নারী জাগরণ
আজ থেকে পাঁচ বছর আগের কথা। যখন যুক্তরাষ্ট্রে পা রাখল অনিতা। তখন থেকেই ভাবতে লাগল, নারী হয়ে জন্ম নেওয়াটাই কি পাপ?
তীব্র শীতের সকাল, সংসারের তাগিদে বের হতে হয় অনিতাকে। তার কাঁধে ঝোলানো ভ্যানিটি ব্যাগ। পায়ে হেঁটে চলা, তার একটাই উদ্দেশ্য মানানসই একটা কাজ খুঁজে পাওয়া। শীতের বরফের রাস্তা খানিকটা হেঁটেই যেন ক্লান্তময় মনে হলো। ঠান্ডায় জমে যেতে লাগল তার পুরোটা শরীর। কিন্তু কী করা, তাকে যে যেতেই হবে! মাস শেষে ঘর ভাড়া, বিদ্যুৎ বিল, পানির বিল, গ্যাস বিল, বাচ্চাদের খাবার। অসুস্থ স্বামীর সবকিছু মিলিয়ে সব ভুলে আবার পথ চলা শুরু করল অনিতা।
কার কাছে যাবে, কোথায় যাবে একটি কাজের আশায়! কিছুই যেন জানে না সে। কারণ এখানে সে একেবারে নতুন। জমানো যা কিছু অর্থ ছিল, তাও প্রায় শেষের পথে। রোজ রোজ সে বের হয় কাজের আশায়, যদি কেউ তাকে কাজ দেয়। এক বুক আশা নিয়ে বের হয়, কিন্তু নিরাশ হয়ে ঘরে ফিরে।
হঠাৎ চলতি পথে দেখা হয় দূর সম্পর্কের এক আত্মীয়ের সঙ্গে। তাকে বলল, তার একটি কাজের প্রয়োজন। যেকোনো একটি কাজ?
তারপর আত্মীয় ভেবেচিন্তে বলল, কাল এসো। তারপর সে একটি কাজের সন্ধান দিল। মনে মনে অনিতা ভাবতে লাগল, এ যেন অমাবস্যার আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ! ঠিকানা মতো গেল সেখানে, কাজের দরকার তাই। কোনো কিছু না ভেবেই কাজটা নিয়ে নিল। কাজটা ছিল একটা স্টেশনারি দোকানে।
সেখানেও বৈরিতা ছিল। একদিন ম্যানেজার এসে দুজনকে চেক হাতে ধরিয়ে দিল।
আমি মেয়ে বলে কাজের আওয়ার তিন ডলার। আর ছেলে বলে সাত ডলার দেওয়া হলো পুরুষ সহকর্মীকে। অনিতা তখনো বুঝতে পারেনি, যুক্তরাষ্ট্রেও নারীরা অবহেলিত।
নারী হয়ে জন্ম নেওয়াই যেন অনেক বড় অভিশাপ। সঙ্গে সঙ্গে অনেক কষ্টে চোখের জল মুছে আবার ঘুরে দাঁড়ানোর পালা। নারী বলে নিজেকে ধিক্কার দেওয়ার অবকাশ নেই। মুহূর্তেই মনে হয়েছে জেগে উঠতে হবে। ন্যায্য অধিকারের জন্য নিজেকেই লড়াই করতে হবে।
অনিতা ম্যানেজারকে ডেকে বলে, আমার কাজের মজুরি মেয়ে হিসেবে অর্ধেক হতে পারে না। ম্যানেজার তখন তার লোলুপ দৃষ্টি দিয়ে অনিতার কাছে আসার চেষ্টা করে। ভঙ্গিমায় বুঝিয়ে দিতে চাইল, অনিতার কাজের মূল্যের চেয়ে তার লোলুপ দৃষ্টির পিপাসায় যদি ধরা দেয়, তবেই সে পাবে অনেক মোটা অঙ্কের চেক। মুহূর্তেই তার প্রখর প্রতিবাদে রুখে দাঁড়াল আর চিৎকার করে বলতে লাগল, নারী শুধু ভোগের পণ্য নয়। অনিতার গলার আওয়াজে যেন গর্জনের সুর, আশপাশের সব মানুষ জড়ো হতে লাগল।
নারীকে সম্মান করতে শেখো, এ বলেই ৯১১–এ কল করল। তৎক্ষণাৎ পুলিশের গাড়ি এল, তার সব কথা শুনে তাকে তুলে নিয়ে গেল।
অনিতা জানে, সেদিন থেকে কাজটা আর থাকবে না। তাতে কোনো আফসোস নেই। আর শুনতে হবে না, রাত করে বাড়ি ফেরে এই মেয়ে চরিত্রহীন। সন্তান ঠিকমতো মানুষ না হলে শুনতে হয়, সব দোষ মায়েদের। ছেলে যদি বউ পাগল হয় শুনতে হয়, বউ জাদুটোনা করছে।
তবুও তো অল্প হলেও অনিতা প্রতিবাদ করেছে। প্রতিবাদ হয়তো সবাই করতে পারে না। অনিতা ভাবে, পৃথিবীর সব নারী জাতি যদি অল্প অল্প করে প্রতিবাদ ও পরিবর্তন করতে শেখে, তবে একদিন এই নারীরাই পুরুষ শাসিত সমাজে বাহাবা পাবে। তবেই নিজের শূন্য থেকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবে। ধর্ষণের তকমাও যেন নারীর ওপর, তার বুকের ওপর ওড়নাটা সরে গেলে সেটাও যেন নারীর দোষ। ধর্ষক হলো পুরুষ, দোষ হয় নারীর। নারী যদি প্রতিবাদ করে নিজে শূন্য থেকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে, তবেই হবে ধন্য এই নারী।
সে দিন থাকবে না আর একদিনের জন্য নারী দিবস? থাকবে প্রতিদিনই নারী দিবস।
নিউইয়র্কের ফুটপাথ দিয়ে অনিতা হাঁটে। সাইরেন বাজিয়ে পুলিশের গাড়ি এগিয়ে যায়। এক দঙ্গল স্বদেশি নারী ‘নারী দিবস’–এর অনুষ্ঠান করে বেরিয়েছে।
এ সমাবেশের জন্য চাঁদা দিয়েছেন অনিতার চাকরিদাতা স্বদেশি। প্রধান বা বিশেষ অথোরিটি হিসেবে তাঁরও এখানে বক্তৃতা দেওয়ার কথা।
নিউইয়র্কের ঝকঝকে আকাশে মেঘের খেলার মধ্যে শীতের পূর্ণিমা। চেয়ে থাকে অনিতা।
ভাবে, প্রতিবাদ করেই জাগরণ নিয়ে আসতে হবে। এ রকম ছোট ছোট প্রতিবাদ একদিন নারী অধিকারের সচেতনতা বাড়াবে।