নারী বরণ

একই অফিসে চাকরি করে রফিক সাহেব আর বশীর সাহেব। দুজনে ট্রেনে করে কাজের শেষে বাড়ি ফিরে একসঙ্গে। রাগান্বিত শফিক সাহেব।

–রাস্তা বন্ধ করে কি চলছে এখানে? আজ ঘুরে যেতে হচ্ছে, এত মানুষের কিসের ভিড়?

–ওহ, আজ ৮ মার্চ, বুঝলেন নারী দিবসের সভা চলছে। এ জন্য চারিদিক এত অশান্তি। এত স্বামী–স্ত্রীতে ছাড়া–ছাড়ি। নারী অধিকারের নামে সব নারীকে করছে বিপদগামী। এখন এসবের কারণে কেউ কাউকে মানতে চায় না। আরে বাবা, আগের দিনে আমাদের মা–খালারা কি এসব করত? বলেন তো বশির সাহেব? তারা কেন এত সুখী ছিল। কোনো অভিযোগ তাদের ছিল না পুরুষদের বিরুদ্ধে। তারা রান্না করত, বাচ্চা দেখত। এই ছিল তাদের কাজ। স্বামী চালাত সংসার। আর এখন চারদিকে নারীদের বিচরণ। সবকিছুতে সব জায়গায় তাদের কথা বলা চাই। আরে মেয়ে মানুষদের এত কথা বলতে আছে? তারা কিছু বুঝে? তাদের কি পুরুষের মতো শক্তি আছে? তাদের অধীনে এখন পুরুষদের কাজ করতে হয়। পুরুষ আর মহিলা সমান কি করে হয়? এখন দেখছি, দুই চোখ বন্ধ রাখতে হবে এসব না দেখার জন্য।

–শফিক সাহেব, ঠিক বলেছেন।

কাজ থেকে বাড়ি ফেরার পথে নারী দিবসের সভা দেখে দুজনের মধ্যে এমন প্রতিক্রিয়া যেন নারী দিবস একটা জুলুম হিসেবে সামনে আসছে নারীবাদী পুরুষের জন্য। ঘরে ফিরে স্ত্রীর সঙ্গে অযথা রাগ দেখানো শফিক সাহেবের যেন পুরুষত্ব দেখানোর প্রতিদিনের একটা কাজ। কথায় কথায় বলে, তুমি মেয়ে মানুষ, কিছু বুঝবে না। নিজের স্ত্রী রুনীকে বুদ্ধিহীন ভাবতে পারাই যেন শফিক সাহেবের স্বস্তি। ছুড়ে ছুড়ে প্যান্ট আর শার্ট বিছানায় রাখছে। পুরুষ হয়ে যেন রাজ্য উদ্ধার করে এসেছে। শফিক সাহেবের স্ত্রী রুনী প্রতিদিনের মতো দৌড়ে এসে বলছে, চা বানিয়ে আনছি। না, আমার খিদে পেয়েছে পারলে অন্য কিছু করে দাও।

রুনী বলে, তুমি তো বিকেলে সাধারণত কিছু খাও না। তা ছাড়া খেলে রাতে কিছু খেতে চাও না। আর এক ঘণ্টা পরেই তো রাতের খাবার খাবে। তাই তোমার জন্য কিছু তৈরি করিনি আজ।

–আচ্ছা বলো, তো কি করো সারাটা দিন? ঘরে থেকে খাও আর বসে বসে টিভি দেখো। এখন তো আবার নারী দিবস চারদিকে। এসবের কারণে এখন আর স্বামীর দিকে কোনো নজর নেই। এসব সভা–সমিতি ঘরের বউদের নষ্ট করে ফেলছে। যাও কিছু লাগবে না। আমাকে একা থাকতে দাও বলে ফোনটা নিয়ে টোকাটুকি করছে।

রুনী বলে, তুমি আমি তো সারা দিন একা একাই ছিলাম। এতক্ষণ পর তুমি ঘরে এলে, এসেই বলছ চোখের সামনে থেকে চলে যেতে। অন্য ঘরে চলে গিয়ে কান্না ধরে রাখতে পারে না রুনী।

বাবা শিক্ষিত ছেলে দেখে বিয়ে দিয়েছিল। শিক্ষিত ছেলে হলেই মানুষ হয় না। এ কোন ধরনের আচরণ। দরজায় কড়া নেড়ে বাড়ির কাজের মেয়ে এসে বলে, আপা রাতের জন্য খাবার সবকিছু রান্না হইয়া গেছে। ভাই সাব খাবে না? টেবিলে খাবার দিমু? রুনী একটু চুপ করে উত্তর দেয়, না এখন দিস না। তুই চলে যা। আমি পরে টেবিলে খাবার সাজিয়ে দিব। ভাই এখন খাবে না, খিদে নাই।

কাজের মেয়ে দেখে বলে, আফা কিছু মনে করবেন না, আমি সব শুনছি। আমার স্বামী আমারে মারে, খাবার দেয় না। নেশা করে। জুয়া খেলে। জুয়ায় হারিয়ে আমারে মারে টাকার লাইগা। হে পুরুষ মানুষ, আমি মাইয়া মানুষ সব সহ্য করি। আপনাগো বাসায় যা পাইতা, ওর লাইগ্যা নিয়ে যাই। তা খাইয়া আমারে আবার রাগ উঠলে অনেক মারে।

–আমার সুন্দর মুখটা দেহেন, ওহন ওর মাইরের দাগ খালি। কিছু প্রতিবাদ করতে পারি না আফা। আমরা গরিব আমাগো সইয়া গেছে। আমাগো মতো গরিব মাইয়া গো বিয়ার পর যাওয়ার জায়গা নাই, তাই পইরা পইরা মাইর খাই। আপনি তো বড়লোকের মাইয়া। ভাই, আপনার লগে কথায় কথায় প্রতিদিন এমন ব্যবহার করে, তবুও কেমতে সহ্য করেন! আজ নিজে বাজার কইরা ভাইয়ার পছন্দের কত কিছু কিইন্যা আনছেন! কত যত্ন কইরা রান্না করছেন ভাইয়ার জন্য। কত খুশি আছেলেন সারা দিন। আমাগো মাইয়াগো জীবন বড়ই কষ্টের।

–যা, তুই বেশি কথা বলিস না। যাওয়ার আগে বাটিতে কিছু খাবার নিয়ে যা।

–আইচ্ছা আফা।

রাতে খেতে বসে শফিক সাহেব আর রুনী। আজ তোমার সর্ষের ইলিশ খুব মজা হয়েছে। আচ্ছা, এই সপ্তাহে আমি তো ইলিশ মাছ আনি নাই। এই মাছ কোথা থেকে আসল?

–কেন আমি বাজার করতে পারি না।

আমি আজ বাজারে গিয়েছিলাম। তুমি বাজারে গিয়েছিলে নিশ্চয়ই মাছের দাম বেশি রেখেছে। তুমি তো মেয়ে মানুষ, তোমাকে নিশ্চয়ই ঠেকিয়ে দিয়েছে।

–কেন ঠকাবে? আমি যদি সংসার চালাতে পারি, বাজারের কিছু মানুষের সঙ্গে কথা বলার ক্ষমতা নাই?

ও যাকগে, তবে খুব মজা করে খেলাম অনেক দিন পর। মাছটা একদম ফ্রেশ।

বারবার ঘুম থেকে ডেকেও শফিক সাহেবকে রুনী সময় মতো ওঠাতে পারে না। মহিলা বস, তাই কাজে সময় মতো যাওয়ার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে।

পরের দিন শফিক সাহেব অফিসে যাওয়ার সময় চিৎকার, এখনো চা তৈরি করা হয় নাই। প্রতিদিন দেরি হয় তোমার কারণে। আবার অফিসের বস তো তোমার মতো মেয়ে মানুষ। বুদ্ধি কম, রাগ বেশি। মেজাজ খারাপ লাগে, মেয়ে মানুষের অধীনে কাজ করতে হয়। এমডি স্যার যে কি করে না। এই অফিসে কেন যে এই মহিলাকে জিএম করে এনেছে। এমডি স্যার কোনো দিন দোষ ধরে নাই আমার, মহিলা হয়ে আমার দোষ ধরে! আমি নাকি কাজে মন দিই না। গল্প করি। দেরি করে অফিসে যাই। ধ্যাত, অফিসে যেতে ইচ্ছা করে না।

রুনী সব শুনেও চুপ করে আছে।

–কী হলো, তুমি কেন কথা বলো না।

রুনী বলল, তুমি যেভাবে মেয়েদের ছোট করে দেখো, আসলে কি মেয়েরা এত ছোট?

শফিক সাহেব বলে, মেয়েদের মাথায় কোনো বুদ্ধি আছে নাকি। মেয়েরা ছ্যাচ কাঁদুনি, কথায় কথায় নাকে কান্না।

রুনী বলল, দেখো এমন কথা কেন বলো। তোমার বস মেয়ে মানুষ। তার যদি যোগ্যতা না থাকত, তাকে কীভাবে এত বড় দায়িত্ব দেয় এমডি?

–সেটাই তো সমস্যা নারীর হুকুম আমাকে পালন করতে হচ্ছে। আমি একজন পুরুষ। রুনী বলল, শুনো তুমি তোমার বসকে মেয়ে নয়, একজন মানুষ হিসেবে ভাবো। দেখবে, সব ঠিক হয়ে গেছে। আর এখন থেকে ফোনে কথা বলে দেরি করে উঠবে না। সময় মতো কাজে যাবে, দেরি করবে না আর। আমি তোমার সব কিছু সময় মতো তৈরি করে দেব।

অফিসে গিয়ে বশির সাহেবের সঙ্গে মিলে মহিলা বসকে নিয়ে আর শফিক সাহেব সমালোচনা করে না। মহিলা হয়ে এত বড় পদের চাকরি কীভাবে হয়েছে, ডাল মে কুচ কালা হ্যায়—এ ধরনের আলাপ আর আসে না। প্রতি দিন শফিক সাহেব সকালে উঠে সময় মতো কাজে গিয়ে মনযোগ দিয়ে কাজ করে কাজ শেষ করে। প্রায় দুই/তিন মাস পর শফিক সাহেবের পদোন্নতির জন্য মহিলা বস তাকে রুম ডেকে এনে বলে, ‘আপনি এই তিন মাস সময় মতো কাজে এসেছেন। অফিসে সব কাজ সুন্দরভাবে শেষ করেছেন। আমার রিপোর্টে এমডি স্যার খুব খুশি। আপনাকে প্রমোশন দিয়েছে। আপনার বেতন দুই গুন হয়েছে।’

শফিক সাহেব বুঝতে পারে, কত ভুল সে এত দিন করেছে শুধু নিজেকে পুরুষ ভেবে। আজই বাসায় গিয়ে রুনীর কাছে ক্ষমা চাইবে, কত ছোট করে ওঁকে দেখেছি। আজ রুনীর কথা মতো কাজ করেছি বলেই আমার প্রমোশন হয়েছে। এত খারাপ ব্যবহার করার পরও ওর কত অনুপ্রেরণা আমার জন্য ছিল, আমার পাশে থেকে।

বশির সাহেবের স্ত্রী স্কুলের শিক্ষিকা। তাকে পুরুষের অধিকারের শক্তিতে ঘরে আটকিয়ে রাখতে পারেনি। তাই বশির সাহেবেরও নারী দিবস এলে গা জ্বালা করে। বউকে অনেক ভাবে আটকাতে চেয়েছে। বাচ্চার দোহাই দিয়ে। ঘরের কাজের ব্যাঘাত হবে, সবকিছু উতরিয়ে বশির সাহেবের স্ত্রী আজ স্কুল শিক্ষিকা। মোটামুটি নারীর অধিকার সম্বন্ধে জানলেও তাকে কার্যকর করা কঠিন কাজ।

রান্না করা, স্বামী দেখা, তার বাচ্চা দেখা নারীর একার কাজ না। বশির সাহেবের কথা, আমাদের মা–খালা তাই করত, তাদের সুখ ছিল। বশির সাহেবের স্ত্রী বাঁধন এমএ পাস। শিক্ষিতা নারী। মুখের ওপর জবাব দেওয়ার শক্তি রাখে। সে চোখের পানি ফেলে না শফিক সাহেবের স্ত্রীর মতো। বাঁধন স্বামীকে যুক্তি দিয়ে বুঝিয়ে দেয় সবকিছু। বলে, ‘তাই তো তোমার মা কোনো দিন টেবিলে তোমার বাবার পাশে বসে খেতে পারেনি। সকাল থেকে হেঁশেল ঠেলত। রাতে পাক ঘর থেকে বাহির হইতো। তাতে সে কতটুকু সুখী ছিল, তা জিজ্ঞেস করার মতো কেহ ছিল না। জীবনটা ব্যস্ত থাকত তোমার বাবার খেদমত আর তোমাদের খেদমতে করার কাজে। মানুষ হিসেবে নয়, একজন মহিলা স্ত্রী রূপে আর মা হিসেবে।’

বাঁধন বলে, তোমরা কি কখনো খাবার বানিয়ে তাকে বসিয়ে কোনো দিন খেতে দিয়েছ? তার বিশেষ দিনে তার উপস্থিতি কতটা গুরুত্ব কখনো বুঝতে দিয়েছ? সে তোমাদের বিশেষ দিনে রান্না করেছে। টেবিল ভরেছে খাবার বানিয়ে। তবুও সে হাসিমুখে সব করেছে। কারণ কোথাও তার অভিযোগ গ্রহণযোগ্য ছিল না। পুরুষশাসিত সমাজে পুরুষের কি কষ্ট হয়, তাই ছিল সবার মাথাব্যথা। অফিস থেকে বাড়ি ফিরলে কোনো কথাই নেই, কী করলে স্বামী খুশি থাকবে, সেটাই চলতো। শুধু কি খুশির অধিকার পুরুষের? নারী কি খুশির অধিকার রাখে না? তার ইচ্ছা–অনিচ্ছা স্বামীর হুকুমে হবে। কেন নারীর সবকিছুতে পুরুষের অনুমতি লাগবে? যে নারী স্বামী–সন্তান থেকে সবকিছু যত্ন করতে পারে, যে নারী রাঁধতে পারে সে চুলও বাঁধতে পারে।

বাঁধনের কথায় আজ বশির সাহেব কিছুটা থমকে যায়, এত সুন্দর করে সত্য বলার জন্য। বাঁধন আরও বলে, সেদিন আমাদের তিন তলার ভাড়াটিয়ার মেয়েটির সঙ্গে তুমি কতই না খারাপ ব্যবহার করলে, সে রাত করে বাইরে কাজ করে বলে। মেয়েটির বাবার কাছে নালিশ করলে। মেয়ে রাত করে ঘরে ফিরে, সবাই তার চরিত্র নিয়ে নানান কথা বলে। তাই তুমি নোটিশ দিয়ে হুমকি দিয়েছ বাসা ছাড়ার জন্য। চিন্তা করে দেখো তো, যেসব অফিস আদালত, পত্রিকা রাতে চলে, রাতে বিমান বন্দরে মেয়েরা রাতের পালায় কাজ করে—তারা কি সব খারাপ কাজ করে ঘরে ফিরে? যে সব সাংবাদিক তাদের রাতের সংবাদ জনগণের সুবিধার জন্য পত্রিকায় প্রকাশ করে, হয়তো অনেক সময় রিপোর্ট তৈরির খাতিরে রাতে তাদের বাইরে থাকতে হয়। তার অর্থ, সে খারাপ কাজ করে বাড়ি ফিরে না। পুরুষের রাতের কাজের যে সম্মান নারীর ঠিক একই সম্মান। একটি মেয়ে অফিসে কাজ করতে গেলে তার দায়িত্বের বাইরে যেমন কোনো কাজ শোভনীয় না, তেমনি তার সরলতার সুযোগ বা চাকরির দরকার বলে তার জায়গাকে দুর্বল ভাবা অন্যায়। এ সমাজ এখনো নারীকে শুধু বাচ্চা দান আর স্বামীর ভোগের পণ্য মনে করে। বাঁধন তার স্বামীকে বলে, নারী যদি ঘরে-বাইরে সমানভাবে পুরুষের পাশে কাজ করে, এ জাতি হবে সবচেয়ে উন্নত জাতি।

বশির সাহেব কিছুটা লজ্জিত হয় বাঁধনের কাছে ক্ষমা চায়। বাঁধন সান্ত্বনা দিয়ে বলে, একজন পুরুষের চিন্তা পরিবর্তন করতে পেরেছি—এটাই আমার শান্তি। তোমার মতো একজন করে সবাই যেদিন পুরুষের ভুল বুঝতে পারবে, এ দেশ এ জাতি সেদিন হবে উন্নত জাতি। একজন শিক্ষিত মা একজন কর্মঠ মা তৈরি করতে পারে উন্নত জাতি। বাঁধনের দুই হাত ধরে বশির সাহেব বলে, আর বলো না। আজ থেকে নারীদের প্রতি আমার সম্মান অনেক গুন বেড়ে গেছে তোমার কথায়।