মানুষের জীবন এক অনিশ্চিত যাত্রাপথ। পৃথিবীতে প্রতিমুহূর্তে লড়াই করে বেঁচে থাকতে হয় তাকে। পরিবার-পরিজন পাশে থাকলে এই লড়াইয়ে কখনো কখনো স্বজনদের সহযোদ্ধা হিসেবে পাওয়া যায়। কিন্তু জীবিকার তাগিদে যারা প্রবাসজীবনকে বেছে নিয়েছেন, তাঁদের অনেকেরই ভাগ্যে সব সময় প্রিয়জনের সান্নিধ্য মেলে না। বিপরীতে মেলে প্রবাসের হাজারো সংকট। তাঁদের কেউ কেউ বিদেশ বিভুঁইয়ের বহুবিধ সংকটের মুখে একটু নিষ্কৃতির আশায় আশ্রয় খোঁজেন মাদকে। কেউ আবার বাড়তি আয়ের আশায় বেশি পরিশ্রমের জন্য শরীরকে উদ্দীপ্ত রাখতে মাদককে দাওয়াই হিসেবে নেন। কিন্তু মাদকের ক্ষমতা নেই এই দুইয়ের কোনোটিই দেওয়ার। বরং জীবনকে এক গভীর ধাঁধার আবর্তে ফেলে তাকে কুরে কুরে খাওয়ার এক সীমাহীন ক্ষমতা রয়েছে মাদকের।
আশা ও উচ্চাকাঙ্ক্ষার শত্রু জেনেও অনেকেই পা দেন মাদকের চেনা ফাঁদে। আমেরিকার বাংলাদেশি কমিউনিটির অনেকেই এই ফাঁদে পা দিয়েছেন এরই মধ্যে। ‘আশার ছলনে’ ভুলে তাঁরা পা দিয়েছেন এই নিরাশার বৃত্তে। নিউইয়র্কের বাংলাদেশি কমিউনিটিতে মাদকের প্রকোপ দিন দিন বাড়ছে। বাংলাদেশের মতো সেখানেও পিছু ধাওয়া করে গেছে ইয়াবা ও ফেনসিডিল। সেখানকার বাংলাদেশি যুবসমাজের একটি অংশ এরই মধ্যে এই ভয়াবহ নেশায় আসক্ত। এই ভয়াবহ মাদক ছড়িয়ে পড়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডাসহ অন্য অঙ্গরাজ্যগুলোর বাংলাদেশি কমিউনিটিতেও।
অনেক বাংলাদেশিই বেশি আয়ের আশায় দীর্ঘ সময় কাজ করতে শরীরকে উদ্দীপ্ত রাখার জন্য বলবর্ধক হিসেবে ইয়াবা সেবন করেন বলে অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে। সাপ্তাহিক ছুটির দিনে অনেকে ১০টি করে ইয়াবা সেবন করেন বলেও জানিয়েছেন। বিশেষত যাঁরা ট্যাক্সি চালনার কাজে নিয়োজিত, তাঁদের মধ্যে এই মাদক গ্রহণের হার বেশি। দেখা গেছে, দিনে ১০টি ইয়াবা সেবন করে হয়তো তিনি দেড়-দুই শ ডলার বেশি আয় করছেন। কিন্তু প্রতি পিস ইয়াবার দাম ১৫ ডলার হিসেবে তাঁর পকেট থেকে চলে যাচ্ছে দেড় শ ডলার। অর্থাৎ আয়-ব্যয় প্রায় সমান। বাড়তি হিসেবে শারীরিক ও মানসিক ক্ষতিটি হচ্ছে সেবনকারীরই। সঙ্গে রয়েছে আসক্তি, যা এমনকি কাজের চাপ ছাড়াই তাঁকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে ইয়াবা সেবনের দিকে। একই কথা খাটে ফেনসিডিলের ক্ষেত্রেও।
নিউইয়র্কসহ যুক্তরাষ্ট্রে বিভিন্ন অঞ্চলে ইয়াবা ও ফেনসিডিল সরবরাহের সঙ্গে বাংলাদেশিরাই জড়িত। বাংলাদেশ থেকে মসুরের ডাল কিংবা এ ধরনের বিভিন্ন পণ্যের সঙ্গে অভিনব উপায়ে এসব মাদক যুক্তরাষ্ট্রে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর তা গ্রাহকদের হাত পর্যন্ত পৌঁছানোর কাজেও বাংলাদেশিদের জোর উপস্থিতি রয়েছে। নিউইয়র্কের বেশ কিছু স্থানে প্রকাশ্যে এসব মাদক বিক্রি হয়, যা রীতিমতো আশঙ্কাজনক। এটি প্রবাসে থাকা আমাদের যুবসমাজকে নিয়ে যেমন শঙ্কিত করে, তেমনি প্রবাসে বাংলাদেশের ভাবমূর্তিকেও শঙ্কায় ফেলে দেয়।
এ অবস্থায় সামাজিক প্রতিরোধ ও ব্যাপক সচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনা ছাড়া কোনো গত্যন্তর নেই। মানুষকে বোঝাতে হবে, একটি বা দুটি ইয়াবা সেবন হয়তো কিছু সময়ের জন্য স্নায়বিক উদ্দীপনা দিতে পারে, কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে তা প্রাণশক্তিই কেড়ে নেয়। দীর্ঘ মেয়াদে এ ধরনের মাদক শরীরের কর্মক্ষমতাই নষ্ট করে দেয়। এ কথাটি বোঝাতে হবে প্রবাসে থাকা বাংলাদেশি যুবকদের। সামাজিক বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে অন্তর্ভুক্ত করে তাঁদের পারিবারিক আবহ দিতে হবে, যাতে তাঁরা নিজেদের কখনো নিঃসঙ্গ মনে না করেন। মনে রাখতে হবে নিউইয়র্কে ইয়াবার মতো মাদকের প্রসারের পেছনে বাংলাদেশিদের নামই উঠে এসেছে, যার ভুক্তভোগীও বাংলাদেশিরাই। তাই এর বিরুদ্ধে জোরালো ভূমিকা রাখার মূল দায়িত্বটি বর্তায় বাংলাদেশি কমিউনিটির ওপরই। কারণ এর সঙ্গে বাংলাদেশের সুনামের বিষয়টিও জড়িত।