

‘নারী যখন ফিকশন লেখে, তখন তার একটি কক্ষ আর কিছু নগদ অর্থ খুব প্রয়োজন’—কথাগুলো বলেছিলেন ভার্জিনিয়া উলফ।

ঊনিশ শতকের অত্যন্ত আধুনিক ও নারীবাদী ব্রিটিশ লেখক ভার্জিনিয়া উলফ, যিনি আজও আমাকে সম্মোহিত করেন, জাগিয়ে তোলেন। তাঁর লেখনী, ভাবনার জগৎ আমাকে আন্দোলিত, অভিভূত করে। ২০২১ সালের একটি বিশেষ সময়ে এসে, যখন নারী স্বাধীনতা আন্দোলন দৃশ্যমান একটি জায়গায় এসে স্থির হয়ে দাঁড়িয়েছে, এখনো ভার্জিনিয়ার এই কথাগুলোর মূল্য অপরিসীম ও সমান আবেদনময়।

‘নারীরা শেক্সপিয়ার লিখতে পারে না’—এই আপ্তবাক্যটির তাৎপর্য ব্যাখ্যা করতে গিয়ে লেখক প্রশ্ন তুলেছিলেন, ‘শিল্প, সাহিত্য, উপন্যাসে কেন নারীরা পুরুষের তুলনায় পিছিয়ে?’ এর যুক্তিসংগত উত্তরটি তিনি নিজেই দিয়েছিলেন—‘নারীদের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা নেই। সামাজিক বিধি-নিষেধ উপেক্ষা করে টিকে থাকার পরিবেশ নেই। এমনকি তার একান্ত নিজের একটি কামরাও নেই। যেখানে সে নিজের মতো করে সাহিত্য রচনা করতে পারে। যদি নিজস্ব একটি কামরা এবং ৫০০ পাউন্ডের নিশ্চয়তা দেওয়া হয়, নারীরাও অনেক উন্নতমানের সাহিত্য উপহার দিত।’

ভার্জিনিয়া যুক্তি দিয়ে দেখিয়েছেন, জর্জ ইলিয়ট, জেইন অস্টিন, ব্রন্টি, মেরি কারমাইকেলের মতো প্রতিভাবান লেখকেরা শেক্সপিয়ারের মতো বিখ্যাত হতে পারেনি কেবল পুরুষতান্ত্রিক সমাজের সামাজিক ও অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতার কারণে। তার এই নারী স্বাধীনতা বিষয়ক ভাবনাগুলো তিনি জড় করেছেন ‘অ্যা রুম অফ ওয়ান্স ওউন’ (নিজের একটি কামরা) গ্রন্থে। এক শ বছর আগের এক নারী তার একান্ত নিজস্ব একটি কামরার জন্য আক্ষেপ করেছিলেন। এই একবিংশ শতকের নারীদের মনেও ‘নিজের একটি কামরা’র আক্ষেপ সে যুগের ভার্জিনিয়ার তুলনায় কোনো অংশে কম নয়।

ভার্জিনিয়া উলফের মতোই নিজের চারপাশের নারীদের দিকে তাকিয়ে দেখলে একটা অনুভূতি এসে চেপে ধরে। আমরা পৃথিবীর পথে বহুদূর হেঁটে এসেছি। সভ্যতার, বিজ্ঞানের চূড়ান্ত অগ্রগতি লাভ করেছি। কিন্তু আমরা নারীরা কত দূর এগিয়েছি? আজও পুরুষের সমকক্ষ হওয়ার জন্য, পাশাপাশি, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করার জন্য, জীবনকে উপভোগ করার জন্য নারীকে লড়াই করেই যেতে হচ্ছে।

সম্প্রতি ‘মি টাইম’ বলে একটি কথা খুব চালু হয়েছে। নিজস্ব একটি কামরার আক্ষেপের মতোই ‘মি টাইম’–এর আক্ষেপও একবিংশ শতকের নারীদের মধ্য প্রবলতর হয়ে উঠেছে। অনেকেই হয়তো ভ্রুকুঞ্চিত করে বলবেন, ‘এটা কেমন কথা? একান্ত নিজের জন্য কিছু সময় চাই? একটু বেশি বেশি হয়ে যাচ্ছে না? সংসার, আপনজন, কাজকর্ম সব পেছনে ফেলে স্রেফ ‘মি টাইম’? কথাটা যেন নিষিদ্ধ ফলের মতো। ঝোড়ো হাওয়ার মতো। ভীষণ বেয়াড়া কিছু।

কট্টর সংসারী, হিসাবি মানুষেরা এই আবদারে একটা ধাক্কা খাবেন। নড়েচড়ে বসে বলবেন, এবার একটু ঝেড়ে কাশো তো ভাই। কী হয়েছে বল? সংসারে বিরক্তি এসে গেছে? কাছের মানুষদের আর ভালো লাগছে না?’ অথবা আড়ালে–আবডালে বলা শুরু করবেন, ‘মেয়েটা উচ্ছন্নে যাচ্ছে। একদম স্বার্থপর হয়ে গেছে। নিজেকে ছাড়া আজকাল আর কিছুই বোঝে না।’

সাংসারিক বা দাপ্তরিক ধরাবাঁধা কাজের বাইরে, দায়িত্ব ও কর্তব্যের বাইরে, কিছুটা সময় একান্ত নিজের মতো করে কাটানোকে ‘মি টাইম’ বলা যায়। সেটা হতে পারে নিজের শারীরিক ও মানসিক যত্ন নেওয়া। ব্যায়াম, ইয়োগা, সাঁতার বা হাঁটাহাঁটি করা। হতে পারে, রূপচর্চা, ত্বকচর্চা, চুলের যত্ন, হাত পায়ের নখের যত্ন, ম্যাসাজ নেওয়া। নিজের জন্য নিজের পছন্দমতো, স্বাস্থ্য-সম্মত কিছু খাবার তৈরি করা, খাওয়া।

মানসিক শান্তির জন্য প্রয়োজন একটি খোলা আকাশ। ‘নীড় ছোট ক্ষতি নেই, আকাশতো বড়।’ একটু নিরিবিলিতে কিছুক্ষণ শান্ত হয়ে বসা। ঘরের বারান্দায়, ছাদে, পার্কে বা নদীর তীরে গিয়ে খোলা আকাশ, গাছপালা বা জলাশয়ের দিকে তাকিয়ে থাকা। এ যেন নিজেকে খোঁজা। এই আকাশ হতে পারে নারীর ভাবনা জগতের আকাশ। মুক্ত পাখির মতো উড়ে বেড়ানোর আকাশ।

নিজের কামরায়, নিজস্ব লেখার টেবিলে বসে মনের কিছু কথা লেখা। পছন্দের একটি গান শোনা বা বই পড়া, অনেক নারীর কাছে এখনো স্বপ্ন। নিজের ক্যারিয়ার, সংসার ও সামাজিক দায়দায়িত্ব সামাল দিয়ে, লেখালেখির মতো একটি উচ্চাভিলাষি কাজে যেসব নারী যুক্ত হতে চায়, তারা আজও ভার্জিনিয়ার মতো করেই একান্ত নিজস্ব একটি কামরার অভাব অনুভব করেন।

মেডিসন স্কয়ার পার্কে ঘুরে বেড়ানো তরুণ–তরুণীদের দিকে তাকিয়ে মনে মনে ভাবি, আহা, আমিও একদিন এমন তরুণী ছিলাম। বিধিনিষেধ মানতে মানতে, একসময় দেখলাম, কোথায় আমার সেই তারুণ্য? আবিষ্কার করলাম মধ্যবয়সী এক নারীকে। কত কী দেখা হলো না, কত কী জানা হলো না। অথচ জীবনের প্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছি। চলে যেতে হবে যেকোনো সময়। ভেবে কষ্ট হয়, কেবল নিরাপদ ভেবেই এমন বাক্সবন্দী একটা জীবন কাটিয়ে দিলাম?

তাই বলে স্বার্থপরের মতো একা নয়। প্রতিটি নারীই চায়, পরিবার, বন্ধু সবাইকে নিয়ে সুন্দরভাবে বাঁচতে। শুধু প্রয়োজন একজন মানুষ হিসেবে প্রাপ্যসম্মান, ভালোবাসা, সহানুভূতি আর উদারতা। একজনের প্রতি আরেকজনের। একটা মানুষের প্রতি আরেকটা মানুষের। নারীর প্রতি নরের।

জীবন বড় ক্ষণস্থায়ী। প্রতিটি মানুষেরই সমান অধিকার আছে, তাকে সমানভাবে উপভোগ করার। এটা জন্মগত অধিকার। যদিও এ অধিকার হাত পেতে চাওয়ার কিছু নেই! তবুও আমরা নারীরা যুগ যুগ ধরে সমাজের কাছে, সংসারের কাছে তাই চেয়ে আসছি।

প্রতি বছর বিশ্ব নারী দিবসকে উপলক্ষ করে আম্পায়ার স্টেট বিল্ডিংটা মিষ্টি গোলাপি রঙে সাজে। টাওয়ারের এই জমকালো সাজ দেখলে মন আনন্দে ভরে যায়। বাহ! কী দারুণ মিতালি। আমি নারী বলে, নারী হিসেবে আমাদের অর্জনকে শ্রদ্ধা জানানোর জন্য এই আয়োজন। এ কারণেই আমি নিউইয়র্ককে এত ভালোবাসি! এই শহর আমাকে স্বাধীনভাবে বাঁচতে শিখিয়েছে। জীবনকে ভালোবাসতে শিখিয়েছে। বেঁচে থাকার আনন্দ উপভোগ করতে শিখিয়েছে। প্রতিটি দিন আমার কাছে একটি নতুন দিন। প্রতিটি সকাল নতুন সকাল। ঘুম ভেঙে মনে মনে ভাবি, আহা, আমি আজও নিশ্বাস নিচ্ছি। আজও আকাশ দেখছি। সূর্য দেখছি। লেটস্ সেলিব্রেট ইট!

প্রতিদিন ইয়োগার পর চমৎকার একটি গোসল শেষ করে যখন স্টুডিওর বাইরে আসি, আমি বুক ভরে নিশ্বাস নেই। সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার আনন্দে মন খুশিতে ভরে যায়।

প্রতিদিনই চোখ রাখি আম্পায়ার স্টেটের টাওয়ারের চূড়ায়। বড় ভালো লাগে সন্ধ্যার মনোরম আলোতে নিত্যনতুন রং আর সাজ বদল দেখতে। একঘেয়েমি থেকে কী চমৎকার মুক্তি। যদিও আজকের সাজ নারী অধিকার আর নারীমুক্তিকে অভিবাদন জানিয়ে। কিন্তু শুধু গোলাপিতেই আমি খুশি নই, মুগ্ধ নই। গোলাপিতেই আমি শান্তির নিশ্বাস ছাড়তে রাজি নই। সমান অধিকারের দাবি জানিয়ে কারও কাছে হাত পাততে রাজি নই। এ আমার জন্মগত অধিকার, যা ছিনতাই হয়েছে যুগ যুগ ধরে!

মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকতে চাই। মানুষ হিসেবে পৃথিবীর সবগুলো রং উপভোগ করতে চাই। তাই সবুজ, কালো, লাল, হলুদ, কমলা, নীল আর সাদা—সব রংই হোক আমার রং। ৩৬৫ দিনের প্রতিটি দিন আমি আমার মতো করে, আমার নিজের মতো করে পেতে চাই। নিজের মতো করে বাঁচতে চাই। কারও বরাদ্দ করা সময়, মাপা পথ, মাপা কথা, নিষেধের বেড়াজাল আমি চাই না।

সেই অধিকার নেই বলে মন খারাপ করে, কষ্ট বুকে চেপে জীবন পার করা যায়, বেঁচেও থাকা যায়। তবে, সে জীবন শুধুই খাঁচার পাখির মতো। থাকা, খাওয়া, নিরাপত্তা সবই আছে। শুধু মনিবের মন জোগাতে গাইতে হবে। তাকে আনন্দ দিতে লাফঝাঁপ দিতে হবে। নইলে লাঠির খোঁচা খেতে হবে!

কিন্তু মুক্ত আকাশের মুক্তজীবন চাইলে ডানা শক্ত করে ওড়া শিখতে হবে। মুক্ত আকাশে বুক ভরে নিশ্বাস নেওয়ার যে আনন্দ, সেই আনন্দই বলে দেবে আমি বেঁচে আছি! মানুষ হিসেবে বেঁচে আছি!