বন্যেরা বনে সুন্দর শিশুরা মাতৃক্রোড়ে—সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের এই উক্তিটির সাদামাটা অর্থ হলো কোনো শিশু হারিয়ে গেলে তাকে উদ্ধার করে তার মায়ের কাছে দিতে হবে। বন্য প্রাণী লোকালয়ে এসে পড়লে তাকে আটক করে বনে ছেড়ে দিয়ে আসতে হবে।
কিন্তু সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের উক্তিটি বইয়ের পাতাতেই থেকে গেছে। বাস্তবতা হলো, কোনো বন্য প্রাণী পথ ভুলে কিংবা খাবারের লোভে লোকালয়ে এসে পড়লে তাকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়, অথবা পিটিয়ে অর্ধমৃত করে চিড়িয়াখানা নামের বন্দিশালায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়। আর শিশুরা হারিয়ে গেলে কী ঘটে? সহজ উত্তর হলো, কোনো ভালো মানুষের হাতে পড়লে তিনি শিশুটিকে তার মায়ের কোলে ফিরিয়ে দেবেন। আর ছেলেধরার হাতে পড়লে শিশুটির পরিণতি কী হবে সেটার উত্তর সবার জানা। তবে সম্প্রতি নিউইয়র্ক থেকে আরও একটি তথ্য পাওয়া গেছে। সেখানে পুলিশ নাকি আশ্রয়হীন শিশুদের আটক করে হাতকড়া পরিয়ে নিজেদের হেফাজতে নিয়ে যায়। নিউইয়র্কের মেয়রের অফিস পুলিশের এই কাজে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে।
গণমাধ্যমের তথ্যানুযায়ী, স্কুলপড়ুয়া বা মধ্যবিত্ত পরিবারের শিশুরা মাদকসহ ধরা পড়লে পুলিশ তাদের অভিভাবক অথবা স্কুল কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠিয়ে দেয়। আর যেসব শিশু আশ্রয়কেন্দ্রে থাকে অথবা যাদের কোনো অভিভাবক নেই, তারা ধরা পড়লে হাতকড়া পরিয়ে হাজতে নিয়ে যাওয়া হয়। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার এ ধরনের আচরণ নিঃসন্দেহে বৈষম্যমূলক।
টিমাস্টারস লোকাল ২৩৭ নামের একটি প্রতিষ্ঠান বৈষম্যমূলক এ আচরণ বন্ধের দাবি জানিয়েছে। কারণ, পুলিশের এই কাজটি আন্তর্জাতিক শিশু অধিকার সনদের পরিপন্থী। ১৯৮৯ সালে গৃহীত শিশু অধিকার সনদ বর্তমানে আন্তর্জাতিক আইনের অংশ। এই সনদে বলা আছে—পারিবারিক পরিবেশ থেকে যে শিশু সাময়িক বা চিরতরে বঞ্চিত অথবা যে পরিবারের পরিবেশ শিশুর স্বার্থ রক্ষার উপযুক্ত নয়, সেই সব শিশু রাষ্ট্র থেকে বিশেষ সুরক্ষা ও সহায়তার অধিকারী হবে। রাষ্ট্র তার নিজস্ব আইন অনুযায়ী এসব শিশুর তত্ত্বাবধানের জন্য বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণ করবে৷ সরকারি ও বেসরকারি সমাজকল্যাণ প্রতিষ্ঠান, আদালত, প্রশাসন বা আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাকে যেকোনো কাজে শিশুর স্বার্থকে প্রাধান্য দিতে হবে।
সনদের এই অংশটুকু পড়ার পর বলা যায়, নিউইয়র্কের পুলিশ আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে চলেছে। সে ক্ষেত্রে এ বিষয়ে তাদের ধারণা দিতে কর্মশালার আয়োজন করা যেতে পারে।
অন্যদিকে প্রশাসনকে সচেতন করার কিছু নেই। কারণ, জেনেবুঝেই শিশুদের ওপর নিপীড়নমূলক এই আচরণকে সমর্থন করছে। তাই পুলিশ ও প্রশাসনের বৈষম্যমূলক এই আচরণের বিরুদ্ধে সবাইকে সোচ্চার হতে হবে। প্রতিবাদ হতে হবে ব্যক্তি থেকে সমষ্টি, সব পর্যায় থেকেও। কারণ, আন্তর্জাতিক আইনে বলা আছে, শিশুর অধিকার রক্ষার দায়িত্ব রাষ্ট্রের একার নয়, ব্যক্তি-পরিবার আর সমাজের ওপরও একই দায়িত্ব বর্তায়।